চালের দামে ঊর্ধ্বগতি: এবারও আঙুল মিলারদের দিকে
অডিও শুনুন
আমন মৌসুম চলছে। কৃষকের ঘরে ধান উঠছে। এরই মধ্যে চালের দাম বেড়েছে আরেক দফা। এবারও চালের বাজার অস্থির করার জন্য আঙুল উঠেছে চালকল মালিক (মিলার) ও আড়তদারদের দিকে। অভিযোগ উঠেছে, মিলার ও আড়তদাররা বাজারে ধীরে ধীরে চাল ছাড়ছেন। চাহিদার চেয়ে জোগান কম হওয়ায় কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে, এতে বাড়ছে চালের দাম।
সরকারি বাণিজ্য সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি চালের দাম কেজিপ্রতি ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়ে গেছে। দাম বাড়ার হার চিকন চালের ক্ষেত্রে বেশি।
এই পরিস্থিতিতে বাজার তদারকি জোরদার করার প্রস্তাব দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অবশ্য অসাধু ব্যবসায়ীদের রুখে বাজারে চালের দাম সহনীয় করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ও।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে ওএমএসের আওতা বাড়ানো হয়েছে। অবৈধ ধান ও চালের মজুত খুঁজে বের করতে খাদ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এ বিষয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনেরও চিন্তা-ভাবনা চলছে। একই সঙ্গে শুল্ক কমিয়ে বেসরকারিভাবে চাল আমদানির জন্য প্রস্তুতিও নিয়ে রাখছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এ বিষয়ে খাদ্য সচিব মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা মিটিং করেছি, সেখানে বলা হয়েছে, মিলাররা চাল ধীরে ধীরে ছাড়ছে। মিলাররা ধান মজুত করছে। কিন্তু আমরা অভিযান চালিয়ে মজুত পাচ্ছি না। আমরা তথ্য পেয়েছি, মিলাররা ধানটা কিনে কৃষকের কাছেই রাখছে। ফড়িয়ারা ধান মজুত করছে। সে তো কৃষক হিসেবেই মজুত করছে। কৃষকের ঘরে তো মোবাইল কোর্ট করা যায় না।’
তিনি বলেন, ‘(আমন) ধান উৎপাদন অনেক হয়েছে। পর্যাপ্ত ধান আছে। কিন্তু সেই ধান বাজারে আসছে ধীরে ধীরে। এজন্য দাম বেড়েছে।’
সরকারিভাবে চাল আমদানি চলমান জানিয়ে সচিব বলেন, ‘আমরা বেসরকারিভাবে আমদানিতে যাবো কি না, সেটা হলো বিষয়। আমাদের উদ্বৃত্ত উৎপাদন, ভোক্তাদের একটু স্বস্তি দিতে হয়, এছাড়া নিরাপত্তা মজুতের বিষয়টি রয়েছে। সেজন্য আমরা বেসরকারিভাবে আমদানিতে যাই। আমরা শুল্ক কমিয়েও চাল আনতে পারি। আমরা দেখছি, বাজারটা কোন দিকে যায়।’
মোটা চাল নিয়ে কোনো সমস্যা নেই দাবি করে সচিব বলেন, ‘আমরা ওএমএস বাড়িয়ে দিয়েছি। ঢাকায় ১০টি ট্রাক বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজনে উপজেলায় নিয়ে যাবো। আমরা ওএমএসের বাজেটের দ্বিগুণ ব্যবহার করে ফেলেছি।’
নাজমানারা খানুম আরও বলেন, ‘কোথাও মজুত দেখলে খাদ্য বিভাগ এনফোর্সমেন্টে যেতে পারছে না। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে আমরা সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স করতে চাচ্ছি। এই টাস্কফোর্স মূলত চাল ও আটার বিষয়টি দেখবে।’
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এ কে এম খোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা দেখে আসছি, যখনই চালের মৌসুম আসছে, দাম কমে গেছে। নতুন ধান যখন আসবে এর এক বা দুই মাস আগে চালের দাম বাড়ে, এর আগে বাড়ে না। কিন্তু এখন ব্যতিক্রম হলো ধান আসার দুই মাস আগে চালের দাম কম ছিল অথচ এখন ধান উঠেছে, কৃষক, ফড়িয়া ও মিলারদের ঘরে ধান, সেই সময় চালের দাম ৪-৫ টাকা বেড়েছে প্রতি কেজিতে। একটা অস্বাভাবিক বিষয়।’
চালের দাম বেশি কিন্তু কৃষক ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অসাধু মিলাররা ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ধান-চাল মজুত করছে, তারাই চালের দামের ঊর্ধ্বগতির জন্য দায়ী।’
তিনি বলেন, ‘গত মৌসুমের চাল এখনও আছে। খাদ্যের অভাব নেই। এখন মিলাররা প্রতিদিন ১০০-২০০ বস্তা করে ধান কিনছে। মিলাররা আগের চালই ধীরে ধীরে ছাড়ছে। যেন বাজারে কম আসে, এতে চাহিদা অনুযায়ী জোগানে ঘাটতি দেখা দেয়, কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি হয়, স্বাভাবিকভাবেই এ পরিস্থিতিতে চালের দাম বেড়ে যায়।’
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, গত ২৭ ডিসেম্বর চালের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। ওই সভায় একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি জানান, সরবরাহ কমিয়ে চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তিনি মনিটরিং জোরদারের সুপারিশ করেন।
টিসিবির সহকারী কার্যনির্বাহী (বাজার তথ্য) মো. নাসির উদ্দিন তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে একটি মিটিংয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের লোকজন ছিলেন। তারা বলেছেন, আমনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হয়েছে। বৃষ্টিতে যে ক্ষতি হয়েছে তা খুবই সামান্য। ফসলের কোনো ঘাটতি নেই। আমরা বাজার থেকে তথ্য পেয়েছি, মিলার ও আড়তদাররা চাল বাজারে কম করে ছাড়ছে। রাজধানীর পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমরা এ তথ্য পেয়েছি। ধরেন এখন দুই ট্রাক চাল লাগবে কোনো পাইকারি ব্যবসায়ীর, কিন্তু তিনি মিলারদের কাছ থেকে পাচ্ছেন এক ট্রাক।’
সম্প্রতি চালের দাম ৩-৪ টাকা বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘চিকন চালের দাম একটু বেশি বেড়েছে।’
‘গত ১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজার পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই কমিটি মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, কারওয়ান বাজার, বাবুবাজার ও মিরপুর-১ নম্বর বাজারে গেছে। মোহাম্মদপুর ও বাবুবাজারে চালের দাম একটু কম, কারওয়ান বাজার ও মিরপুরে দামটা তুলনামূলক বেশি। আমরা দেখেছি, যে চাল মোহাম্মদপুরে ৪০ টাকা, সেটা মিরপুরে ৪১ টাকা, কারওয়ান বাজারে সেটা ৪২ থেকে ৪৩ টাকা।’
দাম বেড়ে গত দু-তিনদিন ধরে স্থিতিশীল আছে জানিয়ে টিসিবির ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বাজারে চালের প্রকারের শেষ নেই। মিনিকেটই আছে চার রকমের। নাজিরশাইলের রয়েছে অনেকগুলো ধরন। ৫০ রকম চাল থাকলে এর ৫০ রকম দাম।’
এবার আমন ধান ভালো উৎপাদন হয়েছে/ফাইল ছবি
নাসির উদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘এজন্য আমাদের একটা প্রস্তাব ছিল যে, জাতীয় পর্যায়ে চালের আকৃতি ও মানের ওপর ভিত্তি করে মোটা, মাঝারি ও চিকন- এই তিনটি ধরন নির্ধারণ করে দেবে সরকার। এই তিন ক্যাটাগরিতে চালের দাম নির্ধারণ করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এখন চাষাবাদের জন্য উন্নত প্রযুক্তি এসেছে। সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। ফলন বেশি হয়। অটো রাইস মিলগুলো খুব অল্প সময়ের মধ্যে শত শত মণ ধান ছাঁটাই করছে। খরচ কমে গেছে। সেখানে তো চালের দাম কমার কথা, কিন্তু চালের দাম বেড়েই যাচ্ছে।’
বাদামতলী-বাবুবাজার চাল আড়ত মালিক সমিতির যুগ্ম-সম্পাদক কাওসার আলম খান বাবলু বলেন, ‘একটা সপ্তাহ অপেক্ষা করেন, আশা করছি বাজারদর কমে যাবে। চাল কম আসায় দাম বেড়েছে। গত কিছুদিন আগে বেশ বৃষ্টি হয়েছিল। মৌসুমও ছিল শেষ। ধান কাটার পর মানুষ শুকাতে দিয়েছে, ওই সময়ই বৃষ্টি। এখন আবার চাল আসছে। আমন কিন্তু এখনও পুরোপুরি ওঠেনি। দক্ষিণাঞ্চলে আমন এখনও মাঠে আছে।’
বাজার সহনীয় রাখতে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যত উদ্যোগ
আগামী ৭ জানুয়ারির মধ্যে মাঠ পর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তাদের ধান ও চালের অবৈধ মজুতের তথ্য দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
মিলার ও আড়তদাররা চাল বাজারে কম করে ছাড়ছে বলে তথ্য পেয়েছে সরকার/ফাইল ছবি
খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকদের (ডিসি ফুড) তার জেলায় কারা অবৈধভাবে ধান-চালের মজুত করছেন তা আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রককে (আরসি ফুড) জানাতে হবে। কেউ মজুত না করলে সেটাও জানাতে হবে যে, তার জেলায় কেউ খাদ্য মজুত করছেন না। সেই মজুতদারদের তালিকা অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করা হবে। তবে কোনো জায়গায় মজুত করছে না বলে প্রতিবেদন দেওয়ার পর সেখানে মজুত পাওয়া গেলে, সেই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চাল ও আটার বাজার মনিটরিংয়ের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা। এজন্য একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করা হবে।
ওই কর্মকর্তা জানান, শুল্ক কমিয়ে সরু চাল আমদানির প্রস্তুতি নিতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। এবার ২৫ শতাংশের কম শুল্কে চাল আমদানির জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অনুমতিটা আগেই নিয়ে নেওয়া হবে। যাতে প্রয়োজন হলে দ্রুত চাল আমদানিতে যাওয়া যায়।
আরএমএম/এইচএ/জেআইএম