শৈবালচাষে সমৃদ্ধ সুনীল অর্থনীতির হাতছানি
বঙ্গোপসাগর। বাংলাদেশের সামুদ্রিক পরিচয়। এই বিশাল জলরাশি দেশের সুনীল তথা সামুদ্রিক অর্থনীতিরও মূল উৎস। বিশাল সমুদ্রের অন্যতম রহস্য সি-উইড বা শৈবাল। কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে এই শিল্পের উল্লেখযোগ্য অবস্থান না থাকলেও এখন ধীরে ধীরে এর প্রসার ঘটছে। এরই মধ্যে শৈবাল দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য স্থানীয় বাজারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর খাদ্যপণ্যের পাশাপাশি শৈবাল দিয়ে অন্যান্য পণ্যও তৈরি করা হয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত এসব পণ্য দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি আগামীতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও বিশাল অবদান রাখবে বলে আশাবাদী সংশ্লিষ্টরা।
শৈবালশিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শৈবালের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিলাভের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এর বিশাল বাজার আছে। শৈবালের তৈরি পণ্য বিদেশে রপ্তানি এবং দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। পুষ্টিগুণ বিবেচনায় শৈবালের চাষাবাদ কৌশলও ঠিক করা হয়েছে। এর বিদেশি বাজার ধরতে রপ্তানি আরও বাড়ানো হবে। বর্তমানে বিক্রির জন্য শৈবালের পাঁচটি পণ্য রয়েছে।
মানুষের কাছে এসব পণ্য পরিচিত করতে কক্সবাজারে শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) থেকে দুই দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়েছে। এই মেলায় আগত পর্যটকদের সি-উইড বা শৈবালপণ্যের সঙ্গে পরিচিত করতে বিনামূল্যে কিছু পণ্য বিতরণ করবে কর্তৃপক্ষ।
শৈবাল কী
সি-উইড বা সামুদ্রিক শৈবাল সাধারণত সাগর বা নদীর তলদেশে (ইন্টার-টাইডাল জোন) জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী স্থানে জন্মায়। এটি শেকড়, পাতা, ফুল ও ফলবিহীন উদ্ভিদ, যা সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং সূর্যালোককে কাজে লাগিয়ে প্রয়োজনীয় জৈব রাসায়নিক পদার্থে রূপান্তর করে অক্সিজেনকে উপজাত হিসেবে উৎপন্ন করে। শৈবাল বিভিন্ন শক্ত অবলম্বনের (বালি, কাদা, শেকড়, খোলস, পাথর, কোরাল ইত্যাদি) সঙ্গে লেগে থাকে এবং বৃদ্ধি লাভ করে।
প্রকৃতিতে মূলত তিন ধরনের (লাল, বাদামি এবং সবুজ) শৈবাল দেখা যায়। সামুদ্রিক আগাছা হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমান বিশ্বে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জলজ সম্পদ। অধিক পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ হওয়ায় বহুকাল আগে থেকেই সরাসরি সালাদ, মসলা ও সবজি হিসেবে উন্নত দেশে শৈবালের ব্যবহার হয়ে আসছে। এছাড়া ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য, ওষুধ, আগার, কারাজিনানসহ বিভিন্ন দ্রব্যের উপজাত হিসেবে শৈবালের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে।
শৈবালপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে গবেষণা
জানা গেছে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শৈবালপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে গবেষণার কাজ চলছে। ‘বাংলাদেশ উপকূলে সি-উইড চাষ এবং সি-উইডজাত পণ্য উৎপাদন গবেষণা’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে কক্সবাজার, পটুয়াখালী এলাকায় এ গবেষণা চলছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের (কক্সবাজার) বিজ্ঞানীরা ২০১৩ সাল থেকে শৈবাল নিয়ে কাজ করছেন। এরই মধ্যে তারা ১৪৩ প্রজাতির সি-উইড বা শৈবাল শনাক্ত ও সংরক্ষণ করেছেন। চিহ্নিত এসব শৈবালের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ২৩ প্রজাতি পাওয়া যায়। এসব বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির সঠিক চাষ প্রক্রিয়া নিশ্চিতের নিরীখে বর্তমানে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন। এরই মধ্যে ছয় প্রজাতির শৈবালের সব চাষ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। এছাড়া চাষকৃত এসব শৈবাল ব্যবহার করে বিভিন্ন ভ্যালু অ্যাডেড পণ্য প্রস্তুত করার লক্ষ্যে বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন।
গবেষকরা বলছেন, পুষ্টিগুণ এবং ঔষধি গুণাগুণ বিচারে শৈবাল একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ। শৈবালজাত পণ্য ব্যবহারে মানুষের শরীরে পুষ্টির ভারসাম্য বজায় থাকে। এছাড়া এর রয়েছে ফার্মাসিউটিক্যালস, মেডিসিনাল ব্যবহারসহ আরও বিভিন্ন ধরনের ব্যবহার। সুনীল অর্থনীতির লক্ষ্য পূরণে শৈবাল গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে। এর সুষ্ঠু সংরক্ষণ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে তা দেশের মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সমুদ্রোপকূলে শৈবালচাষ গতি আনতে পারে সুনীল অর্থনীতিতে/ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ উপকূলে সি-উইড চাষ এবং সি-উইডজাত পণ্য উৎপাদন গবেষণা’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক মো. মহিদুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘উপকূলীয় জনগোষ্ঠী বিশেষত মৎস্যজীবী ও জেলে সম্প্রদায় এবং গৃহিণীরা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে সরাসরি উপকৃত হবেন। এতে মৎস্যজীবী ও জেলে সম্প্রদায়ের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। গৃহিণীরা পারিবারিক পুষ্টি বিশেষত দৈনন্দিন খাবারে অণুপুষ্টির অভাব দূরীকরণে শৈবালজাত খাদ্য ব্যবহারের সুযোগ পাবেন। তাছাড়া হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা, রপ্তানি-বাণিজ্যে শৈবাল বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। এছাড়া বাংলাদেশ উপকূলে অর্থনৈতিক গুরুত্বসম্পন্ন শৈবালের প্রজাতির জরিপ ও শনাক্তকরণ; উপকূলে উপযুক্ত চাষ এলাকা নির্বাচন এবং বিভিন্ন শৈবাল প্রজাতির টেকসই চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও সমুদ্র উপকূলে প্রাপ্য এবং উৎপাদিত শৈবালের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিশ্চিত করা এই প্রকল্পের মূল্য উদ্দেশ্য।
শৈবালজাত পণ্যের গুরুত্ব
শৈবাল পানি ও পরিবেশ থেকে বিভিন্ন খনিজ এবং পুষ্টি সংগ্রহ করে। এতে ফল ও শাকসবজির চেয়ে বেশি ভিটামিন এ, বি-১২, সি, বিটা ক্যারোটিন, ফোলেট, রিবোফ্লাভিন এবং নায়াসিন যোগ হয় শৈবালে। সামুদ্রিক শৈবাল বিশেষত ভিটামিন বি-১২ এর শক্তিশালী উৎস, যা রক্ত এবং স্নায়ু টিস্যুর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। থাইরয়েড ফাংশন স্বাভাবিক করতে, স্বাস্থ্যকর হজমক্রিয়া বজায় রাখতে, শরীরের স্থূলতাবিরোধী প্রভাব তৈরি করতে সহায়তা করে শৈবাল। এছাড়া শৈবালে বিদ্যমান ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের অন্যান্য গুণাবলি ত্বককে পুনরুজ্জীবিত রাখতে সহায়তা করে। বর্তমানে শৈবাল মানুষের খাদ্য হিসেবে বহুলভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এর পাশাপাশি ফার্মাসিউটিক্যালস, মেডিসিন, সার ইত্যাদি বিভিন্ন শিল্পকারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় শৈবাল। বর্তমানে শৈবাল পানি শোধনাগারে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এটি বিভিন্ন প্রণীর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হচ্ছে।
শৈবাল ব্যবহার করে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যও তৈরি করা হচ্ছে। এসব পণ্য দেশের বাজারে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন দ্বার উন্মোচন করছে।
সি-উইড থাই ফ্লেভারড স্যুপ
নির্দিষ্ট ধরনের শৈবাল দিয়ে থাই ফ্লেভারড সুপও তৈরি করা যায়। এজন্য শৈবাল সংগ্রহ করে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। পরে মাশরুম, গোলমরিচ ও কিছু প্রচলিত মসলা পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শুকানো হয়। এরপর এগুলো নিরাপদ পরিবেশে গুঁড়া করা হয়। পরে আনুপাতিকহারে সব উপাদান নিয়ে পরিমাণমতো বিট লবণ প্রয়োগ করে সমসত্ত্ব মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর তিন পাশে বন্ধ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেটে নির্দিষ্ট পরিমাণের গুঁড়া নিয়ে অন্যপ্রান্ত বায়ুরোধক করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই প্রক্রিয়ায় প্যাকেটজাত স্যুপ গুঁড়ার গুণগত মান প্রায় দুই বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকে।
বাংলাদেশের সুনীল অর্থনীতির ভিত বঙ্গোপসাগরেই
সি-উইড ফেস প্যাক
শৈবাল বা সি-উইড দিয়ে প্রসাধনী বা ফেস প্যাকও বানানো যায়। সেজন্য নির্দিষ্ট ধরনের শৈবাল সংগ্রহ করে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। সম্পূর্ণ অরগানিক ফেস প্যাক তৈরির জন্য প্রাথমিকভাবে শৈবাল, জাফরান, গোলাপ, মেথি ও কাসাভা পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শুকানো হয়। এরপর এগুলো নিরাপদ পরিবেশে গুঁড়া করা হয়। পরে আনুপাতিকহারে সব উপাদান নিয়ে পরিমাণমতো চন্দন গুঁড়া প্রয়োগ করে সমসত্ত্ব মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর তিন পাশে বন্ধ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেটে নির্দিষ্ট পরিমাণের গুঁড়া নিয়ে অন্য প্রান্ত বায়ুরোধক করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই প্রক্রিয়ায় প্যাকেটজাত ফেস প্যাকের গুণগত মান প্রায় দুই বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকে।
সি-উইড উপটান
শৈবাল বা সি-উইড দিয়ে উপটানও তৈরি করা যায়। সেজন্য নির্দিষ্ট ধরনের শৈবাল বা সি-উইড সংগ্রহ করে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নেওয়া হয়। সম্পূর্ণ অরগানি উপটান তৈরির জন্য প্রাথমিকভাবে শৈবাল, কাসাভা, মুলতানি মাটি, গম, ডাল, কমলার খোসা, হলুদ, তিল, তিসি, কারি পাতা ও চাল পৃথকভাবে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শুকানো হয়। এরপর এগুলো নিরাপদ পরিবেশে গুঁড়া করা হয়। পরে আনুপাতিকহারে সব উপাদান নিয়ে পরিমাণমতো গুঁড়ার সমসত্ত্ব মিশ্রণ তৈরি করা হয়। এরপর তিন পাশে বন্ধ অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল প্যাকেটে নির্দিষ্ট পরিমাণের গুঁড়া নিয়ে অন্যপ্রান্ত বায়ুরোধক করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই প্রক্রিয়ায় প্যাকেটজাত সি-উইড উপটান প্যাকের গুণগত মান প্রায় দুই বছর অক্ষুণ্ন থাকে।
বালাচাও
শৈবাল বা সি-উইড দিয়ে বানানো যায় দীর্ঘসময় সংরক্ষণযোগ্য বালাচাও নামে এক ধরনের ‘রেডি টু ইট ফুড’ও। এজন্য নির্দিষ্ট ধরনের সি-উইড সংগ্রহ করে ভালোভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে শুকিয়ে নেওয়া হয়। এছাড়া পেঁয়াজ, রসুন, কাঁচকি মাছ, মরিচ, চিংড়ি পরিষ্কার করে কেটে নেওয়া হয়। এরপর আনুপাতিকহারে সব উপকরণ অল্প আঁচে তেলে ভাজা হয়। এক্ষেত্রে প্রথমে পেঁয়াজ এবং রসুন তেলে ভেজে উঠিয়ে নিতে হবে। পরে সব উপকরণ ভাজা হলে পেঁয়াজ এবং রসুন ভাজা যোগ করে নিতে হবে। এরপর এগুলো কাচের পাত্রে সংরক্ষণ করা হয়। ওই প্রক্রিয়ায় প্যাকেটজাত সি-উইড বালাচাও এর প্যাকের গুণগত মান প্রায় এক বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ উপকূলে বসবাস করে। তাদের প্রধান কাজ হলো মৎস্য আহরণ, মৎস্য বাজার ব্যবস্থাপনা, লবণ চাষ ইত্যাদি। বিশাল সমুদ্রের উপকূলে মানুষের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস হতে পারে সি-উইড বা শৈবাল চাষ, ব্যবস্থাপনা ও পণ্য তৈরি। এতে বিনিয়োগের তেমন ঝামেলা নেই। স্বল্পপুঁজিতে শৈবাল চাষ একদিকে যেমন আয়ের উৎস হবে, তেমনি এটি উপকূলীয় জনগণের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা পূরণ করতে পারবে। অন্যদিকে জাতীয় অর্থনীতিতেও অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে পারবে।
শৈবাল থেকে তৈরি দুটি খাবার পণ্য
কর্মকর্তারা মনে করেন, শৈবাল চাষ পদ্ধতি এবং পণ্য উৎপাদন দেশে সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নতুন উদ্যোগ। এর চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণের মাধ্যমে উপকূলীয় জলাশয়ের আওয়তায় আনা সম্ভব। এসব জলাশয়ে উৎপাদিত শৈবাল ব্যবহার ও পণ্য প্রস্তুতি দেশের প্রত্যাশিত সুনীল অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখবে। এতে দরিদ্র জনসাধারণের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে।
শৈবালে সম্ভাবনা
সম্প্রতি পটুয়াখালীর কুয়াকাটা উপকূলের গংগামতি এলাকায় বাণিজ্যিক গুরুত্বম্পন্ন শৈবালের প্রাকৃতিক উৎপাদন ক্ষেত্র শনাক্ত করা হয়েছে এবং সেখানে বাণিজ্যিক প্রজাতির চাষ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। শৈবাল গবেষক দল সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ইনানি, বাঁকখালী মোহনা, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, শাপলাপুর, কুয়াকাটা ও সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ এলাকা থেকে এ পর্যন্ত ১৪৩টি শৈবালের নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে সংরক্ষণ করেছে।
উপকূলে সমুদ্র সৈকতে শৈবালের প্রাচুর্য্যতা, প্রাপ্যতা ও শ্রেণিবিন্যাস বিষয়ক ‘Seaweeds of Bangladesh coast’ নামক একটি বই প্রকাশ করা হয়েছে। বইটি একাধারে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কৃষক, উদ্যোক্তা, গবেষক এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য সমুদ্রভিত্তিক সুনীল অর্থনৈতিক উন্নয়নে পথ নির্দেশক হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশে প্রাপ্ত সামুদ্রিক শৈবালের মধ্যে ২৩টি শৈবাল প্রজাতির প্রাপ্যতা, চাষ, পুষ্টিমান এবং খাদ্য উপাদানের ব্যবহারের ভিত্তিতে বাণিজ্যিকভাবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের শৈবাল গবেষক দল উল্লেখ করেছে।
শৈবাল থেকে তৈরি দুটি প্রসাধনী
গবেষণায় দেখা গেছে, আনুভূমিক জাল ব্যবহার করে ৯০ দিনে প্রতি বর্গমিটারে প্রায় ৩১ কেজি শৈবাল উৎপাদন করা সম্ভব। শৈবালপণ্য তৈরির জন্য তিনটি প্রজাতি- Hypnea musciformis, Caulerpa racemosa ও Padina tetrastromatica ব্যবহার করে স্যুপ, পিৎজা, নুডলস, বিস্কুট ইত্যাদি তৈরি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের যে অপ্রচলিত মৎস্যসম্পদ আছে যেমন- শামুক, ঝিনুক, কাঁকড়া এগুলোর বাইরে শৈবালও একটি অন্যতম প্রজাতি। যেটার বিশাল একটি মার্কেট আছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। এজন্য এটাকে আমরা বিদেশে রপ্তানি করবো এবং সেই সঙ্গে দেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে চাই। এটি খুবই পুষ্টিকর, সেজন্য এটির প্রতি আমরা বিশেষ মনোযোগ দিচ্ছি এবং এটার চাষাবাদ কৌশল ঠিক করেছি। এটা থেকে ভ্যালু অ্যাডেড পণ্যও আমরা তৈরি করেছি। আমরা চাচ্ছি বাংলাদেশের মানুষ এই শৈবালকে নতুন আইটেম হিসেবে গ্রহণ করুক। সেই সঙ্গে শৈবাল রপ্তানি করে বিদেশে একটি বিশাল বাজার ধরতে চাই আমরা। এখন আমাদের বিক্রির জন্য পাঁচটি পণ্য রয়েছে। এগুলো শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর মানুষের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করবো। যেসব খাবার শৈবাল থেকে তৈরি করা যায় সেগুলো মানুষকে বিনামূল্যে খাওয়াবো।
তিনি বলেন, বিদেশে কিছু পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এটা এখনো খুব বড় আকারে হচ্ছে না, তবে শুরুটা হয়েছে। কোন শ্রেণি বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ সেটি আমরা বের করেছি চাষ করে। কোন প্রজাতি বেশি পুষ্টিকর সেটি বের করেছি। এখন আমরা এটা চাষাবাদে যাচ্ছি এবং অলরেডি মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে প্রযুক্তিটা হস্তান্তর করেছি। এসব পণ্য অলরেডি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এর মূল্য মানুষের সাধ্যের মধ্যেই থাকবে, খুব দামি জিনিস হবে না।
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ আরও বলেন, যেহেতু বাংলাদেশের মানুষ এসব পণ্য খেয়ে খুব একটা অভ্যস্ত নয়, সেজন্যই ফেস্টিভ্যালটা করবো। যেসব পর্যটক কক্সবাজারে যাবেন তাদের এ পণ্যের সঙ্গে পরিচিত করবো এবং এটা যে শরীরের জন্য ভালো তা বোঝাবো। খাদ্য এবং ওষুধশিল্পে এটার কিন্তু ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা যে কসমেটিকস, টুথপেস্ট তৈরি করি এটা কিন্তু শৈবাল থেকেই তৈরি। আমরা যে অ্যান্টিবায়োটিকের কাভার তৈরি করি সেটিও শৈবালের তৈরি। সেজন্যই আমরা এটি জনপ্রিয় করার এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছি।
আইএইচআর/ইএ/এইচএ/জেআইএম