স্কুলে ফি নৈরাজ্য : আন্দোলনে নামছেন অভিভাবকরা

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:২২ এএম, ১৫ জানুয়ারি ২০১৬

স্কুলে ভর্তি ফি নির্ধারণে নীতিমালা থাকলেও মাসিক ফি নির্ধারণের নীতিমালা নেই। এ সুযোগে রাজধানীর নামকরা স্কুলগুলো এ বছর অভিভাবকদের না জানিয়ে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়েছে। এদিকে শিক্ষার বাড়তি ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন অভিভাবকরা।

নিরুপায় হয়ে তারা নৈরাজ্যকর ফি প্রত্যাহারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। তাদের দাবি পূরণ না হওয়ায় আগামী রোববার থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে বড় ধরনের আন্দোলনে নামছেন অভিভাবকরা। রাজধানীর বিভিন্ন স্কুলের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক শামিম আরা জাগো নিউজকে বলেন, তৃতীয়, ষষ্ঠ ও নবম শ্রেণিতে আমার তিন সন্তান পড়ে। তৃতীয় শ্রেণির টিউশন ফি ১৩ শ’ টাকা থেকে বাড়িতে ২১শ’, ষষ্ঠ শ্রেণির টিউশন ফি ১৫শ’ ৫০টাকা থেকে ২৫শ’ ৫০ টাকা ও নবম শ্রেণির ১৫ শ’ ৫০টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৬শ’ ৫০ টাকা করা হয়েছে।

তিনি জানান, অভিভাবকদের না জানিয়েই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রতিবাদ করলে তিনি শিক্ষক-কর্মচারীদের দিয়ে আমাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করন। এত টাকা বেতন দিয়ে সন্তানদের কোন ভাবেই লেখা পড়া করানো সম্ভব নয়। তাই তিনি অতিরিক্ত বেতন প্রত্যাহারের দাবি জানান।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, খিলগাঁও ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি ফি নেয়া হয়েছে ১৮ হাজার ৬শ’ ৬০ টাকা। এই স্কুলের প্রতি শ্রেণিতে মাসিক বেতন দুইশত টাকা বাড়ানো হয়েছে। উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাসিক বেতন ৮শ’ টাকা থেকে ১২শ’ টাকা করা হয়েছে।

অন্যদিকে, কিন্ডারগার্টেন (কেজি) শ্রেণির বেতন দেড় হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা করা হয়েছে। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে এক হাজার ৬শ’ টাকার ফি দুই হাজার ২শ’ টাকা করা হয়েছে। জুনিয়র ল্যাবরেটরি হাই স্কুলে মাসিক বেতন ৫ শ’ টাকা বাড়ানো হয়েছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্রথম শ্রেণির ফি ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে দেড় হাজার টাকা, দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ৮শ’ টাকার ফি বাড়িয়ে ১৬ শত টাকা করা হয়েছে। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ৯শ’ টাকার ফি ২২শ’ টাকা করা হয়েছে।

এছাড়া মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল, বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়, গেণ্ডারিয়া হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ ফি বাড়ানো হয়েছে। রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট জোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, জুনিয়র ল্যাবরেটরি স্কুলসহ অনেক স্কুলে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ফি বাড়ানো হয়েছে। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ গত আগস্ট মাসে ফি বাড়ানোর পর চলতি বছরও প্রতি ক্লাসে ১০০ টাকা ফি ও এক হাজার টাকা ভর্তি ফি বাড়িয়েছে।

বেতন বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দিয়ে একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা জানান, নতুন পে স্কেলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ হওয়ায় স্কুলে কর্মরত নন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদেরও দ্বিগুণ বেতন প্রতিষ্ঠান থেকে দিতে হবে। কোনো স্কুলেই ১০ শতাংশের বেশি শিক্ষক এমপিওভুক্ত নয়। শিক্ষকদের অতিরিক্ত টাকা দিতেই  শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন বাড়ানো হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা ৯ হাজার ৩২২ জন। আর ৪৩২ জন শিক্ষক-কর্মচারীর ৩৪ জন এমপিওভুক্ত। বাকি ৩৯৮ জনের বেতন বাড়াতে ৯ হাজার শিক্ষার্থীর ফি দ্বিগুণ করা হয়েছে।

ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চার ক্যাম্পাস মিলিয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। আর শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৭৫০ জন। এর মধ্যে ৫২ জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত। বাকি প্রায় ৭০০ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বাড়াতে ২৫ হাজার শিক্ষার্থীর টিউশন ফি বাড়ানো হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

সেই হিসেবে অতিরিক্ত বেতন থেকে স্কুল কর্তৃপক্ষের যে আয় হবে, শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে তার চার ভাগের এক ভাগও ব্যয় হবে না। তবুও বেতন বৃদ্ধির অজুহাতে শিক্ষার্থীদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। শুধু এই দুটি স্কুলেই নয়, একই চিত্র রাজধানীর অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেরেই।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভর্তি নীতিমালা-২০১৫-তে বলা হয়েছে, রাজধানীর এমপিওভুক্ত স্কুলে ভর্তিতে সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা, আংশিক এমপিওভুক্ত ও এমপিওবহির্ভুত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা এবং ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ফি নেয়া যাবে। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই এই নীতিমালা মানছে না। নানা খাত দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। তবে মাসিক ফি নির্ধারণের কোনো নীতিমালা না থাকায় স্কুল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমতো মাসিক বেতন আদায় করছে।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবক ফোরামের নেত্রী রেহানা আক্তার শিল্পী জাগো নিউজকে জানান, বর্ধিত ফি প্রত্যাহারের দাবিতে গত রোববার বিক্ষোভ মিছিল ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন। আগামী রোববার তারা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লাগাতার অবস্থান ধর্মঘট পালন করবেন। ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে ওই দিন ভিকারুননিসা স্কুলের অভিভাবকদের আন্দোলনে সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করতে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে তারা সেখানে যাবেন।

ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরা বেইলি রোডের প্রধান ক্যাম্পাসের সামনে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ করেছেন। এছাড়াও উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় ও বিয়াম স্কুলের অভিভাবকরা ফি বাড়ানোর প্রতিবাদ আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিন বলে জানা গেছে।

এছাড়া স্কুল মাদরাসার বেতন নৈরাজ্য নিরসনে বেতন নির্ধারণে নীতিমালা দাবি শিক্ষাসচিবের কাছে সংগঠনের নেতারা মঙ্গলবার একটি স্মারকলিপি দিয়েছেন। বেতন নৈরাজ্যের প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন ১৯ জানুয়ারি সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ভর্তি নীতিমালায় শিক্ষার্থীদের মাসিক ফি ধার্যের সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি না থাকায় ফাঁক-ফোকর দিয়ে নামিদামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাগামহীন বেতন বৃদ্ধি করছে। ভর্তি নীতিমালায় ফির বিষয়টিও নির্ধারণ করে দেওয়া জরুরি। যেহেতু প্রতিবছরই ভর্তি নীতিমালা করা হয়, তাই ফি বাড়ানো লাগলে মন্ত্রণালয়ই বাড়িয়ে দিতে পারে। তাহলে স্কুলগুলো দ্বিগুণ হারে ফি বাড়ানোর সুযোগ পাবে না।

এনএম/এসকেডি/এআরএস/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।