স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি না কেনার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
দেশের জ্বালানি সংকট মেটাতে বেশি দাম দিয়ে হলেও স্পট মার্কেট (খোলা বাজার) থেকে তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গ্যাসের চাহিদা পূরণে চলতি বছরে স্পট মার্কেট থেকে মোট ১৮ কার্গো এলএনজি আমদানি করবে পেট্রোবাংলা। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৬ অক্টোবর স্পট মার্কেট থেকে আরও দুই কার্গো এলএনজি কেনার প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি।
এর আগে গত ২২ সেপ্টেম্বর সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ৩৩ লাখ ৬০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানির একটি প্রস্তাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। সে সময়ে প্রতি এমএমবিটিইউর দাম ছিল ২৯ দশমিক ৮৯ ডলার।
পেট্রোবাংলার সূত্রগুলো বলছে, এলএনজির দামে ঊর্ধ্বগতি থাকায় ডিসেম্বর পর্যন্ত স্পট মার্কেট থেকে পণ্যটি না কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে। কিন্তু গ্যাসের ঘাটতি বিবেচনায় জ্বালানি বিভাগ সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
এরপর ১৪ দিনের ব্যবধানে আরও দুই কার্গো এলএনজি কেনার সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়, তখন প্রতি এমএমবিইউর দাম ৬ ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ দশমিক ৯৫ ডলারে। এরই মধ্য দিয়ে চলতি মাসে ১ হাজার ৬১ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি হচ্ছে।
৬ অক্টোবর মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশি দামে এলএনজি কিনতে হচ্ছে। এ বছর আর না কিনলেও চলবে।
তবে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশের নেই। বাংলাদেশকে এলএনজি কিনতে হলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েই কিনতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের দিকে না তাকিয়ে থেকে নিজেদের উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের দিকে নজর দিতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, স্পট মার্কেট থেকে বাংলাদেশের এলএনজি কেনার কোনো প্রয়োজন নেই। যেসব দেশে, বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশগুলোতে পর্যাপ্ত জ্বালানি রয়েছে কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ খুব বেশি প্রয়োজন হয়, তারাই স্পট মার্কেট থেকে কিনবে। কিন্তু বাংলাদেশের তো সেই পরিস্থিতি নেই। আমাদের যেটা প্রয়োজন, আমরা তো সেটাই পাচ্ছি না। আমি বলতে চাই, দীর্ঘমেয়াদি যেসব চুক্তি হয়, সেখানেই থাকা ভালো। যদি কোনো কারণে বেশি প্রয়োজন হয়, তখন স্পট থেকে কেনা যাবে।
‘একটা সময় হয়তো স্পটে দাম খুব কম ছিল। তখন সরকারকে অনেকেই নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির চেয়ে আমরা স্পট থেকেই কম দামে কিনতে পারি। কিন্তু এখন দাম বেড়ে যাওয়ার কারণেও স্পট থেকেই কিনতে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, আমরা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করছি না, তা তো নয়। কিন্তু বললেই তো আর হয়ে যায় না, সময় তো লাগবে। আমরা পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি নিচ্ছি, আবার লং টার্মের প্রক্রিয়াও চলছে। স্পট থেকে না আনলে ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ হয়ে যেত। গত তিন মাসে ১১ শতাংশ রপ্তানি বাড়লো। আমরা যদি গ্যাস দিতে না পারতাম তাহলে এটা কীভাবে হতো? যারা সমালোচনা করেন, খুব সহজেই তারা বলে ফেলেন।
দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রতিদিন ৭৫-৮০ কোটি ঘনফুট এলএনজি প্রয়োজন। কিন্তু এর বিপরীতে দেশে এলএনজি সরবরাহের পরিমাণ হচ্ছে প্রায় ৪০ কোটি ঘনফুট। ঘাটতি থেকে যাচ্ছে ৩৫ কোটি ঘনফুটেরও বেশি। এই ঘাটতির পরিমাণ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে।
জানা যায়, গ্যাসের চাহিদা পূরণে চলতি বছর স্পট মার্কেট থেকে ১৮ কার্গো এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এতে চলতি বছর মোট আমদানি করা এলএনজির পরিমাণ দাঁড়াবে ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৬৪ হাজার ৫৫৬ এমএমবিটিইউ। এরই মধ্যে স্পট মার্কেট থেকে ১৪ কার্গো বা ৪ কোটি ৫৮ লাখ ৮৫ হাজার ১৬৯ এমএমবিটিইউ এলএনজি আমদানি করা হয়েছে। বাকি চার কার্গোর মধ্যে বুধবার (৬ অক্টোবর) ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি দুই কার্গো এলএনজি আমদানির অনুমোদন দিয়েছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েই চলছে এলএনজির দাম। গত বছর প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির দাম পড়েছিল ৩ দশমিক ৮৩ ডলার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৬৭ লাখ ২০ হাজার এমএমবিটিইউ এলএনজি কেনার একটি প্রস্তাব দেয় জ্বালানি বিভাগ। ক্রয়সংক্রান্ত কমিটির কাছে দেওয়া ওই প্রস্তাবে এলএনজির কার্গোতে ইউনিটপ্রতি দাম ধরা হয় ৯ দশমিক ৩১ ডলার এবং সপ্তম এলএলএনজি কার্গোতে ইউনিটপ্রতি দাম পড়ে ৯ দশমিক ৩৬ ডলার।
এরপর বিশ্বজুড়ে হু হু করে বাড়তে থাকা এলএনজি কেনার প্রস্তাব যখন ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে পাস হয়, তখন দাম দাঁড়ায় ৩৬ ডলারে।
সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এশিয়া অঞ্চলে স্পট মার্কেটে এলএনজি মূল্যের বেঞ্চমার্ক হিসেবে পরিচিত জাপান-কোরিয়া-মার্কার (জেএমকে) গত সপ্তাহে গিয়ে ঠেকে ৫৬ দশমিক ৩২৬ ডলারে। পরে অবশ্য তা কমে আসে। রয়টার্সের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরের জন্য স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজির মূল্য প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৮ দশমিক ৪০ ডলার। ফলে আগামীতে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনার চুক্তি করতে হলে চলমান দামেই তা কিনতে হবে।
এ নিয়ে জ্বালানি সচিব মো. আনিসুর রহমান বলেন, আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত আমাদের যে গ্যাসের চাহিদা আছে, তা আমরা সরবরাহ করতে পারবো। শিল্পের প্রয়োজনে আমরা স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আনতে বাধ্য হয়েছি। শুধু আমরা নই, আপনি সারা বিশ্বের দিকে তাকান। উন্নত বিশ্বও বিপর্যস্ত। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, চীন, আমাদের প্রতিবেশী ভারতের অবস্থাও দেখুন। সে তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি।
তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যেহেতু বাংলাদেশকে আমদানি করেই ঘাটাতি মেটাতে হচ্ছে, তাই কিনতেই হবে। তবে আরও সুবিধাজনক পন্থা ও বিকল্প ব্যবস্থার প্রচেষ্টাও থাকতে হবে।
এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার ম্যাগাজিনের সম্পাদক মোল্লা আমজাদ হোসেন জাগো নিউজকে এ বিষয়ে বলেন, পেঁয়াজের যখন ২শ টাকা দাম হয় তখনও মানুষ কেনে। ঠিক এনার্জিও দরকার হলে কিনতেই হবে। আমাদের রাজনীতিবিদরা ও পরিকল্পনা যারা নেন তারা বলেন, জাপান, কোরিয়া এলএনজি আমদানি করতে পারে, আমরা কেন পারবো না। শুধু একথা বলেই ২০০০ সালের পর থেকে গত ২০ বছরে বাংলাদেশ তেল গ্যাস অনুসন্ধান করেনি। অন্যদিকে কয়লা উত্তোলনও করেনি। আমেরিকা কয়লা উত্তোলন করে, চীন উত্তোলন করে। কিন্তু আমরা সরে আসছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের এনার্জি আমদানি ২০৪০ সাল থেকে শুরু করলেও চলতো। কিন্তু নিজস্ব গ্যাস, কয়লা উত্তোলন না করার কারণে আমদানি বেড়ে গেছে। বিশেষ করে এলএনজি আমদানির ওপর চাপ পড়েছে। এটা নিয়ে এখনো পর্যন্ত সরকারের কোনো ভালো পরিকল্পনা নেই। হুট করে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম ৫ ডলারে নেমে গেলো। তখন মনে হলো, কেন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে কিনছি! এটা স্পট মার্কেটে অনেক কমেও পাওয়া যাচ্ছে।
এলএনজির দাম নিয়ে তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ ২৯ থেকে ৩৬ ডলার পর্যন্ত দামে যে তিন কার্গো এলএনজি কেনা হলো, তাতে এ পর্যন্ত যদি এলএনজি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে সরকার কিনতো তাহলে প্রায় আড়াইশ মিলিয়ন ডলার কম খরচ হতো। ভবিষ্যতের কথা যদি বলা হয়, আজকে যে এলএনজি ৩৬ ডলারে কেনা হলো, জানুয়ারিতে গিয়ে সেটা ৫৬ ডলারেও পাবেন কি না এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
অন্যদিকে জ্বালানি সচিব আনিসুর রহমান বলেন, স্পট মার্কেটে এখন অস্বাভাবিক দাম। ডিসেম্বরের পর এই দাম থাকবে না। কিন্তু এটা আমরা একা নিচ্ছি, তা কিন্তু নয়। যুক্তরাজ্যের শিল্প মালিকরা বলেছে দাম কমাও না হলে আমরা কারখানা বন্ধ করে দেবো। তাদের মন্ত্রী বলেছেন, দাম কমানো সম্ভব নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলছে দাম সমন্বয় করো। আমরা তো সেটা করছি না। আমরা তো শিল্প-মালিকদের ক্ষতিতে ফেলছি না।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম জাগো নিউজকে বলেন, স্পট থেকে এলএনজি সাধারণত কেনা হয়, মূল চাহিদাটা পূরণের পরে যখন অতিরিক্ত প্রয়োজন হয় তখন। কিন্তু আমাদের মূল চাহিদাতেই ঘাটতি আছে। তাই আমি মনে করি, আমাদের স্পট থেকে বের হয়ে আসা উচিত। আমরা যখন যথেষ্ট পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন করতে পারবো বা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে যখন থাকবো। তখন যদি ঘটতি দেখা দেয়, আমরা হয়তো স্পট থেকে কিনতে পারি। কিন্তু এখন আমাদের স্পট থেকে সরে আসা উচিত।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী এনার্জি ক্রাইসিস চলছে। সবার জন্যই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বহু জায়গায় লোডশেডিং হচ্ছে। উন্নত দেশেও হচ্ছে। সে হিসেবে বাংলাদেশকে যদি এখন গ্যাস সরবরাহ রাখতে হয়, আমদানি করতেই হবে। কারণ, আমরা তো আমাদের কলকারখানা সব বন্ধ রাখতে পারবো না। এখন একটু টাকা খরচ হবে। এজন্য অর্থনৈতিক একটু সমস্যা হবে। আর আমদানিনির্ভর হলে আমাদের এটা মানতেই হবে।
তবে এলএনজি আনতে ডিসেম্বর নাগাদ দুটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করার আশা জানিয়ে জ্বালানি সচিব বলেন, স্পট থেকে আমরা এবারই আনছি তেমন নয়, আগেও এনেছিলাম। মাঝখানে দাম বেশি হওয়ায় বন্ধ করে দিয়েছিলাম। বন্ধ করার পর আবার ক্রাইসিস তৈরি হয়। সেই প্রেক্ষাপটে আবার আমরা গত মাসে তিনটি কার্গো আনলাম, এই মাসে দুটি। এতে আমাদের ডিসেম্বর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ থাকবে। প্রথমবার দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির জন্য ৬ বছর লেগেছিল। পরে সময় আরও কমেছে। এখন ৬ মাসের মধ্যেই হবে। আমরা কার্যক্রম শুরু করেছি আরও দেড়-দুই মাসের মধ্যে হয়ে যাবে।
এ অবস্থায় জ্বালানির ঘাটতি মেটাতে এলএনজি নির্ভরতা কমিয়ে কয়লা উত্তোলনের প্রতি জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
মোল্লা আমজাদ হোসেন এ নিয়ে বলেন, আমরা যদি এখন থেকে টার্গেট নিয়ে আগামী তিন বছরের মধ্যে নিজস্ব কয়লা উত্তোলন করে এটা দিয়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারি, তাহলে আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমে যাবে। আর আমদানিনির্ভর যদি আমরা থাকতে চাই, এখন যে পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে, ২০৩০ সাল আসলে কয়লা, এলএনজি ও বিদ্যুৎ মিলে সর্বমোট যে জ্বালানি প্রয়োজন হবে, তার ৯০ শতাংশ আমদানি করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি আমদানি করে টিকে থাকতে পারবেন কি না। যে টাকাটা ব্যয় করে আপনি আমদানি করছেন তা সামাল দিতে পারবেন কি না। আমি যতটুকু বুঝি- বাংলাদেশের ওই ব্যয় সামাল দেওয়ার মতো অর্থনৈতিক যোগ্যতা এখনো হয়নি।
এমআইএস/এমএইচআর/এএ/জেআইএম