হবিগঞ্জ শিশু পরিবারে অনিয়ম ও এতিমদের নির্যাতনের অভিযোগ


প্রকাশিত: ১১:১৫ পিএম, ০৯ জানুয়ারি ২০১৬

হবিগঞ্জ সরকারি শিশু পরিবারে চরম অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। স্যানেটারি সংস্কার থেকে শুরু করে এতিম শিশুদের খাবারের টাকাও আত্মসাত হচ্ছে। নোংড়া পরিবেশে বেড়ে উঠছে এতিমরা। এমনকি প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এসব অসহায় শিশু। আর সবকিছুর পেছনেই হাত রয়েছে জেলা সমাজসেবা অফিসের অতিরিক্ত দায়িত্বরত উপ-পরিচালক মো. সোয়েব হোসেন চৌধুরীর।

অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিজের ব্যবহৃত সরকারি গাড়িটি ধোয়ামোছার কাজও করান এসব শিশুদের দিয়েই। শুধু তাই নয়, তার কথার ব্যত্যয় হলে শিশু পরিবারটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গেও তিনি অসদাচরণ করেন। অপদস্ত করেন শিশুদের সামনেই। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। এসব বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এমন লোমহর্ষক তথ্য জানিয়েছে শিশু পরিবারে বসবাসরত এতিমরা।

জানতে চাইলে জেলা সমাজসেবা অফিসের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. সোয়েব হোসেন চৌধুরী সব অভিযোগ অস্বীকার করে জাগো নিউজকে জানান, অতীতে শিশুদের নির্যাতনের বিষয়টি তিনি জানেন না। তার গাড়ি চালক আবু সালেহ বকুল কেন শিশুদের নির্যাতন করেছিল এ বিষয়ে তার কৈফিয়ত তলব করা হয়েছে।

তিনি বলেন, গত বছর স্যানেটারিসহ সবকিছু যথাযথভাবেই সংস্কার করা হয়েছে। যখনই কোনো সমস্যা হয় তা সংস্কার বা পরিচ্ছন্ন করে দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীকে অপদস্ত করার বিষয়ে তিনি বলেন, সে রাতে বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তখন আমরা খবর পাই সে প্রতিষ্ঠানের মালামাল সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। পরে রাত ১১টার দিকে গিয়ে তার ব্যাগ তল্লাশি করে কিছু পাইনি। আমি অফিসে নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে না যাওয়ায় শিশুদের সামনেই তল্লাশি করতে হয়েছে।

শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সোয়েব হোসেন চৌধুরীর একক কতৃত্বেই চলছে এ প্রতিষ্ঠানটি। নিজের অফিসে গাড়ির গ্যারেজ থাকা সত্ত্বেও তিনি গাড়িটি রাখেন শিশু পরিবারে। তার ধোয়ামোছার কাজও করান এতিম শিশুদের দিয়েই। স্যানেটারি সংস্কারের নামে আত্মসাত করা হয়েছে বিপুল অংকের টাকা। মূলত কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রতিটি টয়লেটেরই ফ্ল্যাসার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। গোসল করার পানি আসে না টেপগুলো দিয়ে। কমোডগুলো পানিতে ভরে উপচে মেঝে ছাড়িয়ে বারান্দা পর্যন্ত গড়িয়েছে। ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। ছাতা নিয়ে যেতে হয় টয়লেটে। এসব টেপের পানিই তাদের পান করতে হয়।

আর মারধরতো নিত্যদিনের ঘটনা। যেকোনো কিছুতেই এসব এতিমদের উপর খড়গ নেমে আসে। গাড়ির গ্যারেজে কেন তাদের খেলার বল পড়লো, কেন তারা বাইরের লোকদের সঙ্গে কথা বললো, এমন সামান্য কিছুর ছুতোয়ই তাদের মারপিট করা হয়। আর এমন নির্যাতন করে সোয়েব হোসেন চৌধুরীর গাড়িচালক আবু সালেহ বকুলসহ কতিপয় কর্মচারী।

বৃহস্পতিবারও গাড়ির গ্যারেজে বল পড়ার অপরাধে শাহ আলম নামে এক শিশুকে পিটিয়েছেন বকুল। এর আগে প্রহার করা হয় সাদমান নামে আরও একজনকে। এসব বিষয়ে তারা স্থানীয় সংসদ সদস্যকেও অবহিত করেছেন। তবে এসব শিশুদের এখান থেকে বের করে দেয়া হতে পারে এমন ভয়ে তারা তেমন কিছু বলতে চায় না।

ওইদিনই রাতে অপদস্ত করা হয় শিশু পরিবারের বড় ভাইয়া (কর্মচারী) মো. রাশেদুর রহমানকে। তিনি স্ত্রীসহ বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাত ১১টার দিকে তিনি অটোরিকশায় উঠতে চাইলে সোয়েব হোসেন চৌধুরীসহ আরও দুই কর্মকর্তা তাকে দাঁড় করান। জানতে চান তিনি নাকি প্রতিষ্ঠানের মালামাল নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। তাকে আড়ালে নিয়ে তিনি কথা বলার প্রস্তাব দেন। তাতে তিনি রাজি না হওয়ায় শিশুদের সামনেই তার ব্যাগ তল্লাশি করেন। ক্ষোভে তিনি বাড়ি যাওয়া বাতিল করেন।

এদিকে শিশু পরিবারে সোয়েব হোসেন চৌধুরীর এমন অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিকার চেয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ইতিপূর্বে জেলা প্রশাসকের বরাবর একটি স্মারকলিপিও দিয়েছেন।

স্থানীয় বাসিন্দা আবরু মিয়া হেলাল জাগো নিউজকে জানান, শিশুদের যে নির্যাতন করা হয় তা দেখে তাদের অনেক সময় সহ্য হয় না। তাদের খাবার, তাদের বাসস্থান মেরামত, টয়লেট মেরামতে অনিয়ম হয়। তাদের গোসলের ব্যবস্থা নেই। তারা বাইরে এসে পুকুরে গোসল করে।

এ বিষয়ে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে স্মারকলিপি দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, মাঝখানে শুনেছি সোয়েব হোসেন চৌধুরী বদলি হয়েছেন। কিন্তু ৩/৪ দিনের মাঝেই শুনি তিনি বহাল তবিয়তে আছেন। কী করে ঠেকালেন তা-ও জানি না। স্থানীয় লোক হওয়ায় তিনি এখানে একচ্ছত্র আধিপত্য খাটান।

এ ব্যাপারে বড় ভাইয়া (কর্মচারী) মো. রাশেদুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, কেন তাকে এমন অপদস্ত করা হয়েছে সে জন্য তিনি সোয়েব হোসেন চৌধুরীর কাছে বিচার চেয়েছেন। বাড়ি চলে গেলে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ দাঁড় করানো হতে পারে এমন আশঙ্কায় তিনি যাননি। শিশুদের নির্যাতনসহ অনিয়মের কথা তিনি স্বীকার করেন।

শিশু পরিবার সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে শহরতলীয় বড়বহুলা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় সরকারি শিশু পরিবার। বর্তমানে এখানে ৯৮ জন এতিম শিশু রয়েছে। তারা বিভিন্ন স্কুল-কলেজে পড়াশুনা করছে। এখানে উপ-তত্ত্বাবধায়ক পদটি শূন্য রয়েছে। শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ দায়িত্ব পালন করছেন। এমএলএসএস আছে ছয়জন, বড় ভাইয়া (তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী) আছে তিনজন, কারিগরি প্রশিক্ষক আছেন একজন। সহকারী তত্ত্বাবধায়ক, কম্পিউটার অপারেটর ও অফিস সহকারীর পদ শূন্য রয়েছে।

জেলা সমাজসেবা অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সাল থেকে সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার পদে কর্মরত আছেন মো. সোয়েব হোসেন চৌধুরী। একই সময় থেকে তার স্ত্রী জাহানারা পারভীনও জেলা সমাজসেবা অফিসে রেজিস্ট্রেশন অফিসার পদে কর্মরত আছেন।

২০১৪ সালের জানুয়ারিতে সোয়েব হোসেন উপ-পরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব পান। এরপর থেকে তিনি শিশু পরিবারের সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যান। শেষ পর্যন্ত গত ১৩ ডিসেম্বর তাকে ও তার স্ত্রীকে একইসঙ্গে বদলি করা হয়।

১৭ ডিসেম্বর নতুন অফিসারের নিকট দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার কথা। সে অনুযায়ী নতুন কর্মকর্তা এখানে আসেনও। কিন্তু ওইদিন দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়ার আগেই আকস্মিকভাবে তার ও তার স্ত্রীর বদলি স্থগিতের আদেশ আসে।

সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/বিএ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।