সুপারিশ ছাড়া সেবা মেলে না ইসির প্রবাসী ডেস্কে

ইসমাইল হোসাইন রাসেল
ইসমাইল হোসাইন রাসেল ইসমাইল হোসাইন রাসেল
প্রকাশিত: ০৪:৪৬ পিএম, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২

যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সুজানা সুলতানা (ছদ্মনাম)। গত বছরের জুনে বাংলাদেশে এসে জাতীয় পরিচয়পত্রের জন্য আবেদন করেন। এরপর দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও তার আবেদনের অগ্রগতি হয়নি। মাঝে তিনি পুনরায় পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর আবার দেশে ফিরে আবেদনের স্থান যশোরে যেতে চাইলেও করোনার বিধিনিষেধের বাধ্যবাধকতায় তিনি আটকা পড়েন ঢাকায়। প্রবাসী ভোটারদের জন্য নির্বাচন কমিশনে একটি প্রবাসী ডেস্ক থাকলেও সেখানে গিয়ে সেবা পাননি তিনি। বলা হয়, মহাপরিচালকের সই ছাড়া সেবা মিলবে না। তার দপ্তরে গেলে দুর্ব্যবহারও করা হয়।

ভুক্তভোগী সুজানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি অনেক আগে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি। আমার বাবা-মা দুজনই বাংলাদেশি হলেও তারা এখন সেখানকার নাগরিক। যশোরে আমার আত্মীয়স্বজন সবাই আছেন। বাবা-মা ২০ বছর আগেই চলে গেছেন বলে তাদের কোনো ডকুমেন্টস সেভাবে নেই। আমার স্বামী বাংলাদেশি নাগরিক, সেটির ভিত্তিতেই আমি এখানকার এনআইডির জন্য গত জুনে আবেদন করেছিলাম। পরে কোনো আপডেট না পাওয়ায় আবার যুক্তরাষ্ট্রে চলে যাই। এরপর সম্প্রতি দেশে ফিরে যশোর (আবেদনের স্থান) যেতে চাইলে সরকারের বিধিনিষেধ দেখে আর যেতে পারিনি।’

তিনি বলেন, কয়েকদিন পরই আমার যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়ার ফ্লাইট রয়েছে। এর মধ্যে জানতে পারলাম নির্বাচন কমিশনে প্রবাসী ভোটারদের জন্য একটি ডেস্ক আছে। সেখানে গেলে বলা হয় মহাপরিচালকের স্বাক্ষর লাগবে, এছাড়া এ সংক্রান্ত সেবা দেওয়া যাবে না। পরে মহাপরিচালকের কাছে গেলে সেখানে থাকা ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মাজেদ আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। তিনি তখন আমাকে রেগে বলেন, ‘এখানে ইনফরমেশন জানার কিছু নেই।’ এরপর তিনি আমার কাগজপত্র ছুড়ে ফেলে দেন। তারপরও সমাধান করতে অনুরোধ করলে তিনি ক্ষেপে বলেন, ‘আমরা কী জানি?’

জানা যায়, দেশে ফেরা প্রবাসীদের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে ভোটার নিবন্ধন, সংশোধন ও হালনাগাদ শেষে স্বল্প সময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য বা অবহেলা সহ্য করা হবে না এবং হয়রানি বা অসদাচরণের প্রমাণ পেলে ‘কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ বলে মাঠ পর্যায়ে পাঠানো কমিশনের এক নির্দেশনায় বলা হয়েছিল। তবে বাস্তব চিত্র ভিন্ন। প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেবাপ্রত্যাশীরা। এমনকি খোদ এনআইডি মহাপরিচালকের দপ্তরেই দুর্ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা ফরিদ ও ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মাজেদ সেবা নিতে আসা প্রবাসীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। সেবাপ্রত্যাশীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ উঠলে মাজেদকে ২০১৭ সালে রাঙামাটিতে বদলি করা হয়। পরে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করে গত বছর আবার ইসিতে ফিরে আসেন। মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের অবহেলায় মাসের পর মাস কেটে গেলেও এনআইডি পান না প্রবাসীরা।

jagonews24

ইসিতে প্রবাসী ডেস্ক থাকলেও সেটির কাজ বন্ধ কি না জানতে চাইলে ইসির সহকারী প্রোগ্রামার মো. শাহাবুদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, প্রত্যেক উপজেলায় এই সার্ভিসটা দেওয়া আছে প্রবাসীদের স্পেশাল সার্ভিস দেওয়ার জন্য। তাই ইসির প্রবাসী ডেস্কটি ভিআইপিদের জন্য রাখা হয়েছে। রেফারেন্স ছাড়া এখানে সেবা দেওয়া হয় না। রেফারেন্সে যেসব প্রবাসী আসে তাদের সেবা আমরা দিচ্ছি। আগে কেউ এলে এই ডেস্ক থেকেই তাকে বিস্তারিত তথ্য দিতাম, এরপর নিয়ম অনুসারে সেবাপ্রার্থী যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করলে তার কাজটি করা হতো। একই সার্ভিস উপজেলা পর্যায়েও দেওয়া হচ্ছে। তাই এখানে মহাপরিচালক স্যারের অনুমতি ছাড়া কাউকে সেবা দেওয়া হয় না।

এনআইডির কর্মকর্তারা বলছেন, প্রত্যেক উপজেলা নির্বাচন অফিসে চিঠি দিয়ে প্রবাসীদের স্পেশাল সার্ভিস দেওয়ার জন্য বলা আছে। এখন প্রবাসীদের প্রথমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সম্পর্কে জেনে সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাচন অফিসে জমা দিতে হয়। সেজন্য প্রয়োজনীয় কাগজসহ থানা নির্বাচন অফিসে গেলে আবেদনের ভিত্তিতে ছবি তুলে আঙুলের ছাপ নেওয়া হয়। পরে তদন্ত প্রতিবেদনসহ সেটি আপলোড করলে কাজটি সম্পন্ন হয়। কিন্তু ইসির প্রবাসী ডেস্কে কেউ এলে মহাপরিচালকের সই নিয়ে ছবি তোলার পর তদন্তের জন্য বলা হয় থানা নির্বাচন অফিসকে। তারা তদন্ত প্রতিবেদন পাঠালে সে অনুযায়ী কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, উপজেলা নির্বাচন অফিসগুলোতে গেলে হয়রানির শিকার হতে হয়। মাসের পর মাস গেলেও সেখান থেকে প্রতিবেদন দেওয়া হয় না বিধায় পরিচয়পত্র পাওয়া যায় না। ফলে অল্প সময়ের জন্য দেশে এলেও শুধু এই পরিচয়পত্রের কাজেই প্রায় পুরো সময় চলে যায়।

ওমান থেকে দেশে ফেরা সামসুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকার শ্যামলীতে আমার বাসা, গ্রামের বাড়ি রংপুর। দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থাকি, তাই এনআইডি কার্ড নেওয়া হয়নি। শুনেছিলাম নির্বাচন কমিশনের ঢাকা অফিসে প্রবাসী ডেস্কে সেবা পাওয়া যাবে। কিন্তু এখন দেখছি মহাপরিচালকের সই ছাড়া কোনো সেবাই মিলছে না। আমাকে তো তার অফিসে ঢুকতেই দিলো না, এখন সই পাবো কোথায়? আমাকে যেতে হবে সেই রংপুর। অথচ সেবাটা এখান থেকে পেলে দেশে থাকার সময়টা পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারতাম। এখন তো দেখছি নির্বাচন অফিস ঘুরতেই ছুটি শেষ হয়ে যাবে। এভাবে হয়রানি করার মানেই হয় না।

jagonews24

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইসি সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, বিদেশে যেসব নাগরিক আছেন তারা দেশে এলে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের কাজ করে দেই। সাপোর্টিং পেপারস থাকলেই আমরা করে দেই।

ইসির প্রবাসী ডেস্ক এখন শুধু ভিআইপিদের জন্য ব্যবহার করা হয়- এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য বিদায়ী নির্বাচন কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, এটা কমপ্লিটলি ইসি সচিবালয়ের কাজ। আমরা শুধু কমিশনে যেগুলো উত্থাপিত হয় সেগুলোর ওপর সিদ্ধান্ত দিতাম। সেগুলোর সম্পর্কে মাঝে-মধ্যে আমাকে অবহিত করা হয়। ফলে এ ব্যাপারে না জেনে কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন (এনআইডি) অনুবিভাগের মহাপরিচালক এ কে এম হুমায়ূন কবীর জাগো নিউজকে বলেন, প্রবাসীদের তো আমরা টপ প্রায়োরিটি (প্রাধান্য) দিচ্ছি। কিছু ভিআইপি সার্ভিস আছে, তাদেরও সেবা দিচ্ছি। ঢাকায় তো সাত-আটটি থানা নির্বাচন অফিসই আছে। সেখান থেকে করিয়ে নিতে পারে। যদি সেখানে কোনো সমস্যা হয় তাহলে আমরা তাদের আরও ইনস্ট্রাকশন (নির্দেশনা) দেবো।

তথ্য জানতে ডিজির দপ্তরে গেলে দুর্ব্যবহার করা হয়- এ বিষয়ে জানতে চাইলে হুমায়ূন কবীর জাগো নিউজকে বলেন, এটা আপনার কাছে প্রথম শুনলাম। তথ্যের কারণে আমার সঙ্গে দেখা করার দরকার নেই। প্রবাসী ডেস্ক আছে, সেখানেও যেতে পারে। গতকালও ডেস্কে বলেছি যে আপনারা ডেস্ক থেকে তাদের (প্রবাসী) অ্যাডভাইস দেবেন, তাদের ডিমান্ড ফুলফিলে (কাজ সম্পন্নে) যেখানে আটকে যাবেন সেখানে আমাকে ইনভলভ করবেন। আমি এতসংখ্যক ভিজিটর অ্যালাউ করলে আমার আবার করোনা হবে।

আইএইচআর/ইএ/এএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।