সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায় শুয়ে-বসে কাটে বিচারপ্রার্থীদের সময়
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বাইরের চত্বরে অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের সামনের বাগান সম্বলিত ফুটপাতে বসা এক বৃদ্ধা। সম্পত্তির দ্বন্দ্বে হওয়া মামলার তদবির করতে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে এসেছেন তিনি। বয়স ৮৫ বছর হলেও শারীরিকভাবে সুস্থ আম্বিয়া খাতুন নামে ওই নারী জাগো নিউজকে সাবলীল ভাষায় বলেন, আমার লোকজন নেই তাই মামলার তদারকি করতে এসেছি। ঢাকায় এক আত্মীয় আছে তার বাসায় ছিলাম। মামলার তারিখ ছিল তার জন্য খোঁজ নিতে এসেছি কী রায় হয়। ২০১৮ সালে বাড়ির পাশের ১০ শতাংশ জমি নিয়ে বিরোধের জেরে ওই মামলা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সামনের চত্বরের পাশের বিল্ডিংয়ের নিচে তিন থেকে সাড়ে তিন বছর বয়সী ছোট্ট শিশুর সঙ্গে বসা মধ্যবয়সী দুই নারীসহ তিনজন। তারা এসেছেন দেশের দক্ষিণ সীমান্তবর্তী জেলা পটুয়াখালী থেকে। তারা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হাইকোর্টে এসেছেন আগাম জামিন নিতে। তাদের বংশের এক ছেলের সঙ্গে অপর গোষ্ঠীর এক মেয়ের প্রেমের সম্পর্ক। পরিবার থেকে মেনে না নেওয়ায় ছেলের হাত ধরে পালিয়েছেন মেয়ে। এর জেরে মেয়ের পরিবার থেকে ছেলেসহ তার পরিবারের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা করে। ওই মামলায় আগাম জামিন নিতে পরিবারের নারী-পুরুষসহ ১৮ জন সদস্য এসেছেন আদালতে।
বারান্দায় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে বসা এক নারী জাগো নিউজকে বলেন, ভেতরে বসার জায়গা নেই, টয়লেট সমস্যা এবং বিশ্রামের তো প্রশ্নই আসে না। তাই গরমে এখানে বসে একটু স্বস্তি পাচ্ছি।
মাগুরা সদর উপজেলার জগদ্দল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গত ১৫ অক্টোবর সংঘাতে আপন দুই ভাইসহ চারজন খুন হন। এর মধ্যে একপক্ষের তিনজন এবং অন্যপক্ষের একজন রয়েছে। ওই ঘটনায় আহত হন আরও ২০ জন। খুনের ওই ঘটনায় দুইপক্ষ দুটি মামলা করে। ১৮ অক্টোবর প্রথম মামলাটি হয়। পরে দ্বিতীয়পক্ষ অন্য মামলাটি করে ২০ অক্টোবর।
এর মধ্যে তিনজন মারা যাওয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয়েছে ৬৮ জনকে। এই মামলায় আসামিরা আগাম জামিন নিতে হাইকোর্টে আসেন। গত ১১ নভেম্বর ওই মামলায় ৫৮ আসামির আগাম জামিন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
সেখানে জামিন নিতে আসা এক আসামির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জামিন নিতে কেউ আগেই ঢাকা এসেছেন, কেউ এসেছেন রাতে, আবার তাদের কেউ সকালে কোর্টে এসেছেন। আসামিদের মধ্যে ৬২ জনের জামিন আবেদন করা হয়। তবে তার মধ্যে তিনজন গ্রেফতার হওয়ায় এবং একজন না আসায় মোট ৫৮ জনের জামিন শুনানি হয়। আদালত জামিন মঞ্জুরও করেছেন ১৭ জনের। তাদের চার সপ্তাহের আগাম জামিন মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট। অন্যদিকে একই মামলায় অন্য ৪১ জনকে চার সপ্তাহ পর বিচারিক (নিম্ন) আদালতে আত্মসমর্পণ করতে বলেছেন আদালত।
এই বিচারপ্রার্থীদের কেন্দ্র করে আদালত ও আইনজীবীদের প্রতিদিনের কর্মব্যস্ততা চললেও সেই বিচারপ্রার্থীদের অনেককেই শুয়ে-বসে এবং দাঁড়িয়ে সময় কাটাতে হয় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের বারান্দায়, মাঠে কিংবা গাছের ছায়ায়। প্রতিদিনই দেখা যায়, সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের এনেক্স ভবনের সামনের গাছের ছায়ায় শুয়ে-বসে আছেন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শত শত বিচারপ্রার্থী। অনেক নারীকেও তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এখানে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
এই লোকজনের মধ্যে সাধারণত হাইকোর্টে আগাম জামিন নিতে আসা বিচারপ্রার্থীদের সংখ্যাই বেশি। আইনজীবীর চেম্বারে সব বিচারপ্রার্থীর বসার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় অনেককে ঘোরাঘুরি করতে হয় কিংবা ক্লান্তিতে আশ্রয় নিতে দেখা যায় সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণের গাছের ছায়ায়।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের নিচতলায় শুয়ে থাকা এক ব্যক্তি জানান, তিনি তার নাতির মামলার কাজে বরিশালের বাকেরগঞ্জ থেকে এখানে এসেছেন। অসুস্থ বোধ করায় কোথাও সেরকম জায়গা না পেয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়েছেন।
সুপ্রিম কোর্টের মূল ভবনের পাশে দেখা যায়, বিচারপ্রার্থীরা ছোট-ছোট দল হয়ে বসে আছেন। কয়েকজন আবার গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাদের পাশে থাকা একজন জানান, তিনি সিলেট থেকে আগের দিন এসেছেন, আগাম জামিনের শুনানি আছে। কিন্তু কোর্টের সামনে মানুষের ভিড়, এছাড়া অন্য কোথাও বসার ব্যবস্থা না থাকায় গাছের নিচে এসে বসেছেন।
সুপ্রিম কোর্টে বিচারপ্রার্থীরা দাঁড়িয়ে, বসে এমনকি ঘুমিয়ে থাকে- তাদের বসার ব্যবস্থা করা যায় কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, হাইকোর্টে তো কোনো ক্লায়েন্ট আসবেন না। আসার কথা না। ঠিক আমি যখন উকিল হয়েছি তখনো হাইকোর্টে কোনো ক্লায়েন্ট আসতেন না। সবাই (আইনজীবীরা) যার যার চেম্বারে কাজ করে ছেড়ে দিতেন। ওনারা (আইনজীবীরা) নিজেরা এসে মামলা করতেন। এখন মক্কেলরা চলে আসেন হাইকোর্টে, তাদের বসতে দেবেন কোথায়? এত লোক সমাগম হলে তো বসার জায়গা থাকবে না। এটা (বসার ব্যবস্থা) করাও সম্ভব হবে না। যদি পর্যাপ্ত জায়গা থাকতো কোর্টের তাহলে কথা ছিল।
বিভিন্ন সহিংসতা ও বিরোধ নিয়ে করা মামলায় শতাধিক ও অর্ধশত আসামি করা হলে তারা আগাম জামিন নিতে আসেন- এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, দেখুন এসব মামলা নিয়ে ওখানে (নিম্ন আদালতে) যেতে পারেন। কিন্তু সবাই সব মামলা নিয়ে দেশের উচ্চ আদালতে চলে আসছেন। যদি প্রোপার মামলা নিয়ে আসতেন তাও কথা ছিল, সবাই যেকোনো মামলার আগাম জামিন শুনানির জন্য আসছেন।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, একমাত্র আমাদের দেশ ছাড়া পুরো দুনিয়ার কোথায়ও সুপ্রিম কোর্টে কোনো ক্লায়েন্ট আসেন না। এটা কিন্তু আমাদের দেশেও আগে ছিল না। এটা গত ১০-১২ বছর ধরে হয়েছে।
তিনি মামলার রেকর্ড ও ফাইল রাখার উদাহরণ দিয়ে বলেন, কোর্টে রেকর্ড (মামলার নথিপত্র) রাখারই জায়গা নেই। সকেশনের রুম থেকে বারান্দায় চলে আসে। আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ে খোঁজ নিয়ে দেখুন, জায়গার যে কত কঠিন অবস্থা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল জাগো নিউজকে বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে যে, আমাদের দেশে উচ্চ আদালত বিশেষ করে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট ডিভিশনটা কোর্ট অব আপিলস। সুতরাং এখানে অধিকাংশ মামলায় কাগজে বিচার হবে। কিন্তু আমাদের হাইকোর্টে সরাসরি ক্লায়েন্ট আসার সুযোগ আছে আগাম জামিনের ক্ষেত্রে এবং আমাদের যে অ্যাডমিরালটি জাহাজের মামলা হয়, সেখানে শুনানির সময় সাক্ষ্য প্রমাণের প্রয়োজন আছে। এছাড়া কোনো ব্যক্তি যদি মামলায় তদবির করতে আসেন তাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন কারাগারে থাকেন তাহলে তখন হয়তো লইয়ারের সঙ্গে দেখা করার জন্য আসেন। তবে সরাসরি ক্লায়েন্টের সঙ্গে কোর্টের দুটো ক্ষেত্র ছাড়া আর কোনো দণ্ড শুনানির সুযোগ নাই। এখন কেউ হয়তো তার স্বামীর তদবির করার জন্য উচ্চ আদালতে আসতে পারেন। ল' ইয়ারের চেম্বারে আসতে পারেন, সেটা আসাটা কোনো অন্যায় না। ক্লায়েন্ট লইয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আসতে পারেন।
তিনি বলেন, এছাড়া সুপ্রিম কোর্টে যেহেতু অনেক লইয়ারের চেম্বার হাইকোর্ট বেইজড। সুতরাং আমার মনে হয় কোনো লইয়ারের কাছে আসার সময় তারা হয়তো অবসর সময় কাটানোর জন্য বিভিন্ন সময় এখানে ওখানে বসে কাটান। তবে, কোর্ট অব আপিলস হিসেবে এখানে কাগজপত্রে বিচার হওয়ার কথা।
আপনি কি মনে করেন তাদের বসার কোনো স্থান দরকার নেই, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার কাজল বলেন, এরকম ব্যবস্থা করতে পারলে তো খুব খুশিই হতাম। সুপ্রিম কোর্টের জায়গা অপ্রতুল। আমরা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছি, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদেরই আমরা বসার ব্যবস্থা করতে পারছি না, ক্লায়েন্টের জন্য তো ওই রকম কোনো ব্যবস্থা করতেই পারি না। আমাদের যে পরিমাণ ক্যাপাসিটি তার থেকে আমাদের ল' ইয়ারের সংখ্যাই বেশি। ক্লায়েন্ট তো একটা বাড়তি যোগ। আমরা যদি তাদের জন্য বসার ব্যবস্থা করতে পারতাম ভালো হতো।
তিনি বলেন, আমাদের যে ইনফ্রাসট্রাকচার সবার আগে প্রয়োজন তা হলো, প্রত্যেক আইনজীবীর জন্য কোর্ট প্রাঙ্গণে বসার ব্যবস্থা করা। সে কারণে আমরা সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনের পেছনে আরও একটি বহুতল ভবনের প্রকল্প হাতে নিয়েছি। সেই কাজটা আমরা শুরু করলেও একটু থমকে গেছি। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে বিল্ডিং তৈরির কাজ শেষ করলে আইনজীবীরা যেমন উপকৃত হবেন, তেমনি এ সমস্ত ক্লায়েন্ট যারা পথেঘাটে ঘুরছেন তারাও আইনজীবীর চেম্বারে গিয়ে কথা বলতে ও বসতে পারবেন। তখন বাইরের এই পরিবেশটা সুন্দর থাকবে এবং তাদের হয়তো বাইরে বসার আর প্রয়োজন পড়বে না।
বিচারপ্রার্থীরা সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে আসলেও তাদের বসার স্থান নেই, এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, প্রশ্নটা হলো এত লোক কোর্টে আসেন কেন, দরকার নাই আসার। কারণ হাইকোর্টে তো আর সাক্ষ্য প্রমাণের কোনো কিছু নাই। হোয়াই সো মেনি পিপল কাম অ্যান্ড ডির্স্টাব দ্য কোর্ট প্রসেডিংস।
তিনি বলেন, বসার জায়গা নেই এটা ঠিক না, হাইকোর্টে তো বিস্তর জায়গা আছে এবং কোর্ট প্রাঙ্গণে ঢোকানোর সময়ও আমরা যেটুকু জানি যে রেস্ট্রিকশন আছে। কী কারণে আসছে, কোন মামলায় সেটা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
সাবেক এই মন্ত্রী আরও বলেন, আমার কথা হলো যে দেশের জনসংখ্যা তুলনামূলক বেশি। সেক্ষেত্রে মামলা-মোকদ্দমাও হচ্ছে বেশি। পাবলিকও তো আসেন তাদের আত্মীয়-স্বজনের জন্য। কেইসে তো ভিড় ভাট্টা হয়-ই একটু বেশি। কিন্তু অন্যান্য দেশে এ ধরনের কোনো ভিড় নেই।
এফএইচ/এমআরআর/এসএইচএস/এমএস