কৃষকের ধানের মণ ৪৩ কেজিতে, ব্যবসায়ীর সাড়ে ৪০
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের ধানমহল। ঐতিহাসিক ধানের বাজার। কথিত আছে, বাজারটির যাত্রা শুরু ব্রিটিশ আমলে। সাধারণ কৃষকরা নিজেদের শ্রমে-ঘামে ফলানো ধান এখানে বিক্রি করতে আসেন। তবে শতাব্দীপ্রাচীন ধানমহলে অসাধু সিন্ডিকেটের মহাজনদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন সাধারণ কৃষকরা। ধানের ওজনে কারসাজি করে দিনের পর দিন ঠকানো হচ্ছে তাদের। কৃষকদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ঠকিয়ে যাচ্ছেন সিন্ডিকেটের মহাজনরা।
সরেজমিনে হালুয়াঘাটের ধানমহল ঘুরে জানা গেছে, এখানে কৃষক যদি ৪০ কেজি ধান বিক্রি করেন তাহলে তাকে ৩৭ কেজির দাম দেওয়া হয়। কৃষক যদি মহাজনের কাছে ৪৩ কেজি ধান দেন, তবেই তিনি এক মণের দাম পান। ফলে প্রতি মণে তিন কেজি ধানের দাম পাচ্ছেন না কৃষক। প্লাস্টিকের বস্তার ‘ওজন’র কথা বলে কৃষকের কাছ থেকে তিন কেজি ধান বেশি নেওয়া হচ্ছে। অথচ বাজারে প্রচলিত একটি প্লাস্টিকের বস্তার ওজন ২০০-৩০০ গ্রামের বেশি হওয়ার কথা নয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষক মণে ৪০ কেজি নিতে বললে কোনো ব্যবসায়ী তার কাছ থেকে ধান কেনেন না। অগত্যা বাধ্য হয়েই কৃষক এক মণের দাম পেতে বাড়তি তিন কেজি ধান দিচ্ছেন ব্যবসায়ীদের। এই বঞ্চনায় ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগী কৃষকরা। তারা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতিকার চেয়েছেন।
হালুয়াঘাট রুস্তম পাড়ার কৃষক নূরে আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘হালুয়াঘাট ধানমহলে প্রতিদিনই ধান কেনাবেচা হয়। আমরা কৃষক এখানে ধান বিক্রি করি। এখানে ৪৩ কেজিতে এক মণ ধরে বিক্রি করি। ৪০ কেজিতে মণ হলেও আমরা ৪৩ কেজি ধান মহাজনকে দেই, তবেই এক মণের দাম পাই।’
এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদ করেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা যদি ৪০ কেজির বস্তায় মাইপা নিয়া আসি, তাহলে ওনারা (মহাজন) আমাদের ৩৭ কেজির দাম দেন। ওনারা বলেন যে, প্রতি মণে তিন কেজি বেশি দিতে হবে। যদি না দেই তাহলে ওনারা ধান কিনবেন না। এই বাজারের প্রতিটা ব্যবসায়ী কৃষকের সঙ্গে এমন করেন। আমরা প্লাস্টিকের বস্তায় ধান বিক্রি করি। তারপরও প্রতি মণে আমাদের তিন কেজি ধান বেশি দিতে হয়। এই নিয়ে ইউএনও স্যার জরিমানা করেছেন, তারপরও এরা থেমে নেই। কৃষক হিসেবে আমার দাবি, ধান আমাদের কষ্টের ফসল, ধান ফলাতে অনেক কষ্ট করি, ধানগুলো যদি সঠিক মাপে বিক্রি করতে পারি, তাহলে অর্থনৈতিকভাবে আমরা উপকৃত হতাম। আমরা মণে ৪০ কেজি ধান দিতে চাই।’
হালুয়াঘাটের ধানমহল থেকে প্রতিদিন ১৬ থেকে ২০ ট্রাক ধান দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। বৃহস্পতিবার ধানমহল জমে ওঠে বেশি। সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে ধানের যে দাম মিলছে, তাতে খুশি কৃষক। আমনের মৌসুমে নভেম্বরজুড়েই জমজমাট থাকে এ ধানমহল। এ বছর প্রতি মণ ব্রি ৫৯ ধান এক হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১০০ টাকা, প্রতি মণ রঞ্জিত ধান এক হাজার, ব্রি ৫১ ধান ৯৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এছাড়া প্রতি মণ মোটা সোনালি ৯৪০ ও প্রতি মণ স্বর্ণা-৫ ধান ৯৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। এই বাজারে স্বর্ণা-৫ ধানকে স্থানীয়রা মশুরি ধান নামে ডাকেন। ধানের দাম বাড়তি হলেও মণপ্রতি তিন কেজি ধান বেশি দেওয়ায় প্রতিনিয়ত ঠকছেন কৃষক।
হালুয়াঘাটের ভুক্তভোগী কৃষক হারুণ অর রশিদ বলেন, ‘এই বাজারে ৪৩ কেজিতে মণ ধরে। তারা ৪৩ কেজিতেই নেয়। তারা একটা সমিতি বানিয়ে আইন করে নিয়েছে। পাবলিক যা আছে, সবার কাছ থেকেই নেয়। আমরা বলি ৪০ কেজি মণে ধান নাও, তখন বলে নেওগা তোমার ধান।’
এ বিষয়ে অবশ্য হালুয়াঘাট ধান ব্যবসায়ী সমিতির দাবি ভিন্ন। সমিতির সভাপতি হুমায়ুন কবীর মানিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই বাজারে ৪০ কেজি মণ হিসেবে ধান বিক্রি হয়। কৃষকের কাছ থেকে ধান বেশি নেওয়া হয় না। কোনো ব্যবসায়ী যদি এমন কাজ করেন, তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। কোনো কৃষক যদি আমাদের নিকট কোনো অভিযোগ করেন, তবে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবো।’
আবার কৃষকের কাছ থেকে নেওয়া একই ধান যখন ব্যবসায়ী বা আড়তদাররা মিল মালিকের কাছে বিক্রি করছেন, তখন দুই মণে এক কেজি ধান বেশি দিচ্ছেন।
হালুয়াঘাট ধানমহলের আড়তদাররা শেরপুরের অনেক মিল মালিকের কাছে ধান বিক্রি করেন। তার মধ্যে অন্যতম শেরপুরের ওয়াহেদ অটোরাইস মিল। রাইস মিলটির মালিক মো. হায়দার আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘আড়তদাররা আমাদের দুই মণ ধানে ঢলন হিসেবে এক কেজি বেশি দিয়ে থাকেন। এখন কৃষকের ক্ষেত্রে যদি ৪৩ কেজিতে মণ ধরা হয় তবে এটা অন্যায়।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্যবসায়ীদের এ কারসাজির কথা জেনে একবার হালুয়াঘাট উপজেলার ধারা বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযানে এসেছিল। তখন ওজনে কারসাজির প্রমাণ পেয়ে পাঁচ ধান ব্যবসায়ীকে ১০ হাজার টাকা করে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। তারা হলেন ধারা বাজারের সাইদ ট্রেডার্সের আ. হাই, তাসিন এন্টারপ্রাইজের বিপুল ইসলাম, ধান ব্যবসায়ী রেজাউল করিম, হুমায়ূন কবির ও হালুয়াঘাটের ইমন ট্রেডার্সের আবদুস সালাম।
ধান ব্যবসায়ীদের কারসাজি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এর আগেও বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছিল। আমরা কয়েকজন মহাজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা যখন ফিল্ড ভিজিটে যাই তখন সবাই কৃষককে ঠকানোর বিষয়টি অস্বীকার করে।’
কৃষকের ধান বেশি নেওয়া প্রসঙ্গে ইউএনও আরও বলেন, ‘কখনোই ৪৩ কেজিতে মণ হতে পারে না। আমি কৃষকের সন্তান। বিষয়টি মেনে নেওয়া যায় না। আমি আবারও সিভিলে ফিল্ড ভিজিটে কোনো আড়তদারের কারসাজি ধরতে পারলে যথাযথ ব্যবস্থা নেবো। কৃষকের কষ্টের ধান নিয়ে কারসাজি করতে দেবো না।’
এমওইএস/এমএইচআর/এইচএ/জেআইএম