পণ্য রপ্তানিতে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে বেশি প্লেনভাড়া বাংলাদেশে
বাংলাদেশ থেকে সড়ক, নৌ ও আকাশপথে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিদেশে। সড়কে যাওয়া পণ্যগুলোর গন্তব্য কম দূরত্বের দেশগুলো। প্লেন বা উড়োজাহাজে বেশি যাচ্ছে পচনশীল পণ্য। কিন্তু রপ্তানির সবচেয়ে বড় কারবার হচ্ছে জাহাজের মাধ্যমে। বিশ্বের প্রায় ১৪০টি দেশে পণ্য যাচ্ছে নৌপথে। বর্তমানে এ তিন পথেরই বড় সমস্যা বাড়তি ভাড়া। পাশাপাশি অন্য সমস্যাও রয়েছে। সেসব সমস্যার বিষয়ে জাগো নিউজের তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় আকাশপথে। তারপরও সবচেয়ে দ্রুততম পথ হওয়ায় প্লেনে যায় বেশিরভাগ পচনশীল পণ্য। এছাড়া যায় গার্মেন্টস পণ্যও। কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় পার্শ্ববর্তী দেশের প্লেনভাড়া কম। এ কারণে ভারত ও পাকিস্তানের রপ্তানিকারকরা কম খরচে পণ্য পৌঁছাতে পারেন বিদেশে। অন্যদিকে পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় প্রতিযোগীদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা। ফলে চড়া দামের কারণে ক্রেতা হারাচ্ছেন তারা।
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্লেনভাড়ার চিত্র উঠে এসেছে সরকারের শাক-সবজি, ফলমূল ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রস্তুত রোডম্যাপেও। সেখানে দেখানো হয়েছে, বর্তমানে প্লেনে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ পর্যন্ত পণ্য পাঠাতে খরচ হয় কেজিপ্রতি ৩ দশমিক ৩ থেকে ৩ দশমিক ৬ ডলার পর্যন্ত। যেখানে ভারতের কলকাতা থেকে একই গন্তব্যে সমপরিমাণ পণ্য পাঠাতে খরচ হয় ২ দশমিক ৮ ডলার থেকে সর্বোচ্চ ৩ ডলার। পাকিস্তান থেকে রপ্তানিতে এ খরচ আরও কম, যা ২ দশমিক ৪ ডলার থেকে আড়াই ডলার পর্যন্ত।
বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহনকারী প্লেনের আরেক বড় গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য। সেখানেও প্লেনভাড়ায় উল্লেখযোগ্য তারতম্য রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে কেজিপ্রতি পণ্যের প্লেনভাড়া গড়ে দেড় ডলার, যা পাকিস্তান থেকে মাত্র দশমিক ৪০ ডলার। অবশ্য একই গন্তব্যে ভারত থেকে কেজিপ্রতি পণ্যের প্লেনভাড়া ১ দশমিক ৮২ থেকে ১ দশমিক ৯১ ডলার পর্যন্ত।
পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে পণ্য পরিবহন ভাড়ার এমন অসামঞ্জস্যতা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে প্লেনে পণ্য পরিবহন ভাড়ায় একটি বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে। কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্লেনে পণ্য পরিবহনে যে ভাড়া নেওয়া হচ্ছে, তা আগের চেয়ে অনেক বেশি।
সংগঠনটির তথ্য মতে, করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে (২০১৯ সাল) ইউরোপে কেজিপ্রতি ২ দশমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৩ ডলারে পণ্য পরিবহন করা যেত, যা এখন ৩ দশমিক ৬ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। আবার মধ্যপ্রাচ্যে প্রতি কেজি পণ্য ১ দশমিক ১৫ ডলারে পাঠানো যেতো, যা উঠেছে গড়ে দেড় ডলারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে ৪০ ধরনের সবজি ও ফল রপ্তানি হচ্ছে আকাশপথে। সবচেয়ে বেশি যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, সৌদি আরব, কুয়েত ও সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইউরোপের যুক্তরাজ্য, ইতালি ও ফ্রান্সে।
এছাড়া বাহরাইন, ওমান, মালয়েশিয়া, সুইডেন, কানাডা, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশেও এসব খাদ্যপণ্য রপ্তানি হয়। সবজি ও ফলের পাশাপাশি দু-তিন ধরনের মাছও রপ্তানি হয় এসব দেশে। এছাড়া দ্রুততম সময়ে পৌঁছানোর জন্য গার্মেন্টস পণ্যও যাচ্ছে একই গন্তব্যে।
বাড়তি ভাড়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকরা। কারণ সবজির বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পণ্যগুলোর ধরন একই। তিন দেশের রপ্তানির গন্তব্যও একই। কিন্তু ভারত-পাকিস্তানের ভাড়া ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বেশি হওয়ার কারণে বিদেশি ক্রেতারা তাদের থেকেই পণ্য কিনছেন বেশি। সম্ভাবনা সত্ত্বেও পিছিয়ে পড়ছেন বাংলাদেশের রপ্তানিকারকরা।
এ বিষয়ে কৃষিপণ্য রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিএফভিএপিইএর সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর জাগো নিউকে বলেন, নানা কারণে আমাদের রপ্তানিখাত বারবার হোঁচট খাচ্ছে। আগে থেকে পার্শ্ববর্তী দেশের তুলনায় আমাদের পণ্য পরিবহন খরচ বেশি ছিল। এরপর আবার এখন করোনা-পরবর্তী সময়ে ভাড়া বেড়েছে।
তিনি বলেন, সব কিছু হিসাব করে এ দেশের রপ্তানিকারকরা কম দামে পণ্য দিতে পারেন না। এ কারণে বিদেশি ক্রেতারা ভারত-পাকিস্তানকে বেছে নিচ্ছেন। পণ্য পরিবহন ভাড়া যাত্রীবাহী প্লেনের চেয়েও তিনগুণ বেশি। ভাড়া এ দেশের রপ্তানিখাতের জন্য বড় প্রতিবন্ধকতা।
জানতে চাইলে মোহাম্মদ মনসুর বলেন, করোনা-পরবর্তী সময়ে অন্যান্য দেশেও বিমানভাড়া বেড়েছে। কিন্তু কার্গো পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা এগিয়ে রয়েছে। ভারত বিকল্প নানা ব্যবস্থা করে কম খরচে পণ্য রপ্তানি করছে। অন্যদিকে আমাদের দেশে সে রকম কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই। ফলে আমরা ক্রেতা হারাচ্ছি।
বাংলাদেশ থেকে ৪০ ধরনের সবজি ও ফল রপ্তানি হচ্ছে আকাশপথে
রপ্তানিকারকদের এ সংগঠন বলছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সবজি রপ্তানি আয় ১০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। পরের অর্থবছর দাঁড়ায় ১৪০ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু ২০২০-২১ অর্থবছরে করোনার কারণে নয় মাস কৃষিপণ্য রপ্তানি বন্ধ ছিল। ওই সময় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আকাশপথের যোগাযোগ বন্ধ থাকার কারণে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সবজি রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। চলতি অর্থবছর লকডাউন না থাকায় আবারও রপ্তানি হচ্ছে।
কাটছে না বিমানবন্দরে পণ্যজট
পণ্য রপ্তানিতে আরেক বড় সমস্যা বিমানবন্দরে পণ্যজট। মাঝে মাঝে এ জট রপ্তানিকারকদের ভীষণ ভোগায়। গত মাসেও ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে ভয়াবহ পণ্যজট তৈরি হয়। করোনার সংক্রমণ কিছুটা কমে আসায় পোশাক ও কৃষিজাত পণ্য রপ্তানি বেড়ে যায় ওই সময়। ঠিক তখনই কার্গো ভিলেজের কয়েকটি মেশিন নষ্ট হওয়ায় এ পণ্যজট তৈরি হয়। এখনো সে রেশ পুরোপুরি কাটেনি।
জানা গেছে, দেশে শুধু শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ দিয়ে পণ্য রপ্তানি সম্ভব। সেখানে পণ্য স্ক্যানের জন্য বর্তমানে সচল আছে মাত্র দুটি স্ক্যানার। তা দিয়ে বিপুল পণ্যের চাপ সামাল দেওয়া প্রায় অসম্ভব। পাশাপাশি জায়গার অভাবে অনেক পণ্য খোলা আকাশের নিচে ফেলে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এতে সময় মতো পণ্য ক্রেতার হাতে যাচ্ছে না।
সমাধান হয়নি প্যাকিং হাউজ সমস্যার
আশির দশক থেকে বিদেশে কৃষিপণ্য রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। শুরুতে কিছু বছর বিচ্ছিন্নভাবে হলেও পরে ব্যাণিজ্যিক রূপ নেয় এ কার্যক্রম। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়েও দেশে কার্যকর কোনো প্যাকিং হাউজ হয়নি।
ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে কৃষিপণ্যের রপ্তানি সহায়ক বিএডিসির (বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন) হিমাগার ও প্যাকিং হাউজ থাকলেও তাতে কোনো সহায়তা পান না রপ্তানিকারকরা।
প্লেনে পণ্য পরিবহন ভাড়া কমানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন রপ্তানিকারকরা
অন্যদিকে শ্যামপুরের প্যাকেজিং হাউজটি তেমন কোনো কাজে আসছে না। তাছাড়া শ্যামপুর থেকে পণ্য প্যাকিং করে বিমানবন্দরে যেতে যানজটের কারণে ৫-৬ ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
এসব বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্প্রসারণ অনুবিভাগ অতিরিক্ত সচিব মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল জাগো নিউজকে বলেন, কৃষিপণ্যের রপ্তানির জন্য বিমানবন্দরে বিএডিসির হিমাগারের সক্ষমতা আরও বাড়ানো হবে। রপ্তানিকারকরা যেন এর পুরোপুরি সুবিধা পান সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, কৃষিপণ্য রপ্তানিতে বিমানের ভাড়া কমানোর একটি প্রস্তাব আমরা করেছি। বিমানবন্দরে কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ে কিছু বাড়তি জায়গা পেয়েছি কয়েক মাস আগে। স্পেস ও অন্যান্য বিষয় নিয়েও ইতোমধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং ফলমূল ও শাকসবজি রপ্তানিকারক প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়গুলো আরও রপ্তানিবান্ধব ও সহজতর করতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ চলছে। আশা করছি দ্রুত কৃষিপণ্য রপ্তানির বাধাগুলো কেটে যাবে।
এনএইচ/এইচএ/জেআইএম