জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির খেসারত সাধারণ মানুষকেই বেশি দিতে হবে

সায়েম সাবু
সায়েম সাবু সায়েম সাবু , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:০৫ পিএম, ০৫ নভেম্বর ২০২১

সম্প্রতি ডিজেল-কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়িয়েছে সরকার। নতুন দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রতিবাদে অঘোষিত ধর্মঘট পালন করছেন বাস-ট্রাকসহ গণপরিবহন খাতে কর্মরত মালিক-শ্রমিকরা। এতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছেন সাধারণ মানুষ।

জ্বালানি তেলের দাম বাড়া ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে জাগো নিউজের মুখোমুখি হয়েছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করা কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি-বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি তেলের এই মূল্যবৃদ্ধিকে আত্মঘাতী উল্লেখ করে বলেন, এ মূল্যবৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষকেই বেশি খেসারত দিতে হবে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ: ফের বাড়ানো হলো জ্বালানি তেলের দাম। এবার অনেকটা চুপিসারেই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি আপনি কিভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

এম শামসুল আলম: এই পরিস্থিতিতে দৃশ্যমান নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কিন্তু অদৃশ্য প্রতিক্রিয়া আরও ভয়াবহ। মূলত জ্বালানি খাতকে কেন্দ্র করে সামাজিক অবক্ষয়ের বিষয়গুলো খুবই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ বেপরোয়াভাবে আইন লঙ্ঘন করছে। এই আইন লঙ্ঘন করছেন সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা। অথচ তারা সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জনকল্যাণ সাধন করার কথা। সেটা না করে তারা জনগণের অধিকার হরণ করছেন। জ্বালানি সেবা পাওয়া জনগণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার।

এই অদৃশ্য ক্রিয়া সম্পন্ন করতে তারা নানাভাবে ক্ষমতায়নের ফায়দা নিচ্ছে, যার ওপর সরকারেরও নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। জ্বালানি বিভাগ বা বিপিসি (বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন) পরম্পরায় জন-অধিকার হরণ করছে।

জাগো নিউজ: তারা তো সরকারেরই প্রতিনিধি। তাহলে তাদের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকছে না কেন? আর এসব তো সরকারেরই সিদ্ধান্ত...

এম শামসুল আলম: সরকার সিদ্ধান্ত দিলেই সব কর্মকর্তাদের মানতে হবে—ব্যাপারটি এমনটি নয়। যে কর্মটি সম্পাদন করলো, দায় তারই। সরকারের ওপর দায় চাপিয়ে এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

সরকারের কাজ হচ্ছে আইন তৈরি করে বিচার বিভাগের কাছে প্রতিকারের ব্যবস্থা রাখা। আর শাসন বিভাগের মাধ্যমে জনসেবা নিশ্চিত করা। কিন্তু প্রভাবিত করে জনসেবা বিঘ্ন করার অধিকার সরকারেরও নেই। তার মানে যিনি এটি করলেন, তিনি ফৌজদারি অপরাধ করলেন।

জাগো নিউজ: আপনি কি মনে করছেন—জ্বালানির এমন মূল্যবৃদ্ধি ফৌজদারি অপরাধের শামিল?

এম শামসুল আলম: হ্যাঁ, অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধের শামিল। আইন দিয়েই এই অপরাধ মূল্যায়ন করা যায়। এর অপরাধ ও সাজার ব্যাপারে আইনের ৪২ ধারায় বিস্তারিত উল্লেখ করা আছে। অপরাধ না থাকলে তো সেখানে সাজার কথা উল্লেখ থাকতো না। বিভাগীয় কোনো শাস্তি নয়, একদম ফৌজদারি শাস্তির কথা বলা রয়েছে।

জাগো নিউজ: এই বিধানে ভোক্তার অধিকার নিয়ে…

এম শামসুল আলম: ভোক্তার কাছ থেকে যদি আপনি বৈধ উপায় ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে অর্থ আদায় করেন তাহলে সেটা লুণ্ঠনের শামিল। জ্বালানি খাতে যেভাবে দাম নির্ধারণ করে ভোক্তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় চলছে, তা আইনের ভাষায় লুণ্ঠনমূলক আয়। যৌক্তিক মূল্যের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায় মানেই প্রতারণা বা তছরুপ বা লুণ্ঠন। এখন তাই হচ্ছে। ভয়ঙ্করভাবে আইনের লঙ্ঘন করছেন তারা।

জাগো নিউজ: এই যে জনগণের অর্থ লুণ্ঠনের কথা বলছেন, কিন্তু জনগণ তো সয়ে নিচ্ছে…

এম শামসুল আলম: জনগণ কেন সয়ে নিচ্ছে তা নিয়ে নানা আলোচনার ব্যাপার আছে। এই জনগণই তাদের জ্বালানি অধিকার রক্ষায় জীবন দিয়েছেন। জ্বালানি নীতি প্রত্যাখ্যান করেছেন। এশিয়া এনার্জিকে বিতাড়িত করেছেন। নাইকো চুক্তি বাতিল করতে সক্ষম হয়েছেন। নাইকোকে জরিমানা দিতে বাধ্য করানো হয়েছে। এসব কার্যক্রম ঘটাতে যে জাতি সক্ষম হচ্ছে, সেই জাতি কেন এই পরিস্থিতি সয়ে নিচ্ছে, তা নিয়ে ভাবতে হবে।

আমি আগেই বলেছি—জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি সামাজিক অবক্ষয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে। যে ইতিহাস তৈরি হচ্ছে তা পৃথিবীর কোথাও নেই। কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানুষ জ্বালানির অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। অথচ সেই জাতি সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে জ্বালানি নিয়ে এমন জনবিরোধী সিদ্ধান্ত মেনে নিচ্ছে।

জাগো নিউজ: এসব সিদ্ধান্তের দায় নিয়েও প্রশ্ন আছে…

এম শামসুল আলম: এজন্য দায়ের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এখানে যার দাম বাড়ানোর কথা তিনি মূলত করেননি। দ্বিতীয়ত, এ দাম যৌক্তিক কি না সে ব্যাপারে গণশুনানির মাধ্যমে ভোক্তাদের মতামত নিতে হবে, কিন্তু তা হয়নি। যিনি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন, তিনি সঠিক প্রক্রিয়ায় করেননি। অথচ আদেশ দিয়ে দিলেন। কারসাজির আশ্রয় নিয়ে রাতের আঁধারে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একেবারে জেনেশুনে জনস্বার্থ খর্ব করা হচ্ছে।

সরকার একটি বায়বীয় সত্তা। আর এই সত্তা দ্বারা ব্যক্তি সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তার মানে দায় ওই ব্যক্তির। অন্য কাউকে দায়ী করতে পারবেন না। তবে রাষ্ট্রে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেলে ব্যক্তির ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এই প্রবণতার কারণেই রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তগুলো কর্তারা জনসম্মুখে আনতে পারছেন না। গোটা প্রশাসনিক ব্যবস্থাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গেছে। সরকার শাসন বিভাগের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার মানে সরকারই এই ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে। তবে সরকারকে সম্পূর্ণ দায়ী করলে প্রজাতন্ত্রের কর্তাদের দায়মুক্ত করা হয়। জ্বালানি তেলের বিষয়ে এমন সিদ্ধান্তে তারা কোনোভাবেই দায়মুক্ত হতে পারেন না।

জাগো নিউজ: তেলের এই মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে আপনি মনে করছেন?

এম শামসুল আলম: এজন্য সাধারণ মানুষকেই সবচেয়ে বেশি খেসারত দিতে হবে। তেলের দাম বাড়লে সবকিছুরই দাম বাড়বে। কিন্তু সাধারণ মানুষের তো আর ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। বেঁচে থাকতে হলে তাকে ব্যয় কমাতে হবে। অধিকাংশ মানুষ যদি ব্যয় কমাতে বাধ্য হয় বাজারে সরবরাহ কমবে। এতে কিন্তু সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে যাবে। তখন সরকার ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভর করবে। সরকার ব্যাংকের ঋণ বাড়ালে সাধারণ মানুষ ব্যাংক ঋণ পাবে না। তখন বেসরকারি বিনিয়োগে ধস নামবে।

পাশের দেশ ভারতে জ্বালানির দাম বাড়ানোর কারণেই অর্থনীতি ধাক্কা খেয়েছে। তাদের জিডিপি-প্রবৃদ্ধি এখন বাংলাদেশের চেয়েও কম। করোনার মধ্যেও জ্বালানির দাম কম থাকার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ভারতের চেয়ে ভালো ছিল। এবার এই মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিকে চরম বেসামাল করে তুলবে বলে মনে করি। সর্বত্রই অস্থিরতা দেখা দেবে।

জাগো নিউজ: পরিবহন খাতে এরই মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে...

এম শামসুল আলম: এটি অব্যবস্থাপনারই ফল। এরই মধ্যে পরিবহনের ভাড়া বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বলে দাবি করা হচ্ছে। কে দাম বাড়ালো, কীভাবে বাড়ালো, এর সমন্বয় কীভাবে হতে পারে তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে এই অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজও সোচ্চার হওয়ার আর ক্ষমতা রাখেন না। কারণ আইন লঙ্ঘনের উৎসব যখন সর্বত্র তখন জনগণও তার অধিকার নিয়ে সচেতন থাকে না। থাকলেও কিছু বলার সাহস রাখে না।

এএসএস/এআরএ/এইচএ/এএসএম

ভোক্তার কাছ থেকে যদি আপনি বৈধ উপায় ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে অর্থ আদায় করেন তাহলে সেটা লুণ্ঠনের শামিল। জ্বালানি খাতে যেভাবে দাম নির্ধারণ করে ভোক্তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় চলছে, তা আইনের ভাষায় লুণ্ঠনমূলক আয়। যৌক্তিক মূল্যের বাইরে অতিরিক্ত অর্থ আদায় মানেই প্রতারণা বা তছরুপ বা লুণ্ঠন। এখন তাই হচ্ছে। ভয়ঙ্করভাবে আইনের লঙ্ঘন করছেন তারা

দায়ের বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এখানে যার দাম বাড়ানোর কথা তিনি মূলত করেননি। দ্বিতীয়ত, এ দাম যৌক্তিক কি না সে ব্যাপারে গণশুনানির মাধ্যমে ভোক্তাদের মতামত নিতে হবে, কিন্তু তা হয়নি। যিনি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন, তিনি সঠিক প্রক্রিয়ায় করেননি। অথচ আদেশ দিয়ে দিলেন। কারসাজির আশ্রয় নিয়ে রাতের আঁধারে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একেবারে জেনেশুনে জনস্বার্থ খর্ব করা হচ্ছে

এজন্য সাধারণ মানুষকেই সবচেয়ে বেশি খেসারত দিতে হবে। তেলের দাম বাড়লে সবকিছুরই দাম বাড়বে। কিন্তু সাধারণ মানুষের তো আর ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে না। বেঁচে থাকতে হলে তাকে ব্যয় কমাতে হবে। অধিকাংশ মানুষ যদি ব্যয় কমাতে বাধ্য হয় বাজারে সরবরাহ কমবে। এতে কিন্তু সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে যাবে। তখন সরকার ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভর করবে। সরকার ব্যাংকের ঋণ বাড়ালে সাধারণ মানুষ ব্যাংক ঋণ পাবে না। তখন বেসরকারি বিনিয়োগে ধস নামবে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।