‘মেগা প্রকল্প শুরু করতে আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি’

সাইফুল হক মিঠু
সাইফুল হক মিঠু সাইফুল হক মিঠু
প্রকাশিত: ১০:১৬ এএম, ০৫ জানুয়ারি ২০২২

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়ন এখন দৃশ্যমান। করোনা মহামারির মধ্যেও সরকারের মেগা প্রকল্পে কাজের অগ্রগতি বেড়েছে। চলতি বছরই আলোর মুখ দেখবে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ একাধিক মেগা প্রকল্প। এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে নতুন যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।

দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার মেলবন্ধন স্থাপন করবে পদ্মা সেতু। আগামী জুন মাসে উদ্বোধনের কথা রয়েছে স্বপ্নের এ সেতুর। এছাড়া রাজধানীর গণপরিবহনে স্বস্তি আনতে ডিসেম্বরে চালু হবে মেট্রোরেল।

ভ্রমণের সময় ও খরচ কমাবে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। সার্বিকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজীকরণ, আধুনিকায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখবে এসব প্রকল্প।

কর্ণফুলী টানেল, বিআরটি, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের কাজও একটু একটু করে এগোচ্ছে।

কতটা চ্যালেঞ্জ ছিল মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে? এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কী লাভ হবে? কিংবা মেগা প্রকল্পের বিশাল খরচ জোগাতে সরকারকে কতটা অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে? আমাদের মনে আসা এমন হাজারও প্রশ্নের উত্তর জাগো নিউজকে দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামসুল হক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাইফুল হক মিঠু

জাগো নিউজ: পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মতো মেগা প্রকল্প দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কোন ধরনের ভূমিকা রাখবে?

ড. মো. শামসুল হক: যানজট ও দূরত্বের কারণে প্রচুর কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আসবে, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা যোগ হবে। যানবাহনে ফিরবে গতি। মেট্রোরেলের মাধ্যমে বিলম্বহীন- অনেকটা মিনিট, সেকেন্ড ধরে যাত্রীরা গন্তব্যে পৌঁছাবে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে দ্রুতই বাইরের জেলার গাড়ি ঢাকায় প্রবেশ করবে। ঢাকা ও আশপাশে থাকা শিল্প-কারখানা দ্রুত পণ্য সরবরাহ করতে পারবে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য নতুন গতি পাবে।

padma_bridge-1.jpg

অন্যদিকে পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে মাইলফলক হবে। এসব প্রকল্প চালু হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি উৎপাদন বাড়বে। মানবসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এসব প্রকল্প। বঙ্গবন্ধু সেতু অর্থনৈতিক উন্নয়নে যেভাবে ভূমিকা রেখেছে, পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়ন আরও দ্রুত হবে।

জাগো নিউজ: মেগা প্রকল্পে আমরা দেরি করে ফেললাম কি? এই সময়ে মেট্রোরেল কতটা সময়োপযোগী?

ড. মো. শামসুল হক: আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছি। বঙ্গবন্ধু সেতু করার পর পরই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পদ্মা সেতু করার দরকার ছিল। আশপাশের অনেক দেশেই একাধিক মেট্রোরেল আছে। ভিয়েতনাম মাত্র পাঁচ-ছয় মাসে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে করেছে। পাকিস্তান ১১টা এক্সপ্রেসওয়ে করেছে। শ্রীলংকায়ও এক্সপ্রেসওয়ে আছে। আমরা অনেক অনেক পরে মেগা প্রকল্প শুরু করেছি।

সঠিক সময়ে বড় অবকাঠামো না করতে পারলে পরবর্তী সময়ে অনেক কিছুর সঙ্গে আপস করতে হয়। যেমন- মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো সমন্বিত করা সম্ভব হয়নি। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে রাস্তা ও ফুটপাতে। স্টেশনভিত্তিক অঞ্চল পরিকল্পনা করা যাচ্ছে না। আরও আগে কাজ শুরু হলে সেটা করা যেত, এখন আর করা যাচ্ছে না। কারণ শহরে অনেক বড় বড় অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। সঠিক সময়ে কাজ না করায় আমাদের অনেক ভুগতে হবে।

padma_bridge-1.jpg

একবিংশ শতাব্দীতে এসে উন্নত দেশগুলো নগররেল ও গতিভিত্তিক রেলে বিনিয়োগ করছে। দেশগুলো এখন আর সড়ক বানাতে আগ্রহী নয়। তার কারণ সড়ক টেকসই না হওয়া, দূষণ ও জ্বালানি। মেট্রোরেল আমাদের পরিবহন ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যোগ করবে। বিশেষ করে পিক আওয়ারে যাত্রীদের একটা বিশাল অংশের কাছে প্রশান্তির কারণ হয়ে উঠবে।

জাগো নিউজ: মেট্রোরেলের ভাড়া নিয়ে নানান কথা শোনা যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত এটা কতটা যাত্রীবান্ধব গণপরিবহন হবে বলে মনে করেন?

ড. মো. শামসুল হক: রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছুঁয়ে যাবে মেট্রোরেল। এখানে অসংখ্য যাত্রীর আনাগোনা থাকবে। পিক আওয়ার বা অন্যান্য সময় প্রচুর যাত্রী থাকবে। আমি মনে করি ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় মেট্রোরেলে ভর্তুকি দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। মেট্রোরেল পরিচালনায় পেশাদারত্ব থাকলে ভর্তুকি নয় সরকার এখাত থেকে মুনাফাও করতে পারে। এজন্য মেট্রোরেল পরিচালনায় গণপরিবহন বোঝেন এমন পেশাদার লোক নিয়োগ দিতে হবে।

padma_bridge-1.jpg

হংকং, সিঙ্গাপুরের মতো জায়গায় দেখা গেছে নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে তারা মেট্রোরেল পরিচালনার খরচ সংগ্রহ করেছে। জনগণকে বুঝতেই দেয়নি কোনো কিছু। তারা শুধু ভাড়া থেকে রেভিনিউ সংগ্রহ করেনি। আমাদের উন্নয়ন অনেক দেরিতে শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো ভুল হলে তা অমার্জনীয় অপরাধ হয়ে যাবে।

জাগো নিউজ: খরচ ও কাজে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?

ড. মো. শামসুল হক: আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তুলনায় প্রতি কিলোমিটার মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে কিংবা পদ্মা সেতুর রেলওয়ের খরচ অনেক বেশি। যে কোনো প্রকল্পে আমরা দেখি, খরচ প্রথমে যৌক্তিক থাকে। পরে সময়ক্ষেপণের কারণে খরচ বেড়ে যায়। ফিজিবিলিটি স্ট্যাডিতে (সম্ভাব্যতা যাচাই) কিলোমিটারপ্রতি খরচ মানানসই থাকে। কাজে নামার পর নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। সমাধান করতে গিয়ে সময় ও খরচ বেড়ে যায়। তবে কাজের পরিমাণ বা দৈর্ঘ্য বাড়ে না।

দেখা যায় খরচটা পার্শ্ববর্তী কয়েকটা দেশের চেয়েও বেশি। এমনকি ইউরোপিয়ান অনেক দেশের চেয়েও বেশি।

জাগো নিউজ: প্রকল্পগুলো রক্ষণাবেক্ষণে আমরা কতটা সক্ষম? দেশীয় প্রতিষ্ঠান বা ইঞ্জিনিয়াররা কবে বড় প্রকল্পে নেতৃত্ব দেবেন?

ড. মো. শামসুল হক: আমরা উন্নয়ন করি, তবে এর রক্ষণাবেক্ষণের কথা ভুলে যাই। ফলে দেখা যায় পরবর্তী সময়ে ওই কাজ আবার করতে হয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ৩০ বছর ধরে রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এটা একটা ভালো দিক। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে (পিপিপি) এটা হচ্ছে। আশা করছি দীর্ঘদিন এর রক্ষণাবেক্ষণ যথাযথ মানদণ্ড অনুযায়ী হবে। তবে পদ্মা সেতুতে এখনই রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা দেখতে পাচ্ছি।

মেগা প্রকল্পে লোকাল ম্যাটেরিয়ালস ও মেধার খুব কম ব্যবহার হয়েছে। এ ধরনের সক্ষমতা নিজের দেশে তৈরি হয় না। চ্যালেঞ্জ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ার বা ইন্সট্রাক্টররা দেশের বাইরে চলে যান। পড়াশোনা বা কাজ করতে করতে একসময় সক্ষমতা তৈরি করে। সরকার তখন বিদেশ থেকে দেশি এক্সপার্টদের এনে ভালো পজিশন দেয়, ভালো বেতন দেয়।

padma_bridge-1.jpg

বাংলাদেশি অনেক কন্ট্রাক্টর দুবাইতে কাজ করেন। তারা বলেন, আমরা যদি সুযোগ পেতাম, তাহলে দেশের উন্নয়নে কাজ করতাম। বিদেশি পরামর্শক দিয়ে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। তারা হয়তো বানিয়ে দিয়ে যাবে, প্রচুর খরচ নেবে। তবে এর মধ্যে অর্জন কম। দেশের ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষ করলে উন্নয়নের পাশাপাশি তারা রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা রাখতে পারবেন।

জাগো নিউজ: বিভিন্ন প্রকল্পের নকশা নিয়ে সন্তুষ্টি আছে কি? প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল?
ড. মো. শামসুল হক: আমাদের সেতুগুলোর ডিজাইন (নকশা) অত্যন্ত সেকেলে। কোনো নান্দনিকতা নেই। দেখে চোখ আটকায় না। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের কোনো সিগনেচার স্থাপনা নেই। যার সামনে আমরা বিজয় দিবস বা বর্ষবরণের মতো অনুষ্ঠান উদযাপন করতে পারি। সিডনির পার্ল হারবার, লন্ডন ব্রিজ, ভিয়েতনামের দৃষ্টিনন্দন ড্রাগন ব্রিজ। এমনকি কলকাতার হাওড়া ব্রিজ। নদীর ধারে ব্রিজের পাশে আতশবাজি হয়, ম্যারাথন হয়। একটা পাবলিক স্পেস তৈরি হয়।

সেখানে আমাদের এত নদী, ঢাকার আশপাশে এত ব্রিজ অথচ আইকনিক কোনো ব্রিজ নেই। পদ্মা সেতুতে আধুনিকতা আছে। এটাকে দৃষ্টিনন্দন করা হয়েছে। আমাদের মেট্রোরেলের নকশাও সুন্দর হয়েছে। এছাড়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নকশাও সময়পোযোগী হয়েছে। আমি বলবো নতুন নতুন স্থাপনায়ও যেন এই নান্দনিকতার বিষয়টি মাথায় রাখা হয়।

প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ ছিল। তবে তা পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশ নিজের সক্ষমতার জানান দিয়েছে। পদ্মার মতো একটি খোরস্রোতা ও ভাঙনপ্রবণ নদীর ওপর ৬ দশমিক ১ কিলোমিটার ব্রিজ করা, নদীশাসন করা অনেক কঠিন কাজ ছিল। এছাড়া পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে দোটানা ছিল। যতবড় চ্যালেঞ্জ ছিল তত বড় সাফল্যও কিন্তু এসেছে।

তবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ২০১০ সালে শুরু করে আমরা এখনো প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ করতে পারিনি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ের কাজ অনেক কঠিন হবে। কেননা অনেক স্থাপনার সঙ্গে কনফ্লিক্ট হবে। ঢাকায় এক ফুট জায়গা কেউ ছাড়তে চায় না। ঢাকায় আরও প্রকল্প আছে। এটা রেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে। সরকার যদি এখনো নজর না দেয় তাহলে এর ভবিষ্যৎ অগ্রগতি নিয়ে আমি শঙ্কিত। নতুন নতুন আরও প্রকল্প এই করিডোরে আসছে, যা নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে।

নানা কারণে মেট্রোরেল এখন সংসদ ভবন এলাকায় ঢুকে গেছে। কমলাপুরে মেট্রোরেলের স্টেশন করতে নানা জটিলতা তৈরি হয়েছে। শাপলা চত্বর, বাংলাদেশ ব্যাংকঘেঁষে মেট্রোরেল নিতে হচ্ছে। মেট্রোরেলের মাস্টারপ্ল্যানে প্রথমে সায়েদাবাদে স্টেশন করার কথা ছিল। কিন্তু মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের কারণে তা করা যাচ্ছে না। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ঢাকার জন্য অপূরণীয় ক্ষতি করেছে।

সায়েদাবাদের গুরুত্ব হচ্ছে সেখানে ৩১টি জেলার যানবাহন এসে থামছে। মেগা প্রকল্পের স্টেশন থাকলে বাস থেকে নেমেই যাত্রীরা বিআরটি পেতো, এমআরটি পেতো। এর মাধ্যমে সহজেই মাকড়সার জালের মতো যাত্রীরা রাজধানীতে ছড়িয়ে যেতে পারতো।

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার অনেক সম্ভাবনা শেষ করে ফেলেছে। মেট্রোর স্টেশন বাংলাদেশ ব্যাংকের গায়ে লাগিয়ে ফেলতে হয়েছে। জোর করে কমলাপুরের দিকে নিয়ে যেতে হচ্ছে। যেটা প্রস্তাবিত মেট্রোরেলে ছিল না, সেটাই করতে হচ্ছে। এ কারণে প্রকল্পটিকে এখন আর সমন্বিত করতে পারছি না। এছাড়াও মেট্রোরেলে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ আছে।

এসএম/কেএসআর/এএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।