‘অর্থপাচার গোটা অর্থনীতিতে ধস নামিয়ে দিচ্ছে’

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:২৮ পিএম, ০১ জানুয়ারি ২০২২
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান

ড. ইফতেখারুজ্জামান। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক। লিখছেন এবং গবেষণা করছেন রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অসঙ্গতি নিয়ে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের ভয়াবহতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গ নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়েছেন ইফতেখারুজ্জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু

জাগো নিউজ: ছয় বছরে (২০০৯-২০১৫) বাংলাদেশ থেকে ছয় লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে জিএফআইয়ের প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার ২০১৫ সাল থেকে জাতিসংঘকে বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত আর কোনো তথ্য দেয়নি। অর্থপাচারের এই চিত্রে কতটুকু অবাক হয়েছেন?

ড. ইফতেখারুজ্জামান: যেভাবে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থপাচার হচ্ছে, তা অত্যন্ত উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার বলে মনে করি। এই পাচারের গতি যদি রোধ করা না যায় বা থামানো না যায়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে।

মনিটরিং এবং জবাবদিহিতার যে অভাব, সেই জায়গা থেকেই অর্থপাচারের এই স্রোত। অর্থপাচার গোটা অর্থনীতিতে ধস নামিয়ে দিচ্ছে।

জাগো নিউজ: বছরের পর বছর ধরে অর্থপাচার হয়ে আসছে। এখন এত উদ্বেগ প্রকাশ করার কারণ কী?

ড. ইফতেখারুজ্জামান: উদ্বেগ প্রথম থেকেই ছিল। দেশের বাইরে একটি টাকা পাচার হয়ে যাক, এটি কোনো মঙ্গলজনক বিষয় হতে পারে না। কিন্তু এখন অধিক উদ্বেগের কারণ হচ্ছে অর্থপাচারের হার ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছে। সূচক অন্তত তাই বলছে। তার মানে এটি রোধ করতে না পারলে আরও বাড়বে।

আর অর্থপাচারের এ হার অব্যাহত থাকলে সরকার উন্নয়ন নিয়ে যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে তাতে ভাটা পড়বে। উন্নয়ন কোনোভাবেই আর টেকসই করা সম্ভব হবে না।

জাগো নিউজ: অর্থপাচার নিয়ে প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন রাখতে চাই। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পুলিশ এবং র‌্যাবের কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের নানা ইস্যুতেই অবস্থান নেয়। অথচ পাচার হওয়া অর্থ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলে না। এটি কীভাবে দেখছেন?

ড. ইফতেখারুজ্জামান: অর্থপাচারের সঙ্গে দুটি পক্ষ থাকে। একটি হলো কোন দেশ থেকে পাচার হয়। আরেকটি হলো, কোন দেশে পাচার হয়। যেসব দেশে পাচার হয়, তারা স্বাগত জানায়। বিভিন্ন আইনের ফাঁক রাখা হয়েছে অর্থপাচারের জন্য। আমি সম্প্রতি একটি দৈনিকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত লিখেছি।

যেসব দেশে অর্থপাচার হচ্ছে, সেসব দেশ পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তৈরির মধ্য দিয়ে আকর্ষণ সৃষ্টি করে চলছে।

কিন্তু একটি দেশ সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে বলেই আমরা আমাদের দায়মুক্ত হতে পারি না। সুযোগ আছে বলেই আমি অর্থপাচার করতে পারি না। চুরি করার সুযোগ আছে বলেই আমি চুরি করতে পারি না। একটি অপরাধ আরেকটি অপরাধকে অবশ্যই বৈধতা দিতে পারে না।

জাগো নিউজ: অর্থপাচার হচ্ছে খুব সূক্ষ্মভাবে। পাচার ঠেকাতে চাইলেও পারছে না বলে মনে করা হয়। আসলে কি তাই?

ড. ইফতেখারুজ্জামান: কারা, কীভাবে অর্থপাচার করছে তা খুব স্পষ্ট। সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সবই জানে। জবাবদিহিতা নেই বলেই বছরের পর বছর অর্থপাচার হয়ে আসছে। আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি হচ্ছে, তা সবাই জানেন।

আমরা বিষয়টি জেনে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছি না মানে, এ অপরাধকে এক প্রকার মেনেই নিচ্ছি। এই জবাবদিহিতা না থাকলে বাইরে পরিবেশ থাকুক বা না থাকুক, অর্থপাচার হবেই। এখানে আমাদের দায়িত্ব আছে।

জাগো নিউজ: পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার একটি তাগিদও আছে। সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত আনাও হলো। অথচ বৃহৎ অর্থে কর্তৃপক্ষের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না...

ড. ইফতেখারুজ্জামান: পাচার হয়ে যাওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক আইন রয়েছে। এই আইনেরবলে শক্ত অবস্থান নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশন রয়েছে। তার আওতায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে পারস্পরিক সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। সরকার চাইলে যে কোনো দেশের সরকারের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে পারে। যারা এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধানও রয়েছে।

জাগো নিউজ: তাহলে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কোথায়?

ড. ইফতেখারুজ্জামান: যারা অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত তারা সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী। তারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না, এ ধরনের সংস্কৃতি সমাজে বিরাজ করছে।

আমি আইনের কথা বলেছি। এই আইনবলেই সিঙ্গাপুর থেকে এক সময় অর্থ ফেরত আনা হয়েছে। তার মানে প্রমাণ আছে। একবার করে থাকতে পারলে এখন পারবো না কেন? এই প্রশ্নের জবাব সরকারের কাছেই আছে।

জাগো নিউজ: আসলে কার টাকা কে পাচার করছে?

ড. ইফতেখারুজ্জামান: মূলত পণ্য আমদানির মাধ্যমে অর্থপাচার হচ্ছে। পণ্যে মূল্য বাড়িয়ে টাকা বাইরে পাঠানো হচ্ছে। এই কাজের সঙ্গে অবশ্যই সাধারণ মানুষ জড়িত নয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের টাকাই কোনো না কোনোভাবে এদের হাতে চলে যায় এবং তা পাচার করে।

‘অর্থপাচার গোটা অর্থনীতিতে ধস নামিয়ে দিচ্ছে’

২০০৯-২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ছয় লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলেছে জিএফআই

কীভাবে টাকা বাইরে যাচ্ছে, তা কাস্টম জানে। বেশিরভাগ অর্থই কাস্টম হয়ে যায়। সামান্য কিছু হুন্ডি বা ব্যক্তি বহন করে। তার মানে চাইলে প্র্যাক্টিক্যালিই কাস্টমের মাধ্যমে পাচার রোধ করা সম্ভব। এখানে হাত দেওয়া হচ্ছে না কেন? তার মানে এখানে প্রভাবশালী মহল জড়িত।

জাগো নিউজ: বিরোধীপক্ষের দাবি, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংকটের কারণে বিনিয়োগের পরিবেশ সংকুচিত। অর্থপাচার হওয়ার কারণ এটিও বিবেচ্য কি না?

ড. ইফতেখারুজ্জামান: এটি রাজনৈতিক কথা। এর সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক আছে বলে মনে করি না। যারা অর্থপাচার করছেন, তাদের জন্য বিদেশ যেমন নিরাপদ তেমনি দেশও নিরাপদ। ধনাঢ্য ব্যক্তিরাই এর সঙ্গে জড়িত। তারা দেশে ব্যবসা করেই অর্থের পাহাড় গড়ছেন, যার একটি অংশ বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।

রাজনৈতিক সংকটের কারণে বাইরে বিনিয়োগ করছেন, এ কথার কোনো যুক্তি নেই। যাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তাদের একটি অংশ জড়িত বলেই লাখ লাখ টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করি।

এএসএস/এইচএ/জেআইএম

আইন বলেই সিঙ্গাপুর থেকে এক সময় অর্থ ফেরত আনা হয়েছে। তার মানে প্রমাণ আছে। একবার করে থাকতে পারলে এখন পারবো না কেন? এই প্রশ্নের জবাব সরকারের কাছেই আছে

কীভাবে টাকা বাইরে যাচ্ছে, তা কাস্টম জানে। বেশিরভাগ অর্থই কাস্টম হয়ে যায়। সামান্য কিছু হুন্ডি বা ব্যক্তি বহন করে। তার মানে চাইলেই প্র্যাক্টিক্যালিই কাস্টমের মাধ্যমে পাচার রোধ করা সম্ভব। এখানে হাত দেওয়া হচ্ছে না কেন? তার মানে এখানে প্রভাবশালী মহল জড়িত

রাজনৈতিক সংকটের কারণে বাইরে বিনিয়োগ করছেন, এই কথার কোনো যুক্তি নেই। যাদের নিয়ন্ত্রণ করার কথা, তাদের একটি অংশ জড়িত বলেই লাখ লাখ টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে বলে বিশ্বাস করি

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।