শীতলক্ষ্যায় মাত্রাতিরিক্ত দূষণ, মেঘনার পানিতেই ওয়াসার আস্থা
ঢাকা মহানগরীর মতিঝিল, পল্টন, ফকিরাপুল, উত্তরা, গুলশান, বনানী, নিকুঞ্জ, খিলক্ষেত, বাড্ডাসহ পুরো মিরপুর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে প্রয়োজনের তুলনায় পানি সরবরাহ কম। এসব এলাকায় পানি সরবরাহের মূল উৎস ভূগর্ভস্থ গভীর নলকূপগুলোর উত্তোলন ক্ষমতা প্রতিনিয়ত কমছে। খারাপ হচ্ছে শীতলক্ষ্যা নদীর পানির মান। কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে পানি পরিশোধন। ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদা মেটাতে ঢাকাবাসীকে আরও বেশি করে মেঘনা নদীর পানি খাওয়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
শীতলক্ষ্যার চেয়ে মেঘনা নদীর পানির মান অনেক ভালো বলে মনে করে ঢাকা ওয়াসা। শীতলক্ষ্যা নদী বাংলাদেশের উত্তর-কেন্দ্রীয় অঞ্চলের নরসিংদী, গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি নদী। ভয়াবহ দূষণ, আবর্জনা আর দখলের কবলে নদীটি আজ মৃতপ্রায়। আদি ব্রহ্মপুত্র নদ থেকে সৃষ্ট এই স্রোতস্বিনী তার পূর্ব রূপ হারিয়েছে। নদীর দুই পাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, শীতলক্ষ্যার তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা কারখানার বর্জ্য নদী দূষণের প্রধান কারণ। নদীর পানি এখন এতটাই দূষিত যে, সেখানে জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে।
শীতে শীতলক্ষ্যার পানি কালো রং আরও প্রগাঢ় হয়ে আলকাতরায় রূপ নিয়েছে। সঙ্গে বেড়েছে উৎকট গন্ধও। তবে বর্ষায় নদীর পানি কিছুটা পরিষ্কার হলেও শুষ্ক মৌসুমে এ নদীর পানি একেবারেই ব্যবহার যোগ্য থাকে না। এ কারণেই শীতলক্ষ্যার পরিবর্তে বেশি করে মেঘনা নদীর পানি ব্যবহারের উদ্যোগ নিচ্ছে ওয়াসা।
চলমান ‘এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই’ প্রকল্পের সময়-ব্যয় বাড়িয়ে এ উদ্যোগ নেওয়া হবে। ওয়াসার নিজস্ব জায়গায় মেঘনা নদী থেকে পানি সরবরাহ করে প্রথম পর্যায়ে ৫০০ এমএলডি (মিলিয়ন লিটার পার ডে/প্রতিদিন ৫০ কোটি লিটার) ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫০০ এমএলডি পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম পর্যায়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। বর্তমানে প্রকল্পের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের সুবিধার্থে দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে। মূলত ঢাকাবাসীকে আরও অতিরিক্ত ৫০০ এমএলডি মেঘনার পানি সরবরাহের জন্যই প্রকল্পটি সংশোধন করা হচ্ছে।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল পাঁচ হাজার ২৪৮ কোটি টাকা। পরে প্রস্তাবিত সংশোধনে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৫১ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাবে প্রকল্পের ব্যয় কমে দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা। ফলে প্রকল্পের ব্যয় ৪ কোটি টাকা কমছে।
প্রকল্পটি একনেক সভায় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে অনুমোদন পায়। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মেয়াদে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল একনেক সভায়। প্রথম সংশোধনীতে প্রকল্পের মেয়াদ তিন বছর বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন নাগাদ সময় বাড়ানো হয়। বর্তমানে প্রকল্পের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো ও কতিপয় খাতের ব্যয় কমানোসহ দ্বিতীয় সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে প্রকল্পের মোট ব্যয় ৪ কোটি টাকা কমানোর প্রস্তাব করা হলেও মেয়াদ বাড়ছে দুই বছর। নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন নাগাদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব করেছে ঢাকা ওয়াসা।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মো. মামুন আল-রশীদের সভাপতিত্বে পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘ঢাকা এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রজেক্ট’র আওতায় এই সময় বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ওয়াসা।
প্রস্তাব যাচাই করার জন্য মেঘনা নদীর পাড় সরেজমিনে পরিদর্শন করা হয়। মো. মামুন আল-রশীদসহ সংশ্লিষ্টরা মেঘনা নদী পরিদর্শন করেন। এসময় দেখা যায়, মেঘনা নদীর পাড়েও অনেক কলকারখানা গড়ে উঠেছে। নদী দূষণরোধে শিল্প মালিকদের কলকারখানার কেমিক্যালযুক্ত তরল বর্জ্য শোধনাগার বা ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপনের তাগাদা দেওয়া হয়। নদী ও খালের পানি দূষণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে শিল্প-কারখানার অপরিশোধিত তরল বর্জ্য। ইটিপি প্ল্যান্ট স্থাপনের বিষয়ে সবাই একমত হন।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) মো. মামুন আল-রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, এনভায়রনমেন্টালি সাসটেইনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্পটি চলমান। প্রকল্পের আওতায় মেঘনা নদীর পানি ঢাকায় সরবরাহ করা হচ্ছে। আরও বড় পরিসরে মেঘনার পানি ঢাকায় সরবরাহ করা হবে। এজন্য চলমান প্রকল্পের মেয়াদসহ বেশকিছু বিষয় সংশোধন হতে পারে। পানির সোর্সে কোনো সমস্যা নেই। নদী এলাকায় অনেক শিল্প-কারখানা রয়েছে। এসব শিল্প-কারখানায় ইটিপি স্থাপন করা হলে মেঘনা নদীর পানি অনেক দিন সোর্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারবো। সেই প্রভিশনও রয়েছে মেঘনা নদীর পানি ঢাকায় সরবরাহের জন্য।
ঢাকা ওয়াসা জানায়, ক্রমবর্ধমান পানির চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ ঘণ্টা নগরবাসীর জন্য পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে। সেই লক্ষ্যে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূউপরিস্থ উৎস থেকে পানি ব্যবহারের জন্য কয়েকটি পানি শোধনাগার নির্মাণ কার্যক্রম চলমান।
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, চলমান প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুমোদিত হয়। প্রথম সংশোধনী অনুমোদনের মাত্র কয়েক মাস পরই দ্বিতীয় সংশোধনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পটি পুনরায় সংশোধনের কারণ সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (আরডিপিপি) যথাযথভাবে উপস্থাপন করা হয়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহমুদুল ইসলাম পরিকল্পনা কমিশনকে জানান, সম্প্রতি প্রকল্পের প্রথম সংশোধন করা হলেও বর্তমানে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ কারণে পুনরায় সংশোধনের প্রয়োজন হচ্ছে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (এডিএফ) আওতায় অনুদান হিসেবে আরও পাঁচ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিশ্রুতি এসেছে, যা দিয়ে ঢাকায় উইমেন এম্পাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড স্যানিটেশন ইমপ্রুভমেন্টের কাজ করা হবে। এ খাতের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন বস্তি এলাকায় গোসল সুবিধাসহ মোট নির্মাণ করা হবে ৮০০ টয়লেট। এছাড়া এই কাজ পরিচালনায় নিয়োজিত করা হবে দুটি এনজিও-ফার্ম ও ছয়টি ব্যক্তি পরামর্শক।
ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, প্রকল্পের ইনটেক, পানি শোধনাগার, অপরিশোধিত পানির পাইপলাইন নির্মাণকাজের ব্যয় বৃদ্ধি, এমডিএসসি (ম্যানেজমেন্ট, ডিজাইন, সুপারভিশন কনসালট্যান্ট) পরামর্শকসহ এনজিও প্যাকেজের ব্যয় বৃদ্ধি, জনবলের বেতন-ভাতা, অফিস রক্ষণাবেক্ষণ কাজের ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া ক্ষতিপূরণ, রোড কাটিং চার্জ, সিডি-ভ্যাট, ট্যাক্স ইত্যাদি খাতের ব্যয় কমানোর কারণে প্রকল্পের মেয়াদ জুন ২০২৪ পর্যন্ত বাড়ানোসহ দ্বিতীয় সংশোধনের প্রয়োজন হচ্ছে।
ঢাকায় বর্তমানে প্রতিদিন পানির চাহিদা ২৫০ থেকে ২৫৫ কোটি লিটার। বিপরীতে ঢাকা ওয়াসার প্রতিদিন ২৬০ কোটি লিটারের বেশি পানি সরবরাহের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু সরবরাহ করতে গিয়ে প্রায় অর্ধেক পানি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় নগরবাসীর একটা বড় অংশ পর্যাপ্ত পানি পাচ্ছে না। এছাড়া ঢাকায় বর্তমানে দুই কোটিরও বেশি মানুষ বসবাস করছে। প্রতি বছর ঢাকা শহরে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হয়, যা দিনে ১ হাজার ৭০০। বাড়তি মানুষের পানির চাহিদা মেটাতে বড় পরিসরে মেঘনার পানি ঢাকায় সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা।
এমওএস/এএ/এমএস