ঢাকায় পোষা প্রাণীর আবাসিক হোটেল ‘ফারিঘর’

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:১৮ এএম, ২০ মার্চ ২০২২
দীর্ঘদিন নিরাপদে প্রিয় প্রাণীটিকে রাখা যাবে ফারিঘরে

প্রাণীর প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই বিড়াল, কুকুর, পাখি পুষি আমরা। বাড়িজুড়ে বিচরণ করে এসব পোষা প্রাণী। অনেকের বেডরুমেও জায়গা হয় তাদের। হয়ে ওঠে পরিবারের একজন। তবে এসব প্রিয় প্রাণী নিয়ে ‘বিড়ম্বনায়’ পড়তে হয় যখন বাড়ির বাইরে যেতে হয়। কর্মক্ষেত্র বা দীর্ঘদিনের জন্য বাড়ির বাইরে অবস্থান করতে হলে অবলা এসব প্রাণী নিয়ে পড়তে হয় বিপাকে। মানুষের সহযোগিতা ছাড়া পোষা প্রাণীর দিনযাপন কষ্টকর। এসব বিড়ম্বনার অবসানে রাজধানীতে চালু হয়েছে পোষা প্রাণীর আবাসিক হোটেল ‘ফারিঘর’।

দেশের প্রথম বিষেশায়িত এ হোটেলে যে কেউ তাদের পোষা বিড়াল বা কুকুর রাখতে পারবেন। উন্নত পরিবেশে ফারিঘরে কুকুর-বিড়ালের আবাসনের ব্যবস্থা করেছেন উদ্যোক্তারা। থাকার পাশাপাশি পোষা প্রাণীর জন্য মিউজিক ও বিনোদনের ব্যবস্থাও আছে। তবে এজন্য খরচ পড়বে প্রতিদিন ৫০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা।

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের যেখানে নাভিশ্বাস, যেখানে টিসিবির ট্রাকের পেছনে মানুষের দীর্ঘ লাইন, সেখানে কুকুর-বিড়ালের জন্য আবাসিক হোটেল এই মুহূর্তে বিলাসিতা কি না-এমন প্রশ্ন অনেকের মনে জাগতেই পারে। তবে পোষা প্রাণীর এই আবাসিক হোটেল বিলাসিতা নয়, বরং প্রয়োজনীয়তা বলেই দাবি ফারিঘরের উদ্যোক্তার।

jagonews24

রাজধানীর মিরপুরের চিড়িয়াখানা সড়কে পোষা প্রাণীর জন্য এই আবাসিক হোটেল খুলেছেন নুজহাত নাবিলা, খালিদ ফারহান ও প-ফাউন্ডেশনের ফাউন্ডার (পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার) রাকিবুল হক এমিল। অফিস, হাসপাতাল কিংবা লম্বা সময়ের জন্য কোথাও বেড়াতে গেলে যে কেউ তাদের পোষা প্রাণী রেখে যেতে পারবেন ফারিঘরে। গরমের কষ্ট দূর করতে লাগানো হচ্ছে এসিও।

যারা এখানে পোষা প্রাণী রাখতে যাবেন তাদের জন্যও রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কফি কর্নার। সেখানে মিলবে নিরামিষ খাবার আর কফি। সেল্ফ-এ থাকা বই পড়েও সময় কাটাতে পারবেন প্রাণী অভিভাবকরা। এছাড়া পোষা প্রাণীর খেলনাসহ বিভিন্ন উপকরণও কেনা যাবে ফারিঘর থেকে।

ফারিঘরের স্বত্বাধিকারী স্থপতি রাকিবুল হক এমিল জাগো নিউজকে বলেন, আমরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে প্রাণীকল্যাণের সঙ্গে যুক্ত। প্রাণীদের কল্যাণের কথা মাথায় রেখেই ফারিঘরের আইডিয়াটা (ধারণা) এসেছে। মানুষের মতো পোষা প্রাণীদেরও বেশকিছু সেবা লাগে। যারা খেতে পছন্দ করেন, সিনেমা দেখতে পছন্দ করেন তাদের প্রত্যেকের জন্য শহরে বেশ কিছু জায়গা আছে, সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিন্তু পোষা প্রাণী রাখার তেমন ব্যবস্থা নেই। সেখান থেকেই ফারিঘরের ধারণা। ফারিঘরের মাধ্যমে প্রাণীর উপকারের পাশাপাশি প্রাণীপ্রেমীরা বেশকিছু সুবিধা পাবেন। তারা যখন বাসার বাইরে যাবেন তখন এখানে তাদের পোষা প্রাণী রেখে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন।

jagonews24

ফারিঘরের মতো আরও উদ্যোগের দরকার আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সমাজ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে সভ্যতার দিকে যাচ্ছি। আমরা কতটুকু সভ্য সেটা আসলে সমাজে প্রাণীদের জন্য কতটা জায়গা আছে তার ওপরও নির্ভর করে। এটি একটি প্রয়োজনীয় সেবা, কেননা কেউ শখ করে টাকা খরচ করে এখানে তার পোষা প্রাণীটি রাখবে না। শহরে হাজার হাজার প্রাণীপ্রেমী রয়েছেন। তাদের ব্যবসায়িক কাজ কিংবা অসুস্থতার জন্য ঘরের বাইরে থাকতে হয়। তাই পোষা প্রাণীর জন্য এ ধরনের উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ফলে প্রাণীর প্রতি মানুষের সহমর্মিতা বাড়বে, প্রাণী পোষার হারও বাড়বে।

ভবিষ্যৎ ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফারিঘরে কুকুর রাখার জন্য তিনটি ঘর আছে। আমাদের ইচ্ছা আছে এ সংখ্যা বাড়ানো। কেননা খাবার দিয়ে বিড়াল বাসায় একা রাখা যায়, কিন্তু কুকুর একদমই বাসায় একা থাকতে পারে না। নানা ধরনের সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রাণীকল্যাণকে স্টাবলিশ করার চেষ্টা করি, সেটা আরও বাড়াতে চাই। ফারিঘর থেকে আয়ের কিছু অংশও প্রাণীকল্যাণে ব্যয় করা হবে।

মিরপুরে অবস্থিত ফারিঘরে কুকুরের জন্য তিনটি আর বিড়ালের জন্য ১৪টি ঘর আছে। কুকুরের জন্য তৈরি প্রতিটি ঘরের দৈর্ঘ্য নয় ফুট, প্রস্থ পাঁচ ফুট। বিড়ালের জন্য রয়েছে ১৬ বর্গফুটের আলাদা আলাদা কেবিন। এসব ঘরে বিছানা-বালিশ তো আছেই, একই সঙ্গে টয়লেট ব্যবহারের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। এছাড়া বিশেষ আদর-আপ্যায়নের পাশাপাশি ক্যাট্রি, কুশনের ব্যবস্থাও এখানে করা হয়েছে।

jagonews24

প্রাণীদের সময়মতো খাবার দেওয়া ও দেখভালের জন্য দুজন কর্মী রয়েছেন। সিসিটিভির মাধ্যমে সব সময় খোঁজ নেন উদ্যোক্তারা। এছাড়া যারা তাদের পোষা প্রাণী রেখে যান, তারাও যখন ইচ্ছে ভিডিওকল দিয়ে দেখতে পারেন। কোনো প্রাণী নিয়ে যাওয়া হলে সেই ঘরটি ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়। এছাড়া রোগ ও লড়াই এড়াতে এক প্রাণীর সংস্পর্শে অন্য প্রাণীকে আনা হয় না।

রাকিবুল হক এমিল বলেন, এখানে বিড়াল রাখার খরচ দিনে ৫০০ টাকা। কুকুরের জন্য দেড় হাজার টাকা। তবে বেশি দিন রাখলে গড়ে খরচটা কম হবে। সেক্ষেত্রে একটি বিড়াল পাঁচদিন রাখলে প্রতিদিনের জন্য ৪৭০ টাকা, ১০ দিন রাখলে ৪৫০ টাকা আর ২০ দিন রাখলে প্রতিদিন ৪০০ টাকা করে দিতে হবে। কুকুরের ক্ষেত্রেও একইভাবে কমতে থাকবে। তবে পোষ্যদের যতদিন রাখা হবে, ততদিনের জন্য পর্যাপ্ত খাবার নিয়ে যেতে হবে। ফারিঘর থেকে প্রাণীদের কোনো খাবার দেওয়া হয় না।

‘প্রাণী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার সম্মখীন হতে হয়েছে। সামাজিক কিছু সমস্যা আমাদের ফেস করতে হয়। টিটকিরি (উপহাস) করা হয়। অনেকের ধারণা কোনো মানুষকে দুইবেলা খাওয়ালে মানবকল্যাণ বা সমাজের কল্যাণ হয়। যেখানে মানুষই খেতে পায় না, সেখানে কুকুর-বিড়ালের জন্য হোটেল অনেকেই ভালো চোখে দেখে না। কিন্তু অনেকেই বুঝতে চায় না এটাও প্রয়োজন। যারা এখানে তাদের প্রাণী রেখে যায় তারা কোনো উপায় না থাকায় রেখে যায়। এটা লাক্সারি (বিলাসিতা) নয়।’

jagonews24

ফারিঘরের বিড়ালের কেবিনে ঘুরে দেখা যায় লুনা, ওডিস, মচি নামের বিড়ালগুলো গা এলিয়ে শুয়ে আছে। প্রতিটি কেবিনে বিড়ালের নাম, কতদিন থাকবে ও বিড়ালটি কী খায় তা কাগজে লিখে টাঙানো আছে। এখানে প্রাণী রাখতে হলে অভিভাবকদের জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি বা নাম্বার, কুকুর ও বিড়ালের ভ্যাকসিনেশনের রেকর্ড জমা দিতে হবে। প্রাণীর অন্য কোনো সমস্যা আছে কি না, আচরণ কেমন তা জানাতে হবে কর্মকর্তাদের।

রাকিবুল হক এমিল বলেন, আমরা গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে হোটেলের কার্যক্রম শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত ভালো সাড়া পাচ্ছি। এছাড়া হোটেলের নিচেই আছে প-ফাউন্ডেশনের লাইফ কেয়ার ক্লিনিক। কোনো প্রাণী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েলে তার তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

প্রাণীহত্যা বন্ধে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলের ওপর নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন এই উদ্যোক্তা। অ্যানিমেল ক্রয়েলটি ও হিউম্যান ভায়োলেন্স (প্রাণীর ওপর নিষ্ঠুরতা ও মানুষেরও পর নৃশংসতা) দুটোই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমাদের প-ফাউন্ডেশন এটা নিয়ে কাজ করছে। এখন পশুর ওপর অত্যাচার বন্ধে নতুন আইনও হয়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত কাজে লাগাতে হবে। সামাজিকভাবে মানুষকে স্থির করতে পারলে, মোরাল প্রোগ্রেসে (নৈতিক অগ্রগতি) কাজ করতে পারলে পশুর ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে বলে আমি মনে করি।

এসএম/ইএ/এএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।