আলু সংরক্ষণে সমীক্ষা ছাড়াই ঘর নির্মাণের প্রস্তাবে প্রশ্ন
আলু সংরক্ষণের জন্য চাষিদের বসতবাড়ির উঁচু, খোলা ও আংশিক ছায়াযুক্ত স্থানে বাঁশ, কাঠ, টিন, ইটের গাঁথুনি ও আরসিসি পিলারে মডেল ঘর নির্মাণের চিন্তা করছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এজন্য ‘আলুর বহুমুখী ব্যবহার, সংরক্ষণ ও বিপণন উন্নয়ন’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে তারা। অবশ্য কয়েক বছর আগে এ নিয়ে একটি পাইলট কর্মসূচি বাস্তবায়ন হয়েছিল। তারপরই বিস্তৃত পরিসরে এমন মডেল ঘর নির্মাণ করতে চাইছে অধিদপ্তর।
কিন্তু যে প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে, সেখানে আলু সংরক্ষণে ঘর বানানোর ফলে চাষিরা কতটুকু উপকৃত হবে, স্থানীয় বাজারে তার কী প্রভাব পড়বে, আলুর মূল্যের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়বে কি না, এ ধরনের কোনো গবেষণালব্ধ নেই। বাঁশের ঘর কতদিন টিকবে, এর অর্থনৈতিক লাভ কী হবে, এ বিষয়েও কোনো সমীক্ষা হয়নি। এমনকি টিনের ঘরে সংরক্ষণ করলে অতিরিক্ত গরমে আলু নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে যে শঙ্কা থেকে যায়, সে বিষয়েও কিছু বলা নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, কৃষকের জমিতে আলু সংরক্ষণের জন্য ঘর তৈরির প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে চাষিদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হবে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ দূর করার কোনো কথা নেই।
এভাবে কোনো গবেষণালব্ধ বা সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পটি প্রস্তাব করায় এটির বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। এই প্রকল্প নিয়ে সম্প্রতি কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা হয়। তাতে এসব প্রশ্ন তোলা হয়।।
সভায় পরিকল্পনা কমিশন জানায়, প্রকল্পের আওতায় চাষিদের বসতবাড়ির উঁচু, খোলা ও আংশিক ছায়াযুক্ত আলু সংরক্ষণের মডেল ঘর আলু নির্মাণ করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রস্তাবিত এ সংরক্ষণ ঘরসমূহ বিজ্ঞানসম্মত নয়, এটা প্রমাণিত। কারণ টিন দিয়ে নির্মিত ঘরগুলো গরম হয়ে যায়, যার ফলে আলু নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।
৪২ কোটি ৭৬ লাখ ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২৫ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তাবিত এ প্রকল্প দলিলে সামগ্রিক বিষয়াবলী দুর্বলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে উল্লেখ করে কমিশনের সভায় বলা হয়, প্রকল্পটি যথাযথভাবে প্রস্তুত করা হয়নি।
অবশ্য কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ২০১৫-১৮ মেয়াদে বসতবাড়িতে আলু সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণন কার্যক্রম শীর্ষক কর্মসূচির মাধ্যমে ১১টি জেলার ৪০টি উপজেলায় আলু সংরক্ষণের জন্য ঘর নির্মাণ করেছে। কর্মসূচি সমাপ্তির পর মন্ত্রণালয় থেকে মনিটরিং করা হয়। মনিটরিং প্রতিবেদনে সুপারিশ ছিল যে, রংপুরে এবং দেশের যেসব অঞ্চলে আলু উৎপাদন হয় সেখানেও এমন ঘর তৈরি করা যায়। ২০১৮ সালে নির্মাণ ঘরসমূহ বর্তমান সময় পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী রয়েছে।
নতুন প্রকল্পের আওতায় দেশের সাতটি অঞ্চলের ১৭টি জেলার ৭৬টি উপজেলায় ৪৫০টি মডেল ঘর নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন মনে করছে, একজনের জমিতে ঘর করলে আলু সংরক্ষণকারী অন্যান্য কৃষকদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হবে কি না এটা নিয়ে চিন্তা করা জরুরি। গৃহ পর্যায়ে মাচা পদ্ধতিতে আলু সংরক্ষণ লাভজনক কি না, এভাবে সংরক্ষিত আলুর পুষ্টিমান অক্ষুণ্ন থাকবে কি না, আলুর বাজারমূল্যে কী ধরনের প্রভাব পড়বে ইত্যাদি বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর গবেষণা-সমীক্ষা পরিচালনা করতে পারে।
সভায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তর পরিকল্পনা কমিশনকে জানায়, যেসব কৃষকের জমিতে মডেল নির্মাণ করা হবে তারা এরই মধ্যে ঘর নির্মাণের জন্য তাদের বাড়ির আঙিনার উঁচু ছায়াযুক্ত স্থান নির্দিষ্ট করে ঘর নির্মাণের জন্য লিখিতভাবে সম্মতি দিয়েছেন। ঘরগুলোর স্থায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মাধ্যমে গবেষণা করা হয়েছে। রংপুর বিভাগে কর্মসূচির মাধ্যমে নির্মিত ঘরসমূহ এখনো পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী রয়েছে।
এ বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) রমেন্দ্র নাথ বিশ্বাস বলেন, প্রকল্পের কার্যক্রমসমূহ কীভাবে বাস্তবায়িত হবে সে বিষয়টি প্রস্তাবে যথার্থভাবে প্রতিফলিত হয়নি। কারণ প্রকল্পটি গ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের স্টাডি বা সমীক্ষা নেই। পূর্বের বাস্তবায়িত কর্মসূচির মাধ্যমে ৪০টি আলু সংরক্ষণ ঘর বানানোর ফলে আলুচাষিরা কতটুকু উপকৃত হলো, স্থানীয় বাজারে তার কী প্রভাব পড়েছে, আলুর মূল্যের ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব পড়েছে কি না এ ধরনের কোনো গবেষণালব্ধও নেই প্রস্তাবে।
প্রস্তাবিত এ প্রকল্প নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সরকারের একমাত্র প্রকল্প তদারকি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগও (আইএমইডি)। আইএমইডি জানায়, প্রকল্পটিতে প্রস্তাবিত মডেল ঘরসমূহ ব্যক্তি জমিতে নির্মাণ করার কথা বলা হয়েছে। তবে যার জমিতে নির্মাণ করা হবে তিনি জমিটি দান করবেন কি না সে বিষয়টি পরিষ্কার নয়। যদি জমি না দেন তবে অন্য একজনের জমিতে সরকারি অর্থায়নে ঘর নির্মাণ করলে স্থানীয়দের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে।
যখন প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হবে তখন দেখা যাবে হয়তো জমির মালিক একাই ঘরটি ব্যবহার করবেন। অন্যদের কোনো সুযোগ দেবেন না। প্রস্তাবিত ৪৫০টি মডেল ঘরের জন্য জমি পাওয়া যাবে কি না, তৈরিকৃত ঘরটির স্থায়িত্ব কেমন হবে সে বিষয়ে কোনো গবেষণালব্ধ উপাত্ত নেই। প্রকল্পটির কার্যক্রম এবং বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বাস্তবসম্মত নয়।
তবে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (রংপুর বিভাগ) মো. আনোয়ারুল হক জাগো নিউজকে বলেন, প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করার জন্যই প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়েছে। আমরা কিছু আলু সংরক্ষণাগার নির্মাণ করবো। বাঁশের বেড়া বিশেষভাবে নির্মাণ করবো। টিনের নিচে ককশিট দেবো, যাতে ওসব সংরক্ষণাগার গরম না হয়ে যায়।
আলু চাষিদের মধ্যে বিরোধের আশঙ্কা প্রসঙ্গে আনোয়ারুল হক বলেন, যার বাড়িতে ঘর করতে হবে তাকে কিছু সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। ১৫ থেকে ২০ বছর যাবে একটা ঘর। একটি ঘরে মাত্র ৩০ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা যাবে। এটা মডেল মাত্র। এগুলো দেখে অন্য চাষিরা উৎসাহিত হবেন। ঘরগুলো নির্মিত হলে চাষিরা উপকৃত হবেন।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের উদ্দেশ্য
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশে আলুর চাহিদা রয়েছে এবং আলু উৎপাদন হচ্ছে। কিছু যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে কাঙ্ক্ষিত মানের আলু বাজারে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এসব কারণেই প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয়েছে। গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) দেশে আলুর উৎপাদন হয়েছিল এক কোটি নয় লাখ ১৭ হাজার টন। অধিদপ্তরের হিসাব মতে, দেশে বছরে আলুর চাহিদামাত্র ৭৭ লাখ টন। হিমাগারে ২৮ থেকে ৩০ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করা যায়। বাকি আলু পঁচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সেজন্য প্রস্তাবিত প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, আলুচাষিদের উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তার জন্য গৃহপর্যায়ে সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও আলুর বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি করা হবে। টেকসই বিপণন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সরকারের দারিদ্র্য কমানোর উদ্যোগকে জোরালো করা হবে।
সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, প্রতিটি মডেল ঘরকেন্দ্রিক ৩০ জনের সমন্বয়ে একটি করে মোট ৪৫০টি কৃষক বিপণন দল গঠন করে বিপণন সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আলু চাষিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করা হবে। আলুর বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮ হাজার ৯০০ জন কৃষক, কৃষি ব্যবসায়ী, কৃষি উদ্যোক্তা ও কৃষি প্রক্রিয়াজাতকারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আলুর উপযুক্ত মূল্য প্রাপ্তিতে সহায়তার লক্ষ্যে রপ্তানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকারীদের সঙ্গে ৪৫০টি কৃষক বিপণন দলের সংযোগ স্থাপনের ব্যবস্থা করা হবে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের মূল কার্যক্রম
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কৃষক বিপণন দল গড়ে ৪৫০ ব্যাচে, উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের জন্য ১২০ ব্যাচে, কৃষক, কৃষি ব্যবসায়ী ও কৃষি উদ্যোক্তাদের রপ্তানি সহায়ক প্রশিক্ষণের জন্য ৮০ ব্যাচে মোট ১৮ হাজার ৯০০ জনকে এবং প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য (টিওটি) ১৬ ব্যাচে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। অভিজ্ঞতা বিনিময় সফর (মোটিভেশনাল ট্যুর) ৮ ব্যাচ, আলু সংরক্ষণের জন্য মডেল ঘর নির্মাণ ৪৫০টি , ভূমি উন্নয়ন মডেল ঘরের জন্য মাটি ভরাট করা হবে ২২ হাজার ৯৫০ ঘনমিটার।
এ প্রকল্পের আওতায় রংপুর কৃষি বিপণন ভবনের পঞ্চম তলার ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ সাড়ে ৩ হাজার বর্গফুট, রংপুর কৃষি বিপণন ভবন মেরামত ও সংস্কার (চতুর্থ তলা পর্যন্ত) ১৪শ’ বর্গফুট এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে ১১টি সেমিনার–ওয়ার্কশপ হবে।
পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের এক প্রতিনিধি সভায় জানান, প্রকল্পটির আওতায় নির্মাণ ও খাতে রংপুর কৃষি বিপণন ভবনের পঞ্চম তলার ঊর্ধমুখী সম্প্রসারণের (৩,৫০০ বর্গফুট) স্থান রাখা হয়েছে। ভবনটি চতুর্থ তলা থেকে পঞ্চম তলা সম্প্রসারণের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা জানা প্রয়োজন। এছাড়া এ ধরনের প্রকল্প পরিচালনায় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সক্ষমতা রয়েছে কি না তা বিবেচনা করে দেখতে হবে।
এ বিষয়ে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের এক প্রতিনিধি বলেন, বিদ্যমান চতুর্থ তলা ভবনটির প্রথম তলায় যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হয়েছে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা পর্যন্ত দাপ্তরিক কাজে এবং চতুর্থ তলাটি ডরমিটরি রুম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মূলত (পঞ্চম তলা পর্যন্ত) এ সম্প্রসারণের মূল উদ্দেশ্য হলো ভবনটিতে প্রশিক্ষণ সুবিধা সৃষ্টি করা।
এমওএস/এমআরএম/এইচএ/এএসএম