অস্তিত্ব সংকটে জোট শরিকরা, অস্বস্তিতে বিএনপি
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলগুলোর অধিকাংশই অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। এ নিয়ে বিএনপি ভুগছে ভীষণ অস্বস্তিতে। সেজন্য সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি জোটগত কর্মসূচি বাদ দিয়ে নিজস্ব কর্মসূচির দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০১৮ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ও নির্বাচন-পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে অনেক দল জোট ত্যাগ করায় ২০ দল এবং ঐক্যফ্রন্ট এখন অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। অবশ্য ২০ দলীয় জোট ত্যাগকারী ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ ন্যাপ, এনপিপি, এনডিপি, ন্যাপ ভাসানীর বিকল্প হিসেবে কিছু নেতাকে সামনে এনেছে বিএনপি। তবে রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, নতুন ওই নেতাদের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা তো দূরের কথা, সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ।
বিএনপিবিরোধীদের ভাষ্য, ২০ দলীয় জোট গঠনের পর এটি বহুবার ভাঙনের কবলে পড়েছে। বেরিয়ে গেছে পাঁচটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। তবু জোটে ‘২০ দল’ই থেকে যায় কীভাবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সমালোচকদের দাবি, কোনো শরিক দল জোট ত্যাগ করলেই বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় ওই দলের যে কোনো একজনকে দিয়ে নতুন করে একই নামে কমিটি তৈরি করা হয়। যাকে দিয়ে নতুন দল তৈরি করা হয় তার অবস্থান অথবা যোগ্যতা কিছুই বিবেচনা করা হয় না। এ কারণে ২০ দলীয় জোটকে এখন ‘অনিবন্ধিত দলের জোট’ বলা হয়।
সমালোচকদের ভাষ্যে, ‘একদল-একনেতা’নির্ভর এসব দল অনেকটা ‘মৌসুমি রাজনীতি’নির্ভর। তাদের কর্মসূচি-কার্যক্রম কিছুই নেই। অনেক দলের নিজস্ব কার্যালয়ও নেই। যেসব সংগঠনের কার্যালয় আছে, জোটের মতো সেগুলোও নিষ্ক্রিয়।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পরপরই জোট ত্যাগ করে শেখ আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ ভাসানী। সেই সময় ১৮ দলীয় জোটের সংখ্যাতত্ত্ব ঠিক রাখতে তৎকালীন কল্যাণ পার্টির গাইবান্ধা জেলার সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামের নেতৃত্বে তৈরি করা হয় ন্যাপ ভাসানী, যে দলের কোনো নিজস্ব কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায় না। মাঝে মধ্যে বিবৃতি দেওয়ার মাধ্যমেই তাদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। রাজপথে কোথাও কোনো আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের দেখা যায় না।
একই সময় বিএনপির সঙ্গে মতবিরোধে জোট ত্যাগ করে শেখ শওকত হোসেন নীলুর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপি। ওই সময় তাদের দলের মহাসচিব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে এনপিপি তৈরি করে ২০ দলীয় জোট ধরে রাখা হয়। ২০১৮ সালের পর ড. ফরহাদ অংশের এনপিপির কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। এমনকি কোনো বিষয়ে দলটির বিবৃতিও চোখে পড়ে না। বিএনপি জোটের এই শরিক এখন মূলত ‘ওয়ান ম্যান শো’। দলের কার্যালয় নেই, কার্যক্রমও নেই বললেই চলে। মতিঝিলে নিজের চেম্বারে রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তিনি।
বিভিন্ন অভিযোগ এনে ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি জাতীয় সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ২০ দল ত্যাগ করে ইসলামী ঐক্যজোট। যার নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আবদুল লতিফ নেজামী, আবুল হাসনাত আমিনী ও মুফতি ফয়জুল্লাহ। যেদিন তারা জোট ত্যাগ করেন সেদিনই বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অ্যাডভোকেট মাওলানা আবদুর রকিবের নেতৃত্বে নতুন ইসলামী ঐক্যজোট প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আবদুর রকিবের এই দল পাঁচ বছরেও নিজস্ব কোনো কার্যালয় করতে পারেনি। আবদুর রকিব সাধারণত সিলেটে থাকেন। ঢাকায় সুপ্রিম কোর্টে তার চেম্বার রয়েছে। তবে তার নেতৃত্বাধীন ইসলামী ঐক্যজোটের কোনো কার্যালয় নেই। ঢাকায় অবস্থানরত ইসলামী ঐক্যজোটের ভাইস চেয়ারম্যান শওকত আমীনের বাসা থেকেই দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় বলে জানা গেছে।
২০ দলীয় জোটের একটি বৈঠক (পুরনো ছবি)
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে ১৩ অক্টোবর বিএনপি, গণফোরাম, জেএসডি ও নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আত্মপ্রকাশ করে। এর তিনদিন পর ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান জেবেল রহমান গানি ও গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) জোট ত্যাগ করে। একইদিন গানির সঙ্গে বেরিয়ে যায় খোন্দকার গোলাম মোর্তুজা ও মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসার নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি)।
বাংলাদেশ ন্যাপ ও এনডিপি জোট ত্যাগ করার দিনই একই নামে দুটি দল গঠন করা হয়। শাওন সাদেকীকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে তৈরি করা হয় ‘বাংলাদেশ ন্যাপ’। এখন পর্যন্ত তার রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ড চোখে পড়েনি। জোটের তালিকায় ৮৬, নয়াপল্টন মসজিদ গলির ভবনটিতে তার কার্যালয়ের কথা উল্লেখ থাকলেও সেখানে এ ধরনের কোনো কার্যালয়ের অস্তিত্ব খুঁজে পওয়া যায়নি। ভবনের একজন অধিবাসী জানান, এখানে কোনো রাজনৈতিক দলের কার্যালয় নেই। ফ্ল্যাট বাসায় সাধারণ মানুষ বসবাস করেন।
অন্যদিকে নতুন এনডিপি তৈরি করা হয় ক্বারি আবু তাহেরের নেতৃত্বে। তিনি বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু ও বরকতউল্লা বুলুর আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। তার নেতা হওয়া বা জোটের শীর্ষ নেতা হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার পেছনে বিএনপির এই দুই নেতার হাত রয়েছে বলে বিরোধীদের দাবি। এ দলেরও কোনো কার্যালয় নেই। ক্বারি তাহেরের অফিস থেকেই দল পরিচালনা করা হয় বলে জানা গেছে।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিএনপি জোটের ভরাডুবির পর শপথের সিদ্ধান্ত না নিয়েও পরে তাদের এমপিরা সংসদে যাওয়ায় ২০১৯ সালে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেন নিবন্ধিত বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিভ রহমান পার্থ। এ দলটির জায়গায় কোনো অংশ সৃষ্টি হয়নি।
এরপর ২০২১ সালের ১৪ জুলাই জোট ত্যাগ করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের নিবন্ধিত অংশ। মুফতি ওয়াক্কাছের নেতৃত্বে আরেকটি অংশ জোটে আছে। তবে তারা জোটের রাজনীতি এবং নিজস্ব রাজনীতি—দুটোতেই নিষ্ক্রিয়।
গত ১ অক্টোবর ষষ্ঠ দল হিসেবে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছেড়েছে নিবন্ধিত খেলাফত মজলিস। এই দলটিরও কোনো অংশ সৃষ্টি করেনি বিএনপি।
২০ দলীয় জোটের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দল বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ ও ড. রেদোয়ান আহমেদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি। অলি আহমদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যথেষ্ট গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তবে জোটের বাইরে গিয়ে কিছু দল নিয়ে অলির নেতৃত্বে ‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’ গঠনকে কেন্দ্র করে আবদুল করিম আব্বাসী ও শাহাদাত হোসেন সেলিমের নেতৃত্বে এলডিপির আরেকাংশ তৈরি হয়েছে। এই অংশের সভাপতি আবদুল করিম আব্বাসীকে কখনো দেখা না গেলেও মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম রাজনীতিতে সক্রিয়। যদিও নিজ নির্বাচনী এলাকায় নানা কর্মসূচি পালন করলে সেখানে বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদেরই দেখা মেলে। সেসব কর্মসূচিতে এলডিপির কোনো কর্মী বা নেতা আছেন কি না কারও জানা নেই। এলডিপির এই অংশেরও কোনো নিজস্ব কার্যালয় নেই। রাজধানীর কাজীপাড়ায় দলের যুগ্ম-মহাসচিব এম এ বাসারের অফিস থেকেই দল পরিচালিত হয়।
২০ দলীয় জোটের শরিক জাতীয় পার্টির কাজী জাফর অংশের নেতারা অনেকটাই ছন্নছাড়া। ঢাকার পুরানাপল্টনে দারুস সালাম ভবনে তাদের একটি কার্যালয় ছিল, এখন আর সেই কার্যালয়ের অস্তিত্ব নেই। দলের চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আহসান হাবিব লিংকনের ব্যক্তিগত কার্যালয়কে কেন্দ্র করেই দল পরিচালিত হয়। দলটির কার্যক্রম বলতে প্রেস ক্লাব কিংবা কোনো মিলনায়তনে আলোচনা সভার মধ্যে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে অন্য কোনো কার্যক্রম নেই জাতীয় পার্টির এই অংশের।
এদিকে জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা) এখন আর ২০ দলীয় জোটের ব্যাপারে আগ্রহী নয়। রাজনীতিতে অত্যন্ত পরিচিত ও ভারতবিরোধী রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত প্রয়াত শফিউল আলম প্রধান দলটির প্রতিষ্ঠাতা। এখন তার কন্যা ব্যারিস্টার তাসমিয়া প্রধানের নেতৃত্বে দলটি পরিচালিত হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাসমিয়া প্রধানকে মনোনয়ন না দেওয়ায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সমালোচনা করেন তিনি। ২০১৯ সালের ২৭ জুন অলি আহমদের নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তিমঞ্চে যোগ দেওয়ার পর থেকে ২০ দলীয় জোটে আর সক্রিয় হয়নি দলটির এ অংশ। তাদের কার্যালয় আসাদগেট এলাকায়।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে গঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, যার নেতৃত্বে ছিলেন ড. কামাল হোসেন
অন্যদিকে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফুর রহমানের নেতৃত্বে জাগপার একটি অংশ বিএনপি-জোটে প্রতিনিধিত্ব করছে। এ অংশটি বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্র জানায়। নয়াপল্টনের মসজিদ গলিতে ৮৫/১ ভবনের সপ্তম তলায় একটি কক্ষ থেকে পরিচালিত হয় দলীয় কর্মকাণ্ড। খন্দকার লুৎফুর রহমান না এলে সাধারণত অফিস বন্ধই থাকে।
মোস্তাফিজুর রহমান ইরানের নেতৃত্বাধীন লেবার পার্টি ২০ দলীয় জোটের অংশ। তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় আছে। যদিও সেটাকে মিডিয়া অফিস হিসেবে পরিচয় দেওয়া হয়। মূলত এখান থেকে দল পরিচালনা করেন তিনি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, প্রেস ক্লাবভিত্তিক সভা-সেমিনার-মানববন্ধন ও বিবৃতিতে সক্রিয় এই দল।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে লেবার পার্টির তৎকালীন মহাসচিব হামদুল্লাহ মেহেদিও ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেন।
২০১২ সালের এপ্রিলে ১৮ দলীয় জোট গঠনের পর আরও দুটি দলের যোগদানের ফলে ২০ দলীয় জোটের রূপ পায় বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। ওই দল দুটির একটি সাম্যবাদী দল (একাংশ)। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর দলের মূল ব্যক্তি সাঈদ আহমেদ প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র ও পরে কানাডায় চলে যান। এরপর তার দল হয়ে পড়ে গন্তব্যহীন। ঢাকার সেগুনবাগিচায় বাসদের অফিসের পাশে তাদের দলীয় কার্যালয় হলেও প্রকৃতপক্ষে সেখানে বেসরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নামে সংগঠনের অফিস। দলের একটি সূত্রের দাবি, সংগঠনের জন্য অর্থ সংগ্রহের শর্তে দলের দায়িত্ব নিলেও পরে উল্টো অর্থ আত্মসাৎ করে কানাডায় চলে গেছেন সাঈদ আহমেদ। সেখানে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
অ্যাডভোকেট গরীবে নেওয়াজ নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ পিপলস লীগ ২০ দলীয় জোটের শরিক, তবে তাদের কার্যক্রম নেই। দলীয় কার্যালয়েরও কোনো অস্তিত্ব নেই। পেশাগত কাজের সুবাদে চেয়ারম্যান গরীবে নেওয়াজের অফিসটিই পার্টি অফিস হিসেবে বলা হয়। জোটের তালিকায়ও রয়েছে এই ঠিকানা।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ছেলে এএইচএম কামরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন ছিল বাংলাদেশ মুসলিম লীগ (বিএমএল)। নিবন্ধিত এ রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বনানীতে (বাড়ি ১২৬, রোড ২৭, ব্লক-এ)। সেই অফিসে দলের কোনো কার্যক্রম পরিচালনা হয় বলে কেউ জানে না। রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি তাদের নেই বললেই চলে। করোনা আক্রান্ত হয়ে এএইচএম কামরুজ্জামান মারা গেছেন। তার মৃত্যুর পর একটি স্মরণসভা করেছে দলটি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এতে যোগ দেন। কোনো রাজনৈতিক অনুষ্ঠানও করে না দলটি। জোটের বৈঠক থাকলে অংশগ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো কর্মকাণ্ড নেই তাদের।
জোটের আরেক শরিক অ্যাডভোকেট আবদুল মোবিনের বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টির কোনো হদিস নেই। দলটির সভাপতি পদে আবু তাহের ও মহাসচিব হিসেবে আবুল কাশেম দায়িত্ব পালন করছেন। অ্যাডভোকেট মোবিন জীবিত থাকতেই তৎকালীন মহাসচিব এম এ রশিদ প্রধান দলের একাংশ নিয়ে ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করেন। মালিবাগের মৌচাক টাওয়ারের ১৩ তলায় ১৩১৪ নম্বর কক্ষে তাদের ঠিকানা উল্লেখ আছে জোটের তালিকায়। তবে ওই কক্ষে পার্টির অফিস নেই। সেখানে এখন একটি ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয়।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি। যার নেতৃত্বে রয়েছেন মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক। এক সময় বিএনপি-জামায়াতের কট্টর সমালোচক হলেও এখন জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবেই পরিচিত তিনি। দলটির সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে কাজ করেছে এমন একাধিক নেতা দাবি করেছেন, কল্যাণ পার্টির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর বোঝাপড়া ভালো। সেক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে বিএনপির ধানের শীষ না পেলে কল্যাণ পার্টির প্রতীককে কাজে লাগাতে পারে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতা করা সংগঠনটি।
‘জাতীয় মুক্তিমঞ্চ’ গঠনকে কেন্দ্র করে দলের তৎকালীন মহাসচিব এম এম আমিনুর রহমান দল থেকে পদত্যাগ করেন। তারপর দলের যুগ্ম-মহাসচিব মো. নুরুল কবির ভূঁইয়া ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তবে সম্প্রতি জামায়াতের কিছু নেতা এবি পার্টি হয়ে কল্যাণ পার্টিতে যোগ দেওয়ায় দলের মূল নিয়ন্ত্রণ এখন তাদের হাতেই চলে যাচ্ছে।
কল্যাণ পার্টির নতুন মহাসচিব নিযুক্ত হয়েছেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাবেক শিবির নেতা আবদুল আউয়াল মামুন। তিনি সপরিবারে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। ২০০৬ সালে তিনি সেখানে যান। এর আগে ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন।
রাজনৈতিক একটি সূত্র দাবি করেছে, নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াতের সঙ্গে কল্যাণ পার্টির রাজনৈতিক সমঝোতা হয়েছে। নানান সুবিধা আদান-প্রদান ও বিএনপি-জোট যদি ভেঙে যায় তাহলে কল্যাণ পার্টির দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে জামায়াত। দলটির নতুন যুগ্ম-মহাসচিব নুরুল আফসার ফেনী জেলা শিবিরের সাবেক সভাপতি, ভাইস চেয়ারম্যান জাকিউল হক জাকি জামায়াতের ঢাকা মহানগরের সাহিত্য বিভাগে এবং ভাইস চেয়ারম্যান আলী হোসেন ফরাজী পল্টন থানা জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি যোগ দেওয়াদের মধ্যে পার্টির বর্তমান যুগ্ম-মহাসচিব (সমন্বয়কারী) আবদুল্লাহ আল হাসান সাকিব শিবিরের চট্টগ্রাম মহানগর উত্তরের ছাত্র কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্টগ্রামে ‘হামজা ব্রিডেগ’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে আটক হয়েছিলেন তিনি। দলটির ঢাকা মহানগর উত্তর সভাপতি নাজমুল হুদা অপু সিলেট এমসি কলেজ শিবিরের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির আরও বেশ কয়েকজন নেতা বিভিন্ন সময় জামায়াত-শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন।
২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর বিএনপি-জোটে যোগ দেয় রিটা রহমানের নেতৃত্বাধীন পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশ, সৈয়দ এহসানুল হুদার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয় দল ও মাইনরিটি পার্টি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুতে রংপুরে একটি সংসদীয় আসন শূন্য হলে পিপলস পার্টি অব বাংলাদেশকে বিএনপিতে একীভূত করেন দলটির উদ্যোক্তা রিটা রহমান। আর বিএনপি জোট ছেড়ে চলে গেছে মাইনরিটি পার্টি।
সৈয়দ এহসানুল হুদার বাংলাদেশ জাতীয় দল এখন বিএনপি নেতাদের নিয়ে আলোচনা সভা, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। দলের অফিস হিসেবে ঢাকার ধানমন্ডি-২ নম্বর সড়কের ৩৮/১ বাড়িটির নিচতলা ব্যবহার করছেন। বাড়ির সামনেই দলের সাইনবোর্ড ঝুলে আছে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী। ঢাকায় দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও মহানগর কার্যালয় দুটোই এক দশক ধরে বন্ধ। দলটির সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে অস্থায়ীভাবে। নেতাদের অনুসারীর বাসা কিংবা ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে দলটি।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন অন্য জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ জোট নির্বাচনের কয়েক মাস পরই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। নির্বাচনের ফল বর্জনের পর গণফোরাম ও বিএনপির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথগ্রহণ করায় জোটের শরিক বঙ্গবীর আবদুল কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ত্যাগ করে।
অন্যদিকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম দুই ভাগে বিভক্ত। দলটির সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়া ইতোমধ্যে দলত্যাগ করে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে নিয়ে নতুন দল ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে মোস্তফা মহসিন মন্টু, অধ্যাপক আবু সাইয়ীদ ও অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর নেতৃত্বে গণফোরামের একাংশ চলছে আলাদাভাবে।
আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলও (জেএসডি) দুই ভাগে বিভক্ত। সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন ও সহ-সভাপতি এম এ গোফরানের নেতৃত্বে জেএসডির আলাদা অংশ কার্যক্রম চালাচ্ছে।
মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে নাগরিক ঐক্য রাজনৈতিক ময়দানে কার্যকর পদচারণা করছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর অধিকাংশ অনুষ্ঠানেই তাকে দেখা যায়।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা গণস্বাস্থ্যের ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সমালোচনা করার কারণে এ দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ভাসানী অনুসারী পরিষদ, জোনায়েদ সাকির গণসংহতি আন্দোলন, ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরকে নিয়ে রাজনৈতিক ময়দানে সরব পদচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
আন্দোলন-সংগ্রামে জোট শরিকদের সাংগঠনিক সক্ষমতা নিয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, এখন জোটের সক্ষমতা প্রকাশের সময় নয়। প্রত্যেকেই যার যার মতো করে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, যখন জোটে ফেস করার সময় হবে তখন সক্ষমতা বোঝা যাবে। এখন বিএনপি নিজস্ব কর্মসূচি দিচ্ছে। জোটের শরিকরা নিজেদের মতো কর্মসূচি পালন করছে। সবকিছু একসঙ্গে করতে হবে এমনটা নয়। প্রয়োজনে একসঙ্গে হবে, আবার প্রয়োজনে যার যার মতো করে কাজ করবে।
কেএইচ/কেএসআর/এইচএ/এমএস