মহাসড়কে অবাধে চলছে থ্রি হুইলার : দেখার কেউ নেই
উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন মহাসড়কে কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সারা দেশের মহাসড়কে অটোরিকশা ও অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল সরকার। প্রথমদিকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হলেও এখন প্রকৃত চিত্র একেবারে উল্টো।
পুলিশকে ম্যানেজ করে আবারো পূর্বের মতো দিনে ও রাতে অবাধে সেই ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠছে অদক্ষ চালকরা। আর এই প্রতিযোগিতার বলির শিকার হয়েছে গত তিন মাসে ২৫ জন মানুষ। স্থানীয় পত্রিকার তথ্য ও পুলিশের হিসেব থেকে উঠে এসেছে এ চিত্র।
মঙ্গলবার একই ধরনের আরো দুইটি ঘটনা ঘটে সিরাজগঞ্জ ও রাজশাহীতে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের শাহাজাদপুর উপজেলার গাড়দাহ বকুলতলায় ভটভটিতে চড়ে দাওয়াতে যাওয়ার পথে তেলের লরির সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত হন একই পরিবারের ৯ জন। আর রাজশাহী শহরতলীর চৌদ্দপাই এলাকায় দুই বাস ও অটোরিকশার ত্রিমুখি সংঘর্ষে মারা যান আরো সাতজন। উভয় ঘটনাই আহতদের অবস্থাও সংকটাপন্ন।
বগুড়া বিআরটিএর সহকারী পরিচালক জিয়াউর রহমান জানান, বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে চালকদের সতর্ক করা হয়েছে। কিন্তু এক শ্রেণির চালক ও মালিকদের কারণে এই নিষেধাজ্ঞা ধরে রাখ যাচ্ছে না। পুলিশও এ ব্যাপারে সজাগ নয়। এ কারণে মহাসড়কে এই ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিযোগিতা বন্ধ হচ্ছে না।
সরেজমিন দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগের সময়ের মতোই মহাসড়কগুলোতে দেদার চলছে সব ধরনের থ্রি-হুইলার ও অযান্ত্রিক যান। অভিযোগ রয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের খুশি করে মহাসড়কে এসব যান চলাচল করছে। ফলে মহাসড়কে ফিরে এসেছে নিত্য নৈমিত্তিক দুর্ঘটনা।
বগুড়া হাইওয়ে পুলিশের তথ্য ও স্থানীয় পত্রিকার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গ মহাসড়কে তিন মাসে ২৫ জন প্রাণ হারিয়েছে এসব থ্রি হুইলার যানে চড়ে। নিহতদের মধ্যে শুধু সিরাজগঞ্জ এলাকাতেই রয়েছে ১২ জন।
এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু ইউসুফ বলেন, সরকারি ঘোষণার পর মহাসড়কে থ্রি-হুইলার চলাচল বন্ধে অভিযান চলছে। যদি কেউ নির্দেশ অমান্য করে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুসারে তিন মাসে সিরাজগঞ্জে চারটি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৭ জন। এর মধ্যে গত ২১ সেপ্টেম্বর রাতে উল্লাপাড়ায় ট্রাকচাপায় চার সিএনজিযাত্রী নিহত হন। এবার একই ভটভটিতে চড়ে মারা গেলেন একই পরিবারের ৯ জন।
এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদুল হক জানান, সরকারি নির্দেশনা পাওয়ার পর আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। প্রতিদিনই অভিযান চলছে। সম্প্রতি এক অভিযানে ৩৭টি অবৈধ গাড়ি আটক ও ১৪টি মামলা হয়েছে। তবে জনবল স্বল্পতার কারণে অনেক সময় অভিযান পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটছে। এই সুযোগে আবারো মহাসড়কে নামছে এসব অবৈধ যান।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বগুড়ার বিভিন্ন মহাসড়কে আগের মতোই চলছে নসিমন, করিমন ও থ্রি-হুইলার। ফলে মহাসড়কে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। সর্বশেষ বগুড়ার মোকামতলা এলাকায় ইজিবাইকের সঙ্গে বাসের সংঘর্ষে দুইজন মারা যান। সরকার এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে উদ্যোগ নিলেও মাঠ পর্যায়ে সঠিক তদারকি হচ্ছে না বলে মহাসড়কে চলাচলরত একাধিক যাত্রী অভিযোগ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আব্দুল লতিফ মন্ডল বলেন, তারা সড়ক সংস্কার ও অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধে প্রশাসনকে আল্টিমেটাম দিয়েছেন। কিন্তু কোনোভাবেই কাজ হচ্ছে না। এসব যান মহাসড়কে থাকলে দুর্ঘটনা কখনোই কমবে না।
বগুড়া জেলা সিএনজি অটোটেম্পু মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ শেখ বলেন, মহাসড়কে চলাচল করতে আমরা আমাদের সমিতিভুক্ত গাড়িদের নিষেধ করেছি। যারা চালাচ্ছে তারা নিজ দায়িত্বে চালাচ্ছেন। এসব চালকদের ধরে প্রশাসন শাস্তি দিলে আমরাদের কোনো সমস্যা নেই।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, পরিবহন শ্রমিকদের কাছে অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়ায় মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল বন্ধ করা যাচ্ছে না। নভেম্বর মাসে বগুড়ার মহাসড়কে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করায় ভ্রাম্যমাণ আদালত চার শ্রমিককে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এর প্রতিবাদে পরিবহন শ্রমিকরা বৈঠক করে ধর্মঘটের প্রস্তুতি নেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিষয়টি জানতে পেরে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত শ্রমিকদের জামিন দিয়ে পরিবহন ধর্মঘট ঠেকানো হয়। এরপর থেকে পুলিশ মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচলের বিষয়টি দেখেও না দেখার ভান করে।
বগুড়ার শাজাহানপুর এলাকার অটোরিকশা চালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, জেলা শহর থেকে শহরতলীর বিভিন্ন ইউনিয়ন ও বিভিন্ন উপজেলায় মহাসড়কের উপর দিয়েই চলাচল করতে হয়। তাই বিকল্প পথ ও পরিবহনের ব্যবস্থা না করে মহাসড়কের উপর তাদের গাড়ি চলাচল সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ করা সম্ভব নয়।
গাড়ি চালানোর জন্য পুলিশকে টাকা দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করে মহাসড়কের লিচুতলা অংশে চালাচলকারী অটোরিকশা চালক জব্বার আলী বলেন, সকালে গাড়ি চলাচলের জন্য বাধা দিলে তারা পুলিশকে ম্যানেজ মানি দিয়ে সারাদিন গাড়ি চালিয়েছেন।
তবে চালকদের ম্যানেজ মানির বিষয়টি অস্বীকার করেন হাইওয়ে ও থানা পুলিশ। শাজাহানপুর থানার ওসি আলমগীর হোসেন জানান, মহাসড়কে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। পুলিশকে ম্যানেজ করে মহাসড়কে চলাচল করার তথ্য মিথ্যা।
উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জ গোলচত্বরে মঙ্গলবার বেলা ১২টা পর্যন্ত চলাচল নিষিদ্ধ যানবাহন অবাধে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা যায়। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য বিকল্প পথ তৈরি না করে মহাসড়কে চলাচলে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করে হাটিকুমরুল অটোরিকশা মালিক সমিতির সভাপতি আনিছুর রহমান বলেন, সরকারের সিদ্বান্তে আমাদের দ্বিমত নেই। কিন্তু আমাদের জন্য বিকল্প রুট তৈরি করে দিতে হবে। না হলে গাড়ি বন্ধ করে রাখা সম্ভব নয়।
লিমন বাসার/এআরএ/বিএ