রেলপথের আতঙ্ক পাথর নিক্ষেপ, ৯ মাসে ১১০ ঘটনা
যাতায়াতে মানুষের প্রথম পছন্দ রেলপথ হলেও আতঙ্কও যেন সবচেয়ে বেশি! বিশেষ করে পাথর নিক্ষেপ এখন মূর্তিমান আতঙ্ক। আগে দু’একটি রুটে বেশি হলেও এই সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। প্রায়ই ভাঙছে জানালার কাচ, আহত হচ্ছেন যাত্রীরা। সম্প্রতি এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। পুরস্কার ঘোষণা করেও ধরা যাচ্ছে না দুর্বৃত্তদের। দাবি উঠেছে জানালায় প্রতিরক্ষা নেট লাগানোর।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১১০টি ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীদের অভিযোগ, পাথর নিক্ষেপ বন্ধে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো অঞ্চলের ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ হচ্ছে। এতে আহত হচ্ছেন অসংখ্য যাত্রী। এভাবে চলতে থাকলে রেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে যাত্রীরা। অথচ আইনে পাথর নিক্ষেপের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রেনকে যাত্রীবান্ধব করতে রেলওয়ের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই। এখন চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধে আইনের যথাযথ প্রয়োগসহ জনসচেতনতা বাড়াতে কাজ করছে রেলওয়ে। এরই মধ্যে তারা বেশ কিছু জায়গা চিহ্নিত করেছেন, যেখান থেকে পাথর নিক্ষেপ করা হয়। এসব এলাকায় নিয়মিত রেল পুলিশের টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকার গণ্যমান্যদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে কমিটি। কেউ পাথর নিক্ষেপকারীকে ধরে দিলে ১০ হাজার টাকা পুরস্কারের ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের হিসাব মতে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ১১০টি ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৯ জন আহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় ১০৩টি ট্রেনের জানালা ভেঙেছে। এর মধ্যে দেশের ১৫টি এলাকায় পাথর ছোড়ার ঘটনা ঘটছে বেশি।
গত ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর রেলভবনে পাথর নিক্ষেপ বন্ধে সচেতনতা বাড়ানো কার্যক্রমের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন।
তিনি ওইসময় বলেন, যেসব এলাকায় পাথর নিক্ষেপের ঘটনা বেশি ঘটছে, সেগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে উপমহাদেশে ১৮৫৩ সালে ট্রেন চালুর পর থেকেই পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। উন্নত দেশেও এ অপকর্মটি হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে সমস্যাটি ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ট্রেনের গার্ড, কর্মচারী ও যাত্রী আহত হচ্ছেন। অনেকে চোখ হারিয়েছেন। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।
আইনে পাথর নিক্ষেপের সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও এখন পর্যন্ত কাউকে সাজা দেওয়া যায়নি কেন? এমন প্রশ্নের জাবাবে নুরুল ইসলাম সুজন বলেন, পাথরের আঘাতে মৃত্যুর ফলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে এ পর্যন্ত পাথর নিক্ষেপের ঘটনায় যাদের ধরা হয়েছে তাদের সবাই শিশু, ভবঘুরে অথবা অপ্রকৃতিস্থ। ফলে কাউকে সাজা দেওয়া যায়নি। এজন্য সচেতনতায় জোর দেওয়া হচ্ছে। এতে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রয়োজন।
পরে গত ১০ অক্টোবর কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন পর্যন্ত পাথর নিক্ষেপের বিরুদ্ধে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করে জিআরপি ও রেলওয়ের ঢাকা বিভাগ। একই সময়ে দেশের অন্য জেলায়ও একই কর্মসূচি পালন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রেলওয়ের জনসচেতনা কর্মসূচির মধ্যেই গত ১৫ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জের ভৈরবে আবারও চলন্ত ট্রেনে দুর্বৃত্তদের পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। পাথরের আঘাতে মমতাজ মারোয়া (৫০) নামে এক নারী যাত্রী গুরুতর আহত হন। এছাড়া গত ২ অক্টোবর ঢাকা থেকে সিলেটগামী আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস নামে ট্রেনে পাথর ছুড়ে মারা হয়। এতে ট্রেনটির অন্তত চার যাত্রী আহত হন। অথচ কেউ যেন রেললাইনের ধারের কাছে না আসতে পারে, আইনে ১৪৪ ধারা জারি করা আছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি তথ্য ও অনুসন্ধানমূলক ফেসবুক গ্রুপ ‘বাংলাদেশ রেলওয়ে ইউনির্ভাসাল ফ্যান্স ফোরাম’। এই গ্রুপে গত ১৭ অক্টোবর ঢাকা-ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের একটি পোস্ট দেন সিফাত হোসেন নামে এক যাত্রী। সঙ্গে এক টুকরো পাথরের ছবিও তিনি দিয়েছেন। পোস্টে সিফাত হোসেন লেখেন, ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস ট্রেনে পাথর নিক্ষেপ করলো দুর্বৃত্তরা। তবে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। শুধু জানালার কাচ ভেঙেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন জাগো নিউজকে জানান, রেলকে যাত্রীবান্ধব করাই প্রধান লক্ষ্য। তবে কিছু এলাকায় চলন্ত ট্রেনে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। এটি বন্ধে তারা জনসচেতনতাসহ নানান পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর বাইরে রেলের জানালায় কাচের ওপর লোহার জাল দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। আশাকরি ক্রমান্বয়ে পাথর নিক্ষেপের ঘটনা কমে আসবে।
এমএমএ/এএ/এএসএম