করোনার ‘দুর্দিন’ পেরিয়ে ‘ভালো’ নববর্ষের বেচাকেনা
করোনার বাড়বাড়ন্তে গত দুই বছর বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল একেবারে মলিন। এবার করোনা নিম্নমুখী। চারুকলায় চলছে পুরোনো আমেজে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতি। ব্যবসায়ীরাও পসরা সাজিয়ে বসেছেন বববর্ষকেন্দ্রিক পণ্যের। রোজার মধ্যে বৈশাখ পড়ায় বেচাকেনা আশানুরূপ নয়। তবে করোনার ধকল কাটিয়ে এই বেচাকেনাকে ‘মন্দের ভালো’ বলছেন ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দোয়েল চত্বর, নিউ মার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বাঙালি সংস্কৃতির ধারক নববর্ষ উদযাপনে প্রস্তুত সব শ্রেণির ব্যবসায়ী। আজিজ সুপার মার্কেটের ফ্যাশন হাউজগুলোতে যেমন বৈশাখী পোশাকের সম্ভার, তেমন কার্জন হল সংলগ্ন দোয়েল চত্বরে বসেছে সাজি, কুলা, চালন, ধামা, পালি, ঢেঁকি, পাখা প্রভৃতি পণ্যের পসরা।
এবার বাংলা ১৪২৯ বঙ্গাব্দে পা রাখবো আমরা। অথচ দোয়েল চত্বরে সোহেল রানার দোকানে রাখা একটি বাঁশের চালনে লেখা ১৪২৭ বঙ্গাব্দ। দুই বছর আগের পণ্য ঝুলিয়ে রাখা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোভিডে ঘরবন্দি থাকার কারণে এটা বিক্রি হয়নি। এবার কোভিডের ভয়াবহতা নেই। মানুষ বাইরে বের হচ্ছে। আমার দোকানে বৈশাখী সব মালামাল আছে। বাঁশের কুলা, ডালাসহ বৈশাখী যত আইটেম দরকার সব আছে।
‘আমি ২০ বছর ধরে বৈশাখী মালামাল বিক্রি করি। তবে বেচাকেনা সেভাবে এখনো শুরু হয়নি। রোজার মধ্যে বৈশাখ পড়েছে। এসব কারণে বেচাকেনা কম। গত দুই বছর লকডাউন ছিল। বৈশাখের অর্ডার ও কাস্টমার নেই। এবারও তেমন আশা দেখছি না।’
সোহেল রানার মতো অনেকেই আশানুরূপ বৈশাখী পণ্য বিক্রি করতে পারেননি। তবে গত দুই বছরের তুলনায় বেচাকেনা ভালো বলে দাবি করেন কিছু বিক্রেতা।
দোকানি সাগর জাগো নিউজকে বলেন, বৈশাখ উপলক্ষে অন্য বছরের মতো পণ্য তুলেছি। এর মধ্যে অন্যতম একতারা, ডুগডুগি, টমটম গাড়ি। এছাড়া কুলা, পাখা ও মুখোশ সবই আছে। বাঁশি ও বেতের রিকশাও বিক্রি করছি।
বেচাকেনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেক বছর যেভাবে বেচাকেনা হয় এবার সেভাবে হয়নি। তবে টুকটাক বেচাকেনা হচ্ছে। করোনার আগে বেচাকেনা অনেক ভালো ছিল। করোনার মধ্যে তো একেবারে বেচাকেনা হয়নি। তবে এবার আল্লাহর রহমতে মোটামুটি বেচাকেনা হচ্ছে।
কিছু বহুজাতিক কোম্পানি করপোরেট অফিসে সাজাতে বাঁশ, বেত ও মাটির পসরা কিনতে এসেছে। তেমন একজন নারী হাবীবা বিনতে জামান। পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে অফিস সাজানোর দায়িত্ব পড়েছে তার ওপর। অফিসে নান্দনিক একটা ‘লুক’ আনার জন্য লোকজ উপকরণ দরকার। তাই সহকর্মী সাইদুর রহমানকে নিয়ে দোয়েল চত্বরে এসেছেন।
হাবীবা বিনতে জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাতে সময় নেই। তাই সহকর্মীকে নিয়ে বাঁশ, বেত ও মাটির কিছু পসরা কিনবো। যাতে আমাদের অফিসে পুরো বাঙালিয়ানা আবহ আনা যায়।’
বৈশাখে ইলিশ ভাজা, মরিচ পোড়া, বেগুন ভাজা, আলুভর্তা আর পান্তা ইলিশের ভোজ না হলে যেন বৈশাখের উদযাপনই ফিকে হয়ে আসে। তাই ইলিশের চাহিদা থাকে বৈশাখে। গত দুই বছরে তুলনায় কিছুটা ইলিশ বেচাকেনা হচ্ছে বলে দাবি বিক্রেতাদের।
কাওরানবাজারে কথা হয় ইলিশ বিক্রেতা সবুজ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোজার কারণে ইলিশ বেচাকেনা কম। তবে বৈশাখ তো সবাই মানে। তাই গত দুই বছরের তুলনায় বেচাকেনা মোটামুটি। এক কেজি ওজনের ইলিশ ১৩শ টাকা কেজি ও এক কেজি ২শ গ্রাম ওজন হবে এমন ইলিশ ১৪শ থেকে ১৫শ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।’
বৈশাখে সবাই বাহারি পোশাক পরতে পছন্দ করে। আজিজ সুপার মার্কেট এখন দেশীয় পোশাকের বিশাল বাজার হিসেবে অধিক পরিচিত। এই মার্কেটের তিন তলা পর্যন্ত শতাধিক দোকানে বৈশাখী পণ্য বেচাকেনা চলছে।
বাংলা নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে ক্রেতাগোষ্ঠীর সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে নতুন নতুন ডিজাইনের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, টপস, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, শার্ট, টি-শার্ট, শিশুদের পোশাক। পোশাকে ব্যবহার হয়েছে লাল, মেরুন, কমলা, সাদা, অফহোয়াইটসহ নানান রং। পোশাক ও অনুষঙ্গে এদেশের চিরাচরিত ফোক মোটিফের উপর নিরীক্ষাধর্মী নকশা ব্যবহার করা হয়েছে।
শাড়িতেও বৈশাখের বিষয় হিসেবে ভিন্নতা আনা হয়েছে। পটচিত্র, ট্রাইবাল মোটিফ, গ্রিক আর্চ মোটিফ, ফ্লাওয়ার মোটিফ ইত্যাদি। বোনা তাঁতের শাড়িতে মার্জিত রঙের ব্লকপ্রিন্ট, স্ক্রিনপ্রিন্ট, অ্যাল্পিক, হাজার-বুটির কাজ করা হয়েছে। এছাড়া কিছু শাড়িতে রয়েছে এমব্রয়ডারি।
বৈশাখের সঙ্গে রোজার ঈদের বেচাকেনা চলছে বলে দাবি বিক্রেতাদের। আজিজ সুপার মার্কেটের কাপড়-ই বাংলার কর্ণধার রোমিও আদিত্য জাগো নিউজকে বলেন, বৈশাখ উপলক্ষে আমাদের প্রস্তুতি শতভাগ। ঈদ ও বৈশাখ মিলে দুই ধরনের পণ্য আমরা উঠিয়েছি। অনেক রকমের প্রোডাক্ট আছে। বৈশাখের প্রোডাক্ট যারা কিনতে চাচ্ছে তারা বৈশাখের প্রোডাক্ট পাবে, ঈদের প্রোডাক্ট যারা কিনতে চাচ্ছে তারা ঈদের প্রোডাক্ট পাবে। যেহেতু রমজান মাস সেহেতু তুলনামূলকভাবে বেচাকেনা কম। তবে গত দুই বছরের চেয়ে ভালো।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি জানায়, রোজার মধ্যে বৈশাখ হওয়ায় বেচাকেনা কম হবে। ফ্যাশন হাউজে কিছু পোশাক বিক্রি হবে। সাধারণ ব্যবসা থাকবে না। যারা ঢোল বানায়, খেলনাজাতীয় জিনিস তৈরি করে এগুলো থাকবে না। কারণ এবার মেলা হবে না। ফলে অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আবারও বিপদে পড়বে। তবে গত দুই বৈশাখে লকডাউন ছিল। সেই হিসেবে মন্দের ভালো। এবারের বৈশাখে পাঁচ থেকে সাতশ কোটি টাকার ব্যবসা হতে পারে।
দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘রোজার মধ্যে এবার বৈশাখ। সেক্ষেত্রে তেমন বেচাকেনা হবে না। তবে এবার বলা যায় মন্দের ভালো হবে। পাঁচ থেকে সাতশ কোটি টাকার বেচাকেনা হতে পারে। কারণ ঈদ সামনে। বৈশাখের বাজেট এখানে চলে যাবে।’
তবে বৈশাখে কত টাকার বাণিজ্য হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। ব্যবসায়ী নেতা ও অর্থনীতিবিদের ধারণা, সারা দেশে নববর্ষ কেন্দ্র করে কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা হয়। ঈদ বা পূজার সঙ্গে বর্ষবরণ উৎসবের তফাত হচ্ছে, এসময় দেশীয় পণ্য কেনায় ক্রেতাদের ঝোঁক থাকে। তাই বৈশাখকেন্দ্রিক বেচাবিক্রিতে গ্রামীণ অর্থনীতি বেশ চাঙা হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক (ডিজি) বিনায়ক সেন জাগো নিউজকে বলেন, বৈশাখে দেশের অর্থনীতি চাঙা হয়। এটা সর্বজনীন উৎসব। তবে বৈশাখে কত টাকার বেচাকেনা হয় এটা নিয়ে আমরা গবেষণা এখনো করিনি। তবে এটা নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’
অর্থনীতিবিদদের দাবি, পহেলা বৈশাখের সঙ্গে হালখাতার বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। হালখাতায় ক্রেতা ও গ্রাহকদের মিষ্টি-নিমকি খাওয়ান ব্যবসায়ীরা। গ্রামেও আবহমান কাল ধরে ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করান ব্যবসায়ীরা। পুরাতন হিসাব-নিকাশ চুকিয়ে নতুন খাতা খোলা হয়। তবে হালখাতার জৌলুশ ফিকে হয়ে গেছে। তারপরও মিষ্টি খাওয়ানোর প্রচলনটা রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংক ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকদের নববর্ষের উপহার দেওয়ার ক্ষেত্রে মিষ্টি রাখে।
অনেকে পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে নববর্ষে কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও সিলেটে ঘুরতে যান। ফলে ট্যুর অপারেটর ও পরিবহন খাতে ভালো ব্যবসা হয়। এই উৎসবে দেশীয় পণ্য ব্যবহারের প্রতি মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে। এতে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত জনগণ অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা পান। বৈশাখে ভোক্তা ব্যয় বাড়ে ফলে এটা প্রবৃদ্ধিতেও দারুণ অবদান রাখে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বৈশাখে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা লাভবান হন। কারণ বিনোদনমূলক পণ্যের চাহিদা বেশি থাকে। বছরে একটা ব্যবসা করার সুযোগ। যারা কাপড়ের ব্যবসা করেন তারা লাভবান হন। বাচ্চারা নতুন নতুন পোশাক পরে। খাদ্য ও মিষ্টির প্রচলন থাকে। সুতরাং, মিষ্টি ব্যবসায়ীরাও লাভবান হন। মানুষ নানা জায়গায় বেড়াতে যায়। সেবাখাত চাঙা হয়। সেদিক থেকে বৈশাখের গুরুত্ব অনেক।’
তিনি আরও বলেন, ‘রোজা থাকলেও মানুষ আনন্দ করবে। দুই বছরের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ আছে। বিপদের বিষয় মূল্যস্ফীতি। কারণ মূল্যস্ফীতির কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পণ্য কিনে বিক্রি করতে পারবে না। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে। তারপরও বলবো কোভিড ভীতি এখন নেই। ব্যবসা কিছু ভালো হবে আশা করা অবাস্তব হবে না।’
বৈশাখে ভোক্তা ব্যয় বাড়ার ফলে প্রবৃদ্ধিও বাড়ে বলে দাবি অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের।
এমওএস/এএ/জেআইএম