খাদ্যখাতে আগ্রহ কম বিদেশি বিনিয়োগকারীদের!
অডিও শুনুন
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানির সংখ্যা ২০টি। এর মধ্যে ১৩টিতেই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কোনো বিনিয়োগ নেই। বাকি সাতটিতে বিনিয়োগ থাকলেও তা খুব বেশি নয়। এরপরও গত এক বছরে পাঁচটি কোম্পানি থেকে বিনিয়োগের একটি অংশ তুলে নিয়েছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।
এ খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারের প্রতি বিদেশিদের আগ্রহ কম থাকার কারণ হিসেবে বিশ্লেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানির সংখ্যা খুব বেশি নয়। এর মধ্যে দুটি বহুজাতিক কোম্পানি থাকলেও স্থানীয় কিছু ছোট প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোর আর্থিক ভিত খুব বেশি শক্তিশালী নয়। এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর শেয়ারের প্রতি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কম থাকার এটি একটি বড় কারণ।
তারা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অত্যন্ত দক্ষ। তারা বিনিয়োগের আগে অনেক কিছু পর্যালোচনা করেন। কোথায় বিনিয়োগ করলে ভালো রিটার্ন পাওয়া যাবে, তার ওপর ভিত্তি করে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। একই সঙ্গে কোথায় বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগ নিরাপদ থাকবে, সে বিষয়েও তারা খুব ভালো করে পর্যালোচনা করেন। যেসব কোম্পানিতে বিনিয়োগ নেই, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হয়তো মনে হয়েছে ওই কোম্পানিগুলো থেকে রিটার্ন কম পাওয়া যাবে।
তারা আরও বলেন, এখন বিদেশি বিনিয়োগ কম থাকলেও সামনে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ সরকার ও পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিএসইসি বিদেশি বিনিয়োগ আনার জন্য বিভিন্ন দেশে রোড শো করছে। এর একটা সুফল পাওয়া যেতে পারে।
তালিকাভুক্ত খাদ্য ও আনুষঙ্গিক কোম্পানিগুলোতে বিদেশিদের বিনিয়োগের চিত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুই বহুজাতিক কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো ও ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ারের পাশাপাশি ফু-ওয়াং ফুড, জেমিনি সি ফুড, গোল্ডেন হার্ভেস্ট, অলিম্পিক, রহিমা ফুডে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ রয়েছে।
এর মধ্যে গত এক বছরে রহিমা ফুড ও ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ার বাদে বাকি পাঁচ কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ কমেছে। রহিমা ফুডে বিদেশিদের বিনিয়োগ এক বছর ধরে কোনো পরিবর্তন হয়নি। ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ারে বিদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র দশমিক শূন্য ১ শতাংশ।
গত বছরের জুনে রহিমা ফুডের ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ বা ৯ লাখ ৯৮ হাজার শেয়ার ছিল বিদেশিদের কাছে, চলতি বছরের আগস্ট শেষেও তাই রয়েছে। গত বছরের জুনে ইউনিলিভার কনজ্যুমার কেয়ারের মোট শেয়ারের দশমিক ২৯ শতাংশ বা ৩৫ হাজার শেয়ার ছিল বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। চলতি বছরের আগস্ট শেষে তা বেড়ে দশমিক ৩০ শতাংশ বা ৩৬ হাজার শেয়ার।
কোম্পানিগুলোর মধ্যে বিদেশিদের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি রয়েছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজে। সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ কোম্পানিটির ২৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে। গত বছরের জুনে কোম্পানিটির ৪০ দশমিক ১৬ শতাংশ শেয়ার ছিল বিদেশিদের হাতে। এ হিসাবে এক বছরে কোম্পানিটির ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ শেয়ার ছেড়ে দিয়েছেন বিদেশিরা। কোম্পানিটির মোট শেয়ার সংখ্যা ১৯ কোটি ৯৯ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮৬টি। সুতরাং, গত এক বছরে বিদেশিরা বিক্রি করেছেন অলিম্পিকের ২ কোটি ৩১ লাখ ৯৩ হাজার শেয়ার।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ বিনিয়োগের তালিকায় পরের স্থানে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো। এ কোম্পানিটির ৯ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ বা ৪ কোটি ৮৮ লাখ ১৬ হাজার শেয়ার আছে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে। গত বছরের ডিসেম্বরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটির ১১ দশমিক ৪২ শতাংশ বা ৬ কোটি ১৬ লাখ ৬৮ হাজার শেয়ার ছিল। এ হিসেবে চলতি বছর বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিটির ২ দশমিক ৩৮ শতাংশ বা ১ কোটি ২৮ লাখ ৫২ হাজার শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন।
বাকি তিন কোম্পানির মধ্যে জেমিনি সি ফুডের দশমিক ৬৪ শতাংশ বা ৩০ হাজার শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে। গত বছরের জুনে ছিল দশমিক ৬৫ শতাংশ বা সাড়ে ৩০ হাজার শেয়ার। বিদেশিদের কাছে ফু-ওয়াং ফুডের দশমিক ২৫ শতাংশ বা ২ লাখ ৭৭ হাজার শেয়ার আছে। গত বছরের জুনে ছিল দশমিক ২৯ শতাংশ বা ৩ লাখ ২১ হাজার শেয়ার। গোল্ডেন হার্ভেস্টের দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ বা ১ লাখ ৯৪ হাজার শেয়ার আছে বিদেশিদের কাছে। গত বছরের জুনে ছিল দশমিক ৬২ শতাংশ বা ১৩ লাখ ৩৮ হাজার।
খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতের কোম্পানিগুলোর শেয়ারে বিদেশিদের আগ্রহ কম থাকার কারণ হিসেবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত রপ্তানি সংশ্লিষ্ট কোম্পানিতে বিনিয়োগে আগ্রহী। আমাদের দেশে খাদ্যদ্রব্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা আছে। এসব কারণেই হয়তো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের খাদ্য কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগের আগ্রহ কম। তাছাড়া বিদেশি বিনিয়োগকারীরা অত্যন্ত দক্ষ। তারা কোথায় বিনিয়োগ করলে বেশি রিটার্ন পাবে, তা পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়।
একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের কোম্পানি সচিব জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে গেছে। একটা সময় আসবে যখন শেয়ারবাজারে আরও দৃঢ় হবে, বিদেশিদের আস্থা বাড়বে। দেখা যায় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হয়, কারণ তারা মনে করে বহুজাতিক কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে ঠকবে না। কিন্তু লোকাল কোম্পানির ক্ষেত্রে ওই বিশ্বাসটা এখনো পুরোপুরি আসেনি। তার মানে আমি বলবো না লোকাল কোম্পানি খারাপ। হয়তো দু- একটা উল্টা-পাল্টা করে। তবে আমার ধারণা এক সময় না এক সময় বিদেশিরা বিনিয়োগ বাড়াবে।
অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের কোম্পানি সচিব নাজিমউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এখানে শেয়ার কিনে টাকা খরচ করে। এখন কোনো কোম্পানির শেয়ার বিদেশিরা কিনবে সেটা তার ব্যাপার, আমাদের কোনো বিষয় নেই। আমাদের কোম্পানির বড় অংকের শেয়ার বিদেশিরা কী কারণে কিনছে সেটাও আমি বলতে পারবো না।
জেমিনি সি ফুডের সহকারী কোম্পানি সচিব তানভির আহমেদ সাইফ জাগো নিউজকে বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা পর্যালোচনা করে বিনিয়োগ করেন। তারা হয়তো ওরকম সক্ষমতাসম্পন্ন কোম্পানি পাচ্ছেন না, যেখানে তারা বিনিয়োগ করবেন। তারা ওইরকম বিনিয়োগ করছেন না। যেগুলোতে করছেন তারা হয়তো গভীর পর্যালোচনা করে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। তারা যেগুলোকে বিনিয়োগ করার মতো কোম্পানি মনে করছেন, সেগুলোতে করছেন।
তিনি বলেন, খাদ্য ও আনুষঙ্গিক খাতে তালিকাভুক্ত কোম্পানি খুব বেশি নয়। আমার মনে হয়, এখন ধীরে ধীরে বিনিয়োগ বাড়বে। কারণ সরকার, বিএসইসি, বাংলাদেশ ব্যাংক, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছে। সুতরাং আমরা আশা করছি আমাদের এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে।
‘বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ রিটার্ন, মূলধন রিটার্ন সবকিছু পর্যালোচনা করেই বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেন। তারা হয়তো মনে করেন এখানে এতটুকু বিনিয়োগ করা উচিত, তারা তখন ওইভাবে বিনিয়োগে যাচ্ছেন। আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিদেশি বিনিয়োগ আরও বেশি হওয়ার কথা, কিন্তু ওই পরিমাণে হচ্ছে না।
এমএএস/এএ/এমএস