‘উপন্যাস লিখেও শেষ হবে না দুঃসহ সেই স্মৃতি’


প্রকাশিত: ১০:১৫ এএম, ১১ জানুয়ারি ২০১৬

ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পার হলেও সেই বিভীষিকাময় রাতের কথা ভুলতে পারছেন না পুলিশের নির্যাতন ও হয়রানির শিকার বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী। দুঃসহ সেই স্মৃতি প্রতি মুহূর্তে তাড়া করে ফিরছে তাকে। নিজের বেঁচে থাকাটাই তার কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছে।

আজ (সোমবার) দুপুরে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের সহকারী কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী বলেন, “সুস্থ দেহে বেঁচে ফিরবো এমনটা কল্পনাও করিনি। বার বার চোখের সামনে বাবা-মায়ের মুখটা ভেসে উঠছিল। সেই বিভীষিকাময় রাতের দুঃসহ স্মৃতি দশ পনেরটি উপন্যাস লিখেও শেষ করা যাবে না।”

রাব্বী বলেন, জীবনে যে কখনও সিগারেট পর্যন্ত স্পর্শ করেনি তাকে পুলিশ মাদক ব্যবসায়ী সাজানোর অপচেষ্টা করছিল। আবার কখনো অস্ত্র মামলার আসামি সাজিয়ে ক্ষণে ক্ষণে গুলি করে হত্যার হুমকি দিচ্ছিল মোহাম্মদপুর থানার সাব ইন্সপেক্টর মাসুদ। ব্যাংক কর্মকর্তা শুনে নগদ পাঁচ লাখ টাকা এনে দিলে প্রাণে বাঁচতে পারবো বলে শাসানো হচ্ছিল। এ অবস্থায় আল্লাহর কৃপায় নতুন জীবন পেয়েছি।

এক সাক্ষাৎকারে ব্যাংক কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম কর্মী (সময় টেলিভিশনের এক সময়ের সংবাদ উপস্থাপক) গোলাম রাব্বী সেই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সে দিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বন্ধু আমাকে মোহাম্মদপুর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। সেখানে এক আন্টির বাসায় রাতে খাবার খেয়ে হেঁটে কলেজ গেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। রাত তখনও গভীর হয়নি। আনুমানিক ১১টার মতো বাজে। রাস্তায় অনেক লোকজনও ছিল। বেশ কিছু দোকানপাটও খোলা ছিল। একাই হেটে কলেজ গেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সেখান থেকে গাড়িতে ওঠে কল্যাণপুর বাসায় ফিরবো বলে মনস্থির করেছিলাম।

কিন্তু হঠাৎ করে পুলিশে গাড়ি এসে আমাকে আটক করে। আটক করার পর পরই ২০/২৫ জন লোক আশেপাশে জড়ো হয়। আমার বেশভূষা দেখে তারা পুলিশকে ছেড়ে দিতে অনুরোধও জানালেও পুলিশ তাতে কর্ণপাত করেনি।

গণমাধ্যম কর্মী কিংবা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নয়, দেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বলতে চাই এ ধরনের পুলিশ কর্মকর্তার নিরাপত্তার দায়িত্বে দেখতে চাই না। এ ধরনের কর্মকর্তার কারণে গোটা পুলিশ প্রশাসনের দুর্নাম হয়।

তিনি জানান, আটকের পর তাকে নিয়ে এসআই মাসুদ মোহাম্মদপুর এলাকায় গাড়ি নিয়ে চক্কর দিতে থাকে। প্রথমে তাকে বলা হয় ৫৪ ধারায় আটক দেখিয়ে মামলার আসামি করা হবে। এক পর্যায়ে এসআই মাসুদ বলেন, ‘পুলিশের ক্ষমতা কী জিনিস বুঝস, তোকে মাদক ব্যবসায়ী বানাবো, গুলি করবো, কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো তুই পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নিতে চাইছিলি। তোর আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে তাড়াতাড়ি টাকা নিয়ে আসতে বল। বেশি মানুষ আসলে তোর খবর আছে।’

রাব্বী আরো জানান, সঠিকভাবে মনে করতে না পারলেও তাকে যখন আটক করা হয় তার পূর্বমুহূর্তে তিনি কাউকে টেলিফোন করে খবরটি দিয়েছিলেন। এরপর পরই তার টেলিফোন, মানিব্যাগ ইত্যাদি কেড়ে নিয়েছিল পুলিশ। খবর পেয়ে বন্ধু-বান্ধবসহ অন্যান্যরা বার বার টেলিফোন করলে সে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে এবং বলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, আইজি এলেও তোকে বাঁচাতে পারবে না।

এসআই মাসুদ বার বার বলছিল, কোনো পুরুষ নয়, সম্পর্কে তোর খালা, ফুফু, চাচি হয় এমন কাউকে টাকা নিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে আসতে বল, তারা এসে তোকে মুচলেকা দিয়ে নিয়ে যাবে, টাকা না আনলে তোর কপালে খারাপি আছে।

আতঙ্কগ্রস্ত কণ্ঠে রাব্বী বলেন, গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে বিভিন্ন সময় পুলিশি নির্যাতনের খবর পড়েছি, জেনেছি, সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছি কিন্তু বাস্তবে যখন এমন ঘটনার শিকার হলাম তখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম কিভাবে নিরীহ মানুষ পুলিশের হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হয়।

সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে রাব্বী তার বিপদে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ও মানবাধিকার সংস্থা শীর্ষ কর্মকর্তারা এগিয়ে আসায় গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, কেউ যেন তার মতো এমন নির্যাতন ও হয়রানির শিকার না হন। এটাই প্রত্যাশা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজনের নাম মাসুদ রানা। তিনি মোহাম্মদপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) বাকিরা তাদের নেইম প্লেট খুলে ফেলায় তাদের নাম জানা যায়নি।

এ ব্যাপারে এসআই মাসুদের পাল্টা অভিযোগ, মোহাম্মদপুর বিহারী ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার সময় তার চলাফেরায় সন্দেহ হয়। এ সময় তল্লাশি করতে চাইলে তিনি বাধা দেন। পরে তাকে থানায় নিতে চাইলে তিনি বাকবিতণ্ডায় জড়ান। মারধরের অভিযোগও অস্বীকার করেন তিনি।

রেডিও ধ্বনির সাংবাদিক জাহিদ হাসান জানান, ‘রাব্বীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। ও আমাকে জানিয়েছে, রাস্তায় কয়েকজন লোক শার্টের কলার জাপটে ধরে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। ‘পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওরা বলছিল ‘স্যারের সঙ্গে কথা আছে চল’ বলেই পেছনে দাঁড়ানো চার-পাঁচজন পুলিশ সদস্য দৌড়ে এসে টেনে-হিঁচড়ে পিকআপ ভ্যানে তোলার চেষ্টা করে।

এসময় তারা গোলাম রাব্বীকে উদ্দেশ্য করে বলেছে ‘মাল কঠিন, শেষ করে দাও’; ‘জিনিস কঠিন, ফেলে দাও’! এরপর বিহারী ক্যাম্পসহ বেশ কিছু জায়গায় ভ্যানে করে তাকে ঘুরিয়ে আসাদ গেইটে নিয়ে যায়।

খবর পেয়ে আমিসহ তিনজন আসাদ গেইট যাই। আমাদের দেখে ওরা পিকাআপ ভ্যান আবারো টান দেয়। আড়ং থেকে আসাদ গেইট এলাকায় যানজটে আটকা পড়ে পুলিশ ভ্যান। এরপর উদ্ধার করতে গেলে রাব্বীর কাছে গাঁজা, হিরোইন পাওয়া গেছে বলে দাবি করে। বিভিন্ন কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাত ১টার দিকে তাকে ছেড়ে দেয়।

এ ব্যাপারে তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব কুমার সরকার বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন গোলাম রাব্বী।

প্রসঙ্গত, মারধরের শিকার গোলাম রাব্বী বাংলাদেশ ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। জাগো নিউজের চাকরির পাতায়ও নিয়মিত লেখেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ ছাত্র এক সময় ‘সময় টেলিভিশন’র সংবাদ উপস্থাপক হিসেবেও কাজ করেছেন।

এমইউ/আরএস/পিআর/আরআইপি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।