মিল এলাকায় আখ চাষে ভাটা, অন্য ফসলে বাড়ছে আগ্রহ
* মিল এলাকায় চাষ কমেছে এক-তৃতীয়াংশ
* চিনিকল বন্ধ থাকায় আরও থমকে গেছে
* মিলের বাইরে কমেছে সামান্য
জয়পুরহাট সদর এলাকায় ছোট যমুনার দুই পাড়ে একসময় শুধু আখের চাষ হতো। সেখান থেকে জয়পুরহাট চিনিকলের দূরত্ব কয়েক কিলোমিটার। চিনিকলের নিজস্ব জমিও (মিল এলাকা) আছে এসব এলাকায়। মিলের নিজস্ব ও মিলবহির্ভূত জমিতে উৎপাদিত এসব আখ দিয়েই কার্যত সরকারি এ চিনিকলের চাহিদা পূরণ হতো। চিনিকলে আখের চাহিদা ক্রমেই কমছে। ফলে জমিগুলোতে কমেছে আখ চাষ। চিনিকলের জমি ছাড়াও চাষযোগ্য জমি দখল করে নিয়েছে বিবিধ ফসল।
ছোট যমুনার পাড়ে ষাটোর্ধ্ব আখচাষি ফরিদ মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘ছোটবেলায় এসব জমিতে আখ ছাড়া কোনো কিছু চাষ হতে দেখিনি। কিন্তু এখন কেউ আখ চাষ করতে চায় না। সবাই অন্য ফসল চাষে ঝুঁকেছে। মিলের (চিনিকল) কিছু জমিতে শুধু আখ চাষ হচ্ছে।
কারণ জানিয়ে এ চাষি বলেন, মিল এখন আর আগের মতো আখ কেনে না। মৌসুমে মিল চলে না দু-তিন সপ্তাহ। আবার এর মধ্যে কেউ আখ দিলে সেটার টাকা পরিশোধ করে না। যখন টাকা দেয়, সেটা কম, তাতে লাভ হয় না। দীর্ঘদিন এসব সমস্যায় আখ চাষে অগ্রহ হারিয়েছে সবাই।
এ এলাকার চাষিদের অনাগ্রহের প্রমাণ মেলে পরিসংখ্যানেও। ২০১৩-১৪ মৌসুমে এ জেলায় আখ চাষ হয়েছিল ১১ হাজার ৬০৮ একর জমিতে। সবশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে জেলায় আখ চাষ নেমেছে ৩ হাজার ২০ একরে।
শুধু জয়পুরহাট নয়, সারাদেশে ও মিল এলাকায় আখ চাষের এ পরিস্থিতি। বিএসএফআইসি তথ্য বলছে, গত এক দশকে মিল এলাকায় আখের জমি ও উৎপাদন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে। তথ্য বলছে, যেখানে এসব এলাকায় ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ লাখ ৬১ হাজার ৪২৯ একর জমিতে আখ চাষ হয়েছিল, তা ২০১৯-২০ অর্থবছরে নেমেছে ১ লাখ ২৭ হাজার ২৮৩ একরে। একই সময় আখের উৎপাদন ৩০ লাখ ৪০ হাজার ২২৪ টন থেকে কমে নেমেছে ২১ লাখ ৫১২ টনে।
তবে মিল এলাকায় যে পরিমাণ আখ চাষ কমেছে, মিলবহির্ভূত এলাকায় তত বেশি কমেনি। বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএসআরআই) তথ্য বলছে, গত অর্থবছর (২০২০-২১) সারাদেশে (মিল ও মিলবহির্ভূত এলাকা) ১ লাখ ৯৫ হাজার একর জমিতে আখের চাষ হয়েছে। যার মধ্যে ১ লাখ ২৬ হাজার একর মিলের জমি। বাকি ৬৯ হাজার একর বাইরের। বিগত তিন বছর আগেও (২০১৮-১৯) এ মিলবহির্ভূত জমির পরিমাণ ছিল ৭১ হাজার একর। অর্থাৎ তিন বছরে কমেছে দুই হাজার একর।
এদিকে গত অর্থবছর (২০২০-২১) মিল এলাকায় মোট আখের উৎপাদন ১৯ লাখ ৬৯ হাজার টন হয়েছে বলে জানিয়েছে বিএসআরআই।
এ বিষয়ে বিএসআরআইয়ের মহাপরিচালক জাগো নিউজকে বলেন, আখের উৎপাদন যেভাবে মিল এলাকায় কমছে, তার চেয়ে ভালো অবস্থা বাইরের এলাকায়। সেখানে গুড়ের জন্য এবং চিবিয়ে খাওয়া আখের ভালো চাহিদা রয়েছে।
এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলগুলোর লোকসানের বোঝা কমাতে সরকারি ছয় চিনিকল বন্ধ করে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশন (বিএসএফআইসি)। উৎপাদন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া চিনিকলগুলো হচ্ছে- কুষ্টিয়া, পাবনা, পঞ্চগড়, শ্যামপুর (রংপুর), রংপুর ও সেতাবগঞ্জ (দিনাজপুর) চিনিকল। সব মিলিয়ে করপোরেশনের অধীনে রয়েছে ১৫টি চিনিকল। ছয়টি চিনিকল বন্ধ হলেও বাকি নয়টিতে আখ মাড়াই কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এমনকি ছয়টি চিনিকলের অধীনে থাকা চাষিদের আখ কিনছে করপোরেশন। সেই আখ চালু থাকা চিনিকলে মাড়াই হচ্ছে। কিন্তু যেসব এলাকার চিনিকল বন্ধ সেসব এলাকায় আখের চাষে দারুণ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পঞ্চগড় চিনিকল বন্ধ থাকায় ওই এলাকার আখ ঠাকুরগাঁও চিনিকলে সরবরাহ হচ্ছে। তারপরও চলতি মাড়াই মৌসুমে পঞ্চগড় চিনিকলে সরকারিভাবে মাড়াই বন্ধ ঘোষণার পর থেকেই ক্ষেতের আখ নিয়ে দুর্ভোগে পড়েছেন কয়েক হাজার চাষি। নির্দিষ্ট সময়ে চিনিকলে আখ দিতে না পারায় দিন দিন ক্ষেতেই শুকিয়ে গেছে আখ। এতে ওজন কমে লোকসান গুনেছেন কৃষকরা। এজন্য চলতি মৌসুমে ওই এলাকায় আখের আবাদ অনেক কমেছে।
ওই এলাকায় বেশ কয়েকজন কৃষক জানান, তারা চিনিকল বন্ধ শোনার পর থেকে নতুন করে আখ চাষ করছেন না। চিনিকল কর্তৃপক্ষও আর আখ চাষে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করছে না। ফলে পুরোনো আখ ক্ষেতগুলোতে অন্য ফসল আবাদ করছেন চাষিরা।
একইভাবে খোঁজ নিয়ে অন্যান্য বন্ধ চিনিকল এলাকায় কৃষকদের মধ্যে সার-কীটনাশক, বীজ ও ঋণ দেওয়াও বন্ধ রয়েছে বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ চিনিকল আখচাষি ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী জাগো নিউজকে বলেন, চিনিকল বন্ধসহ বিভিন্ন কারণে ক্রমাগত লোকসানে চাষিরা এখন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। যেটুকু চাষাবাদ ধরে রেখেছে সেটা গুড় ও চিবিয়ে খাওয়া আখের চাষ। এ দুই দিকই কৃষকের জন্য অনুকূল। চাষিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলার আগেই দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। চিনিকল চালু হলে চাষিরা হয়তো আবারও আগ্রহ ফিরে পাবেন।
আখ চাষ কমার প্রসঙ্গে বিএসআরআই মহাপরিচালক আমজাদ হোসেন আরও বলেন, চিনিকল বন্ধের পাশাপাশি এ ফসল কমার আরও কিছু কারণ রয়েছে। এটা একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল ও ব্যয়বহুল। ফলে দীর্ঘসময় ক্ষেতে ফসল রেখে ব্যয় নির্বাহ করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
তিনি বলেন, এটি লাভজনক। কিন্তু বিক্রি না হলে সেটা তো সম্ভব নয়। চিনিকলের জন্য আগে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ চাষাবাদ হতো। এখন ছয়টি মিল বন্ধ। অনেকে পাওনা পাননি। এজন্য মিলবহির্ভূত এলাকায় আখের চাষ বেশ কমেছে। এসময় অন্যান্য ফসল করে লাভবান হচ্ছে কৃষক। পাশাপাশি তারা চিনিকল থেকে আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে না। সেটা আরেক বড় কারণ।
এনএইচ/এএ/এএসএম