রাব্বির নিষ্পাপ চোখ খুঁজে ফেরে বাবা ফারুককে
ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু মা ও ভাইদের কান্না দেখছে। মা-ভাইয়ের কান্না দেখে রাব্বিও মাঝে মধ্যে ঢুকরে কেঁদে উঠছে। সিএনজি অটোরিকশাচালক বাবা ফারুক যে চলে গেছেন না ফেরার দেশে তা বোঝার বয়সই যে হয়নি চার বছরের রাব্বির। তবে নিষ্পাপ চোখে আকুলতা নিয়ে মঙ্গলবার রাত থেকে খুঁজে ফিরছে বাবা ফারুককে।
বুধবার রাতেও বাবার অপেক্ষায় রাব্বি। মঙ্গলবার থেকে অপেক্ষা। বাসায় যে ফেরে না বাবা। কাজ শেষে বাবা বাসায় ফিরলে তার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। মায়ের কাছে কয়েকবার জানতেও চেয়েছে রাব্বি, ‘বাবা কোথায়?’ ছোট্ট ছেলে রাব্বিকে শুধু বুকে জড়িয়ে কেঁদেছেন। কিন্তু কোনোভাবে মেলাতে পারেননি উত্তর।
স্বামীর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর থেকেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। বুধবার দুপুরে ফারুকের মুগদার বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, তিনি সন্তান রাব্বিকে বুকে নিয়ে বিলাপ করছেন। “মানুষটা না খেয়েই বেড়িয়ে গেছে সেই ভোরে। একটু অপেক্ষা করতে বললাম। বললাম রান্না শেষ। শুনলো না, বেড়িয়ে গেলো। আর ফিরলো না। আমি এখন কী করবো, আমার অবুঝ সন্তানদের কী হবে।?”
একটু ভালো থাকার আশায় ১৮ বছর আগে ঢাকায় আসেন তারা। এরপর থেকেই মুগদার উত্তর মান্ডায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন। ১৪ বছর আগে তাদের কোলজুড়ে আসে প্রথম পুত্র সন্তান। চার বছর আগে তাদের ঘরে তৃতীয় সন্তান। স্বামীর চলে যাওয়া কোনোভাবে মানতে পারছেন না তিনি। বলছেন, “আমার সন্তানদের কী হবে? কে দেখবে এখন? কেই বা নেবে সন্তানদের পড়াশোনার দায়িত্ব?
মুগদার মান্ডা ব্রিজ থেকে উত্তর দিকে এগিয়ে কয়েকটি সরু গলির পরেই ফারুকের ঘর। গলি পেরিয়ে মগার বাড়ির একটি ছোট্ট খুপড়ি টিনশেডের ঘরেই স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে নিয়ে থাকতেন তিনি। ঘরে একটি খাট রাখার কারণে সেখানে তেমন কোনো জায়গাই নেই। অভাবের সংসার হওয়ায় ১৮ বছর ধরেই এ ঘরেই তারা গাদাগাদি করে বসবাস করছিলেন। নিজে অশিক্ষিত হলেও ভাড়ায় অটোরিকশা চালানো রোজগারে সন্তানদের ভর্তি করিয়েছিলেন স্কুলে। বড় ছেলে মো. পারভেজ মানিকনগর ইউসেপ স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে পড়ছে। আরিফুল ইসলাম পড়ছে তৃতীয় শ্রেণিতে। ছোট্ট ছেলে রাব্বিরর এখনো স্কুলের পাঠ খোলেনি।
ফারুকের ভাই হারুন জানান, ময়নাতদন্ত শেষে বুধবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কাছে ফারুকের লাশ হস্তান্তর করে। দুপুর ২টার দিকে বাসায় তার লাশ নিয়ে আসা হয়। সেখানে জানাজা শেষে বিকেলেই লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি ভোলার চরফ্যাশনের ওসমানগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন।
গত মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উত্তরার জসীমউদ্দীন রোডে মোহাম্মদপুর থেকে আব্দুল্লাহপুরগামী তেতুলিয়া পরিবহনের যাত্রীবাহী বাস (ঢাকা মেটো-ব-১১-৭৪৮৯) একটি সিএনজি অটোরিকশাকে ধাক্কা দেয়। প্রতিবাদ করতে সিএনজিচালক ফারুক ওই বাসের সামনে গিয়ে দাঁড়ান এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।
শুরু হয় দু’পক্ষের বাকবিতণ্ডা। একপর্যায়ে সিএনজিচালকের শরীরের ওপর বাস তুলে দেয় চালক ফারুক। এতে সিএনজিচালকের মাথাসহ শরীর থেতলে যায়। বাস নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যাওয়ার সময় যাত্রীদের সহযোগিতায় ওয়্যারলেস গেটে হাউস বিল্ডিংয়ের আমির কমপ্লেক্সের সামনে থেকে চালক ফারুককে আটক ও বাসটি জব্দ করে পুলিশ।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার রাতেই ফারুকের ভাই হারুন বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় বাসচালক মজিদের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
নিহতের পরিবারের অভিযোগ, তেতুলিয়া নামে ওই বাসটির বাসচালক আবদুল মজিদ (২৭) মালিক নুরুল ইসলামেরই নিজের ভাই। তিনি হত্যা মামলা তুলে নেয়ার জন্য মুঠোফোনে হুমকি ধামকি দিচ্ছেন।
নিহত সিএনজি চালকের ভাই হারুন বলেন, বাসটির মালিক নুরুল ইসলাম ফোন করে হুমকি দিচ্ছেন। ফোনে নুরুল ইসলাম হুমকি দিয়ে বলছেন, ‘আমার ভাইয়ের ড্রাইভিং লাইসেন্স নাই। আর অ্যাক্সিডেন্টের কোনো বিচার হয় না। আদালতে গেলে জামিন পাবে। মামলা তুলে নে নইলে সমস্যা হবে।’ বিষয়টি মৌখিকভাবে থানায় জানানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে বাসটির মালিক নুরুল ইসলাম অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করে বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ মিথ্যে। ভাইয়ের বিরুদ্ধেও হত্যার অভিযোগ মিথ্যে বলেও দাবি করেন তিনি।
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি মো. আলী হোসেন জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঘাতক চালক আবদুল মজিদ জানিয়েছে, তার কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই।
তিনি বলেন, “বুধবার মজিদকে আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত তাকে দু’দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দেয়। এর প্রেক্ষিতে রিমান্ড চলছে।
জেইউ/বিএ