সাবেক যুগ্ম সচিবরাও হতে পারবেন বিমার উপদেষ্টা, দ্বিমত সিইওদের
বিমা কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেতে একই শ্রেণির বিমা কোম্পানিতে মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে কমপক্ষে ১০ বছর সফলভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। পাশাপাশি সরকারের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব বা তার ওপরের পদে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তারাও হতে পারবেন উপদেষ্টা।
এমন বিধান রেখে ‘বিমাকারীর উপদেষ্টা নিয়োগ প্রবিধানমালা, ২০২১’ নামে বিমা কোম্পানির উপদেষ্টা নিয়োগ সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবিধানমালা তৈরি করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন এ খাত সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা।
তারা বলছেন, বিমা কোম্পানিতে উপদেষ্টারা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তারা সরাসরি পলিসি মেকিংয়ের সঙ্গে জড়িত। তাই বিমা পেশার দক্ষ ও অভিজ্ঞদের উপদেষ্টা হওয়ার বিধান করা উচিত। সিইও হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই এমন কাউকে উপদেষ্টা হওয়ার সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না।
অন্যদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ’র পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিমা খাতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। এ কারণে সরকারের অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব বা তার ওপরের পদে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের উপদেষ্টা হওয়ার বিধান করা হচ্ছে। ফলে আইডিআরএতে দায়িত্বপালন করে দক্ষতা অর্জকারীরা বিমা কোম্পানির উপদেষ্টা হতে পারবেন।
খসড়া প্রবিধানমালায় বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে একজনকে তিন বছরের জন্য উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে। মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ ও অপসারণ প্রবিধানমালা অনুযায়ী- শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি যিনি একই শ্রেণির বিমা ব্যবসার মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ চুক্তির শর্ত মোতাবেক ১০ বছর সফলভাবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ আবেদনের জন্য যোগ্য হবেন।
এছাড়া সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কোনো যুগ্ম সচিব বা এর উপরের পদের কর্মকর্তা যার কাজ করার সক্ষমতা আছে এবং মন্ত্রণালয় বা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠানে বিমা বিষয়ক কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তিনি উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের জন্য যোগ্য হবেন বলে খসড়া প্রবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্সের সিইও মো. জালালুল আজিম জাগো নিউজকে বলেন, এ খাতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকের অভাব রয়েছে। এ কারণে সিইও’র দায়িত্ব পালনকারীদের উপদেষ্টা করা হয়। তাছাড়া তিনি দীর্ঘদিন সিইও থাকার কারণে তার একটা গ্রাহক সার্কেল থাকে। উনি যদি চলে যান কোম্পানি ওই ব্যবসা হারাতেও পারে। ফলে সিইও হিসেবে দায়িত্বপালনকারীকে উপদেষ্টা করা হলে সার্বিকভাবে কোম্পানির জন্য ভালো হয়।
তিনি বলেন, উপদেষ্টা হলেন একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি ব্যবসার বিষয়ে সরাসরি উপদেশ দেন। যেসব কোম্পানিতে ভালো অভিজ্ঞ সিইও থাকেন, তাদের উপদেষ্টার দরকার হয় না। উপদেষ্টা মোটামুটি স্বাধীনভাবে কাজ করেন। যে কারণে তিনি পরিচালনা পর্ষদকে অনেক কথা বলতে পারেন এবং পর্ষদ তার মতামতের গুরুত্ব দেয়। সুতরাং যিনি অভিজ্ঞ ও দক্ষ তাকেই উপদেষ্টা করা উচিত। আমি মনে করি, বিমা কোম্পানির সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অভিজ্ঞদের উপদেষ্টা করা উচিত।
এ নিয়ে পাইওনিয়ার ইন্স্যুরেন্সের সিইও তারিক উর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষই উপদেষ্টা হচ্ছে। যারা আর সিইও হিসেবে চাকরি করতে পারছেন না, তাদের উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হচ্ছে। বিমা পেশার অভিজ্ঞতা নেই এমন ব্যক্তিদের উপদেষ্টা করা হলে লাভ হবে না।
অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাকে উপদেষ্টা করা হলে সুফল পাওয়া যাবে কি না? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, না, তারা সুবিধা করতে পারবেন না। বিমা খুবই টেকনিক্যাল জিনিস। উপদেষ্টারা পলিসি মেকিংয়ের কাজ করেন। এমনকি সিইও’র মূল কাজ উপদেষ্টরাই করেন।
বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমি মনে করি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তি উপদেষ্টা হতে পারেন। কোনো যুগ্ম সচিব বা সচিব, এমন ধরনের ব্যক্তি হলেই তিনি উপদেষ্টা হতে পারবেন এটা ঠিক না। যে খাতই হোক উপদেষ্টা হতে হলে সে খাত সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সবকিছুর জ্ঞান থাকতে হবে। উপদেষ্টা একজন অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি।
এ বিষয়ে আইডিআরএ’র মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক এস এম শাকিল আখতার জাগো নিউজকে বলেন, বিমা খাতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। কেউ আইডিআরএতে নির্বাহী পরিচালক পদে কাজ করলে তার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়। জীবন বীমা করপোরেশন ও সাধারণ বীমা করপোরেশনে দুই-তিন বছর এমডি পদে কাজ করলে তারা বিমা সম্পর্কে জানেন। এসব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা যাতে উপদেষ্টা হতে পারেন এজন্য অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের বিমা কোম্পানির উপদেষ্টা হওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। যদি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন যোগ্য ব্যক্তি না পাওয়া যায়, সেজন্য আমরা সুযোগ বাড়িয়ে রাখতে এটা করেছি। এছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।
উপদেষ্টার দায়িত্ব ও কর্তব্য
উপদেষ্টা বিমা কোম্পানির বিনিয়োগ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক কার্যক্রম, ব্যবসায় উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা ব্যয় নিয়ন্ত্রণসহ বিমা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক বিষয়ে পরিচালনা পর্ষদ এবং মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপদেশ ও পরামর্শ দেবেন। তবে বিমা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বিমা গ্রাহকের স্বার্থের পরিপন্থি কোনো বিষয় পরিলক্ষিত হলে তা পরিচালনা পর্ষদ ও কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবেন।
উপদেষ্টার পারিতোষিক ও অন্যান্য সুবিধাদি
>> উপদেষ্টা পদ বিমা কোম্পানির জনবল কাঠামোতে স্থায়ী পদ হিসেবে গণ্য হবে না।
>> চুক্তিভিত্তিক উপদেষ্টার পারিতোষিক ও অন্য শর্ত বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসরণ করে আর্থিক মানদণ্ডে নির্ধারিত হবে, যা নিয়োগ চুক্তিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।
>> উপদেষ্টার সুযোগ-সুবিধা নির্ধারণের ক্ষেত্রে উপদেষ্টার অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, বিমা কোম্পানির কাজের পরিধি, আর্থিক অবস্থা, ব্যবসার পরিমাণ ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরিচালনা পর্ষদ নির্ধারণ করবে।
>> চুক্তির মেয়াদকালে চুক্তিপত্রের শর্তাবলীতে নির্দিষ্ট পারিতোষিক ও অন্যান্য সুবিধার শর্ত পরিবর্তন করা যাবে না এবং নবায়নের সময় উপদেষ্টার কাজের যোগ্যতা বিবেচনা করে বেতন পুনঃনির্ধারণের প্রস্তাব পেশ করা যাবে।
উপদেষ্টা নিয়োগে অযোগ্যতা
>> তিনি বা তার পরিবারের কোনো সদস্য সংশ্লিষ্ট বিমা কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার বা পরিচালক বা মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হন।
>> বাংলাদেশের নাগরিক বা বাংলাদেশের ডমিসাইল না হলে।
>> শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে দায়িত্ব পালনে অক্ষম।
>> কোনো উপযুক্ত আদালত কর্তৃক দেউলিয়া বা অপ্রকৃতিস্থ ঘোষিত হলে।
>> কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণখেলাপি ঘোষিত হলে।
>> নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে আদালতে অন্যূন ৬ মাস বা তদূর্ধ্ব মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং ওই দণ্ড থেকে মুক্তি লাভের পর পাঁচ বছর সময় অতিক্রান্ত না হলে।
>> অন্য কোনো বিমা কোম্পানি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কোনো পদে থাকাকালে তার পদের ক্ষমতার অপব্যবহার বা দুর্নীতির কারণে অপসারিত হলে।
>> কোনো ব্যাংক, বিমা বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হলে।
>> কোনো কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগের অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছেন।
এমএএস/এমএইচআর/এএ/জিকেএস