যেখানে দরকার সেখানে নেই ফুটওভার ব্রিজ!

মাহবুবুল ইসলাম মাহবুবুল ইসলাম , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫০ এএম, ২২ অক্টোবর ২০২১

রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডে তেলের পাম্পের সামনে রাস্তা পার হবেন এক নারী। চলন্ত গাড়ি থামিয়ে অর্ধেক রাস্তা পার হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সড়ক বিভাজনের ওপর। আরেক পাশ থেকে অনবরত গাড়ি আসার কারণে বাকি রাস্তা পার হতে পারছেন না তিনি। বারবার চেষ্টা করেও গাড়ি এসে পড়লে আবার পেছনে চলে যান। অবশেষে অন্যের সহায়তায় চলন্ত গাড়ি হাতের ইশারায় থামিয়ে ঝুঁকি নিয়েই পার হতে হয় তাকে।

ব্যস্ততম এ সড়কের প্রতি মুহূর্তের দৃশ্য এটি। প্রতিনিয়ত এভাবেই ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছেন পথচারীরা। বেশকিছু সময় অপেক্ষা করেও রাস্তা ফাঁকা না পাওয়ায় চলন্ত গাড়ি হাতের ইশারায় থামিয়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এলাকাবাসী ও নিয়মিত যাতায়াতকারী পথচারীরা বলছেন, একটা ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় প্রতিনিয়ত ঝুঁকি নিতে হচ্ছে। জীবন হাতে নিয়ে রাস্তা পারাপারই যেন বাড্ডাবাসীর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

jagonews24

তবে, এর ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায়, মাত্র ৫০০ মিটার দূরত্বে গুলশান-বাড্ডা গুদারাঘাট বাজার এলাকায়। এখানে একটি ওভার ব্রিজ থাকালেও হচ্ছে না ব্যবহার। সারাদিনে দু-একজন মনে চাইলে পার হচ্ছেন। রাস্তা পারাপারের চেয়ে উপরে দাঁড়িয়ে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের কাজেই বেশি ব্যবহার হচ্ছে ব্রিজটি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাড্ডা লিংকরোডের এক পাশে বাড্ডা আদর্শনগর গলি, অন্য পাশে গুলশান-১ এর সংযোগ সড়ক। দুই পাশেই অনবরত গাড়ি চলছে। গুলিস্তান, যাত্রাবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা উত্তরা হয়ে টঙ্গি-গাজীপুরগামী বেশকিছু মিনিবাস চলাচল করে এই রাস্তায়। এসব গাড়ির মধ্যে অনবরত প্রতিযোগিতা লেগেই থাকে। ফলে রাস্তা পারাপারে ঝুঁকিও আরও বেড়ে যায়। অন্যদিকে মহাখালী হয়ে যেসব গাড়ি রামপুরা, বাড্ডা রুটে চলাচল করে, তার প্রতিটি গাড়িই গুলশান সংযোগ সড়ক হয়ে এসে যাত্রী ওঠানামা করেন লিংক রোডের স্টপেজে। ব্যস্ত এ পয়েন্টে ফুটওভার ব্রিজ না থাকায় অনবরত ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছে হাজারো মানুষ।

jagonews24

জানা যায়, লিংক রোডে রাস্তা পারাপারের কোনো ব্যবস্থাই ছিল না। সড়ক বিভাজনের ওপর দিয়েই মানুষ ঝুঁকি নিয়ে পার হতেন। এর আগে কর্তৃপক্ষ জেব্রা ক্রসিং তৈরি করে দিলেও অতিরিক্ত যান চলাচলের চাপ ও চালকদের নিয়ম না মানার কারণে পথচারীদের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।

আলম নামের এক ব্যবসায়ী জাগো নিউজকে বলেন, ‘রাস্তার সঙ্গেই আমার দোকান। দোকানে সারাদিন বসে থাকলে আমার চোখটা অটোই রাস্তার দিকে চলে যায়। প্রতিদিন শত শত, হাজার হাজার মানুষ এ রাস্তা পারাপার হয়। ওভারব্রিজ না থাকায় এদিক সেদিক দিয়ে সবাই ঝুঁকি নিয়ে পার হচ্ছে। বিশেষ করে বাচ্চা নিয়ে যখন নারীরা পার হন, তখন আমার কাছে খুবই খারাপ লাগে। এখানে একটা ওভারব্রিজ দরকার।’

jagonews24

ব্যস্ততম দিনে মালিবাগ থেকে বাসে লিংরোডে এসে নেমেছেন রফিক নামের এক অফিসফেরত যাত্রী। রাস্তা পার হবেন বলে দাঁড়িয়ে আছেন। বার বার হাত দিয়ে ইশারা করেও কোনো গাড়ি থামাতে পারছেন না। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়েই আমাকে রাস্তা পার হতে হবে। তা না হলে উপায় নেই। গাড়িগুলোও অতিরিক্ত বেপারোয়া। কখন যে একটা অঘটনের কবলে পড়ে যাই তার নিশ্চয়তা নেই।’

বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তা পার হন হাসনা নামের এক নারী। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার বাসা রাস্তার ওপারে আদর্শনগর গলিতে। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল দুবার করে এই রাস্তা পার হই। খুব ভয়ে থাকি। একা পার হওয়ার সাহস পাই না। এজন্য আরও কয়েকজন না আসা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি।’

jagonews24

লিংক রোড স্টপেজে বাস নিয়ন্ত্রণে কর্মরত বাড্ডা জোনের ট্রাফিক কনস্টেবল রবীন্দ্র বড়ুয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এখানে নিয়মিতই ডিউটি করি। মানুষ খুব কষ্ট করে রাস্তা পার হয়। এটা কোনো নির্দিষ্ট সিগন্যালের জায়গা নয়। এ কারণে গাড়ি থামিয়ে পার করাও সম্ভব নয়। কিন্তু মানুষের চাপও তো অনেক। একটা ওভারব্রিজ না হলে আর সমাধান সম্ভব নয়।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রকৌশলী মো. ফরহাদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘যদি কোনো নাগরিক মেয়র বরাবর লিখিত জানাতেন, তবে আমরা ব্যবস্থা নিতাম। কিন্তু এখন ওখানে কোনো ওভারব্রিজ নির্মাণের পরিকল্পনা আপাতত নেই। কারণ, এমআরটি প্রজেক্টের আওতায় ওখানে একটা স্টেশন করার পরিকল্পনা আছে। সেটা হলে তখন মানুষ আন্ডারপাসে ওঠানামা করবে। ওভার ব্রিজ তৈরি করতেও বছর খানেক লেগে যাবে। এর মধ্যে এমআরটির কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে এখন আর ওভারব্রিজ নির্মাণ যুক্তিসঙ্গত হবে না। আমরা ওখানে জেব্রা ক্রসিং তৈরি করে দিয়েছি। আপাতত কিছুদিন কষ্ট করতে হবে।’

jagonews24

এদিকে লিংক রোডের মাত্র ৫০ মিটার দূরত্বে গুদারাঘাট এলাকায় ফুটওভার ব্রিজ থাকলেও তা ব্যবহার করছে না মানুষ। পথচারীরা বলছেন, এখানে রাস্তাও খুব বেশি প্রশস্ত নয়। গাড়ির চাপও কম। অল্পতেই পার হওয়া যায়। এজন্য ওভার ব্রিজে কেউ উঠতে চান না।

সরেজমিনে দেখা যায়, সারাদিন খালিই পড়ে থাকে ব্রিজটি। ব্রিজের নিচে সড়ক বিভাজনও পুরোটাই ভাঙা। মানুষের পাশাপাশি রিকশা, ভ্যান, মোটরসাইকেলও পার হচ্ছে এদিক দিয়ে। ওভার ব্রিজে ওঠানামা করার সিঁড়ির সামনেই গড়ে উঠেছে ভ্রাম্যমাণ ফুচকার দোকান। সিঁড়ি থেকে নামতেই সামনের জায়গা দখল করে বসানো হয়েছে টেবিল-চেয়ার। মাঝে মাঝে দু-একজন শিশু ও নারী ব্রিজটা ব্যবহার করছেন।

jagonews24

ব্রিজঘেঁষেই রয়েছে বাজার। জানতে চাইলে এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘এই ব্রিজ এখন আর কামে লাগে না। গাড়ির চাপ কম। মানুষ নিচ দিয়াই পার হয়। কষ্ট করে ব্রিজে ওঠে না। ডিভাইডারের লোহার বেড়া না থাকায় মানুষ নিচ দিয়াই আরও বেশি চলাচল করে।’

ব্রিজটির ব্যাপারে প্রশ্ন করলে প্রকৌশলী মো. ফরহাদ বলেন, ‘বিষয়টা আমিও ভেবেছি। আসলে, হাতিরঝিল হয়ে গুলশান লেক ঘেঁষে যে রাস্তা, সেটি আগে ছিল না। ওই সময় রাস্তায় গাড়ি ও মানুষের চাপ বেশি ছিল; তখন ওভারব্রিজ খুব বেশি প্রয়োজন ছিল। তখনই ব্রিজটা তৈরি করা হয়েছে। এখন রাস্তা হয়ে যাওয়ায় লিংক রোডে গাড়ির চাপ কমেছে। ব্যক্তিগত অনেক গাড়ি লেকপাড়ের রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। মানুষও এখন হাঁটার জন্য বাড়তি রাস্তা পেয়েছে। এজন্য এখন আর ব্রিজটা আগের মতো ব্যবহার হচ্ছে না। যখন তৈরি হয়েছিল, তখন প্রয়োজনেই তৈরি করা হয়েছিল।’

এমআইএস/এসএইচএস/জিকেএস

এমআরটি প্রজেক্টের আওতায় ওখানে একটা স্টেশন করার পরিকল্পনা আছে। সেটা হয়ে গেলে তখন মানুষ আন্ডারপাসে ওঠানামা করবে। ওভার ব্রিজ তৈরি করতেও বছর খানেক লেগে যাবে। এর মধ্যে এমআরটির কাজও এগিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে এখন আর ওভার ব্রিজ নির্মাণ যুক্তিসঙ্গত হবে না। আমরা ওখানে জেব্রা ক্রসিং তৈরি করেছি। আপাতত কিছুদিন কষ্ট করতে হবে।

বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়েই আমাকে রাস্তা পার হতে হবে। তা না হলে উপায় নেই। গাড়িগুলোও অতিরিক্ত বেপারোয়া। কখন যে একটা অঘটনের কবলে পড়ে যাই তার নিশ্চয়তা নেই।

আমার বাসা রাস্তার ওপার আদর্শনগর গলিতে। প্রতিদিনই সকাল-বিকেল দুবার করে এ রাস্তা পার হই। খুব ভয়ে থাকি। একা পার হওয়ার সাহস পাই না। এজন্য আরও কয়েকজন না আসা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকি।

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।