মনিটরিং না থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণে নেই

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫৩ পিএম, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২
দিনে দিনে দীর্ঘ হচ্ছে টিসিবির লাইন/ ইনসেটে ওপরে ড. এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ও নিচে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

ট্রাকে চাল-ডাল বা ভোজ্যতেলের বোতল হাতে দাঁড়িয়ে বিক্রেতা। নিচ থেকে বাড়ানো অসংখ্য হাত। অল্প দামে পণ্য বিক্রির সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকের পাশে দাঁড়ালে এমন চিত্রই এখন চোখে পড়ে। ট্রাক ঘিরে যেন জনসমাবেশের মতো ভিড় জমে যায়। এই সমাগমগুলো যেন হয়ে উঠেছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের চিড়েচ্যাপ্টা হওয়ার প্রতীকী চিত্র।

একদিকে আয় কমে যাওয়া আরেক দিকে লাফিয়ে লাফিয়ে খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। কিছুতেই হিসাব মেলাতে পারছে না সাধারণ মানুষ। সবচেয়ে কষ্টে দিন যাচ্ছে স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের। সামনে রমজান, তার আগেই নিত্যপণ্যের এমন মূল্যবৃদ্ধি উদ্বিগ্ন করছে সবাইকে। যদিও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের কিছুই করার নেই বলে জানিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি।

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসলে সরকার কী করতে পারে, কী হতে পারে ব্যবসায়ীদের ভূমিকা- এ বিষয়ে মতামত দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

‘গরিব-মধ্যবিত্ত ভালো নেই’

জাগো নিউজ: দ্রব্যমূল্য বাড়ছে হু হু করে। বাজার পরিস্থিতি নিশ্চয় পর্যবেক্ষণ করছেন?

এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: মানুষ যে অবস্থায় জীবনযাপন করছে, তা কষ্টের সীমা অতিক্রম করছে। বিশেষ করে যারা নিম্নবিত্ত বা দারিদ্র্যসীমার নিচে, তাদের সহনীয় মাত্রা বহু আগেই অতিক্রম করেছে। ক্রয়ক্ষমতা না থাকলে যে কোনো পর্যায়ের মানুষের জন্যই জীবনযাপন দুরূহ হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ভয়াবহ পর্যায়ে নেমেছে।

জাগো নিউজ: কিন্তু সরকার তো বলছে, মূল্যস্ফীতি কমছে। দাম বাড়লেও সহনীয় পর্যায়ে আছে...

এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: হ্যাঁ, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমেছে। সম্ভবত ৫ দশমিক ৮২ ছিল গত মাসে, এমনটি বলছে সরকার। এটি একটি মজার ব্যাপার। বাজার ঊর্ধ্বমুখী। এই পরিস্থিতিতে মূল্যস্ফীতি কী করে কমে আসে, তা বুঝতে পারছি না। এ কারণেই আমি মনে করছি, সরকারের দেওয়া তথ্য গ্রহণযোগ্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকার আসলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

জাগো নিউজ: সরকার টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিতরণ করছে…

এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: টিসিবির মাধ্যমে যে পরিমাণ পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে, তা একেবারেই অপ্রতুল। এর মধ্য দিয়ে বাজারের দাম কমানো কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। যারা কিনতে পারছেন তারা হয়তো কিছুটা রক্ষা পাচ্ছেন।

জাগো নিউজ: এমন পরিস্থিতির জন্য কোন কারণ দায়ী করা যায় প্রধানত?

এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: এখনকার জন্য আমি বলবো, বিশ্ববাজারে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়েছে। ফলে আমদানিনির্ভর পণ্যের দাম বাড়ছে। উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। উৎপাদন কমছে। যে কারণে ক্রয়মূল্য নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে মনিটরিং না থাকার কারণেই বাজার আর নিয়ন্ত্রণে নেই।

জাগো নিউজ: আপনি বলছেন উৎপাদন কমছে। কিন্তু সরকার তো বলছে, কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ছে...

এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: এই পরিসংখ্যান বিশেষত অগ্রহণযোগ্য, প্রশ্নবিদ্ধ। আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম তখন দেখেছি, তিনটি সূত্র থেকে তথ্য আসতো এবং বিশাল ব্যবধান থাকতো প্রতি সূত্রেই। এ কারণে উৎপাদন আসলে কী পরিমাণ হচ্ছে, আর চাহিদা কতটুকু তা সঠিকভাবে উপস্থাপন হয় না। এজন্যই তথ্যের ঘাটতি থেকে যায়।

jagonews24জাগো নিউজ: মাথাপিছু আয় বাড়ছে, যা নিয়ে সরকার উচ্ছ্বসিত...

এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: গড় আয় বাড়ছে। এর মানেই এই নয় যে সবার আয় বাড়ছে। সরকারের বিশেষ সুবিধায় কারও কারও আয় হাজারগুণ বেড়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ লোকের আয় কমেছে। এই গড় আয় দিয়ে রাষ্ট্রের সব মানুষের আয় নিরূপণ করা বোকামি। গরিব মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে, তারা কী কিনতে পারছে, তা মনিটরিং করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

জাগো নিউজ: তাহলে সামনে কী হবে? আপনার পরামর্শ?

এ বি এম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমি মনে করি, এখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়নি যে মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যাবে। তবে গরিব, মধ্যবিত্ত ভালো নেই, এটি যে কেউ বুঝতে পারে।

সরকারের মনিটরিং জোরদার করতে হবে। বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আর উপায় থাকবে না। প্রয়োজনে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভ্যাট, ট্যাক্স কমিয়ে দাম নাগালের মধ্যে আনতে হবে।

‘এমপি-মন্ত্রী সবাই ব্যবসায়ী হলে গরিবের ভাবনা গুরুত্ব পায় না’

জাগো নিউজ: ভোজ্যতেলের লিটার প্রায় ১৭০ টাকা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে ক্রমাগত। পর্যবেক্ষণ করছেন নিশ্চয়ই...

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: বাংলাদেশে সব সময়ই বাজার মনিটরিং হতো। এখন কোনো মনিটরিং নেই। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন হলে মনিটরিং জোরদার হয়। ঈদ, রোজা ও পূজা উপলক্ষে তখন কোনো পণ্যের দাম বাড়েনি। মনিটরিং ছিল। এখন দাম বাড়ছে হু হু করে।

সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, রমজানে পণ্যের দাম বাড়বে না। অথচ ইতোমধ্যে যে দাম বাড়ানো হয়েছে তা মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। রমজানে আর বাড়ানোর দরকার পড়বে না ব্যবসায়ীদের। আমি মনে করি, দ্রব্যমূল্য নিয়ে সরকারের লোকেরাই দায়িত্বশীল কথা বলছেন না।

জাগো নিউজ: সাধারণ মানুষের কষ্টটা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: সাধারণ মানুষ এই দেশ স্বাধীন করেছে। দেশের সব অর্জনে সাধারণ মানুষের ভূমিকা বেশি। বঙ্গবন্ধু সব সময় সাধারণ মানুষের জন্য কান পেতে রাখতেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও সাধারণ মানুষের জন্য কল্যাণরাষ্ট্র গড়তে চান। সরকারের আর কারও মধ্যে এই দায় কাজ করে কি না জানা নেই।

jagonews24প্রধানমন্ত্রী যাদের নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাদের বোঝাতে হবে, বুঝতে হবে দেশটা সবার। সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস হলে সমাজ-রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবে চলে না।

দাম বাড়লে লাভ হয় ব্যবসায়ীর। ব্যবসায়ীরা ইতোমধ্যে লাভবান হয়ে গেছেন বহুগুণে। অনেক বৈষম্য তৈরি করে ধনী হয়েছেন। আর বৈষম্য বাড়তে দেওয়া যায় না। ধনীর সংখ্যা না বাড়িয়ে এবার গরিবের জন্য ভাবুন।

জাগো নিউজ: আপনি ১৯৯৬ সালের কথা বললেন। ২০০৮ সালের পর শেখ হাসিনার সরকার তিনবার ক্ষমতায়। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কি ব্যর্থতার প্রশ্ন আসে?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: ব্যর্থ এখনো বলা যাবে না। ১০ টাকায় চাল বিক্রি অবাস্তব। টিসিবির মাধ্যমে কিছুটা কম মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। ১৯৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়। এরপরও পণ্যের দাম এক টাকা পর্যন্ত বাড়েনি। আমরা তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ ছিলাম। মনিটরিং ছিল। হস্তক্ষেপ ছিল।

এখন ধান কাটার পরেই দাম বাড়ছে। অবিশ্বাস্য। হাজার হাজার টন মজুত করে রাখছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের কাছে বিক্রি করছেন না। এই সাহস কোথা থেকে পান তারা? সরকারের খাদ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী সবাই ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীদের মধ্য থেকেই কেন সবাইকে আসতে হবে? এমপি-মন্ত্রী সবাই ব্যবসায়ী হলে গরিবের ভাবনা গুরুত্ব পায় না।

সমাজে আরও মানুষ আছে। নিঃস্বার্থভাবে অনেকেই জনসেবা করে যাচ্ছেন। তাদের কেন গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। কারা দেশের জন্য নিবেদিত, কারা কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য কাজ করতে পারেন, সেদিকটা মনে হয় আরেকটু ভাবার সময় এসেছে। অন্তত বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার কাছে মানুষের প্রত্যাশা এটি। তার ওপর মানুষের ভরসা আছে। তার বিকল্পও নেই এখন।

জাগো নিউজ: তাহলে কি সরকারের মধ্যে আরেক সরকার অধিক সক্রিয়?

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: সরকারের মধ্যে একটি অংশ তো আছেই, যারা ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকতে চায় বিশেষ সুবিধার জন্য। দলের মধ্যেও আছে। প্রধানমন্ত্রী এটি বোঝেন অবশ্যই। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রী নজরদারি বাড়িয়ে আরেকটু শক্ত অবস্থান নিলেই সাধারণ মানুষ উপকৃত হবেন।’

এএসএস/এইচএ/জিকেএস

সরকারের মনিটরিং জোরদার করতে হবে। বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তুলতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আর উপায় থাকবে না

১৯৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হয়। এরপরও পণ্যের দাম এক টাকা পর্যন্ত বাড়েনি। আমরা তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের অংশ ছিলাম। মনিটরিং ছিল। হস্তক্ষেপ ছিল

এখন ধান কাটার পরেই দাম বাড়ছে। অবিশ্বাস্য। হাজার হাজার টন মজুত করে রাখছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের কাছে বিক্রি করছেন না। এই সাহস কোথা থেকে পান তারা? সরকারের খাদ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী সবাই ব্যবসায়ী

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।