এলাকার করিম মাস্টার
অর্থের কাছে আমরা সবাই বন্দি। অর্থ থাকলেই সব হয় না। আবার অর্থ ছাড়া মানুষ চরম শিখরে পৌঁছতে পারে না। অর্থ ছাড়া মানুষ চলতেও পারে না। ইচ্ছে ছিল লেখাপড়া শিখে বড় চাকরি করার। অভাবের সংসারে জন্মগ্রহণ করায় সে আশাটা গুড়েবালি। তবে ছেলেকে দিয়ে সে স্বপ্ন পূরণ করার ইচ্ছা পোষন করেন নওগাঁর মান্দা উপজেলার কালীগ্রামের আব্দুল করিম (৪৯)।
দুই ছেলে তার। বড় ছেলে আতিকুর রহমান রাজশাহী কলেজে পরিসংখ্যান বিভাগে এবার অনার্স শেষবর্ষ এবং ছোট ছেলে আব্দুর রহমানের বয়স দুই বছর। স্ত্রী জোসনা খাতুন শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর দেখাশুনা করেন। এলাকার সবাই এক নামে চেনেন করিম মাস্টার। অনেকে মাস্টার ভাই ডাকেন। দীর্ঘ ৩২ যাবৎ টিউশনি (প্রাইভেট) করে আসছেন। টিউশনি করে চার সদস্যের জীবিকা নির্বাহ করেন।
অভাবের সংসারে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল করিম। সংসারে অভাব থাকায় বেশি পড়ালেখা করতে পারেনি। ১৯৮২ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। এরপর পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে বাবার সঙ্গে অন্যের বাড়িতে কামলা দেন। ১৯৮৪ সালে ৪/৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে টিউশনি শুরু করেন।
গ্রামে সারাদিন পরের বাড়িতে কাজ আর সন্ধ্যায় বাচ্চাদের পড়ানো। প্রথম দিকে বাচ্চাদের রেজাল্ট ভালো হওয়ায় অন্যান্য অবিভাবকরা জানতে চান যে তারা কার কাছে পড়েন। বাচ্চারা বলেন করিম স্যার আমাদের পড়ান। পরে অবিভাবকরা তাদের বাচ্চাকে তার কাছে পড়াতে চান। তখন ঝরেপড়া ও গরিব পরিবারের ১০ জন বাচ্চা নিয়ে পড়ানো শুরু হয়। তারাও ফলাফল ভালো করে।
করিম মাস্টার জানান, প্রতিবেশী আলমগীর নামে এক বড় ভাই কাজ করা ছেড়ে দিয়ে আমাকে টিউশনি শুরু করতে বলেন। আমি যুক্তি দিয়ে তাকে বললাম আমার তো ডিগ্রি নাই। অবিভাবকরা কি বাচ্চাদের আমার কাছে পড়াতে দিবেন? অবিভাবকরা টাকাই বা দিবেন কেন? চিন্তায় পড়ে গেলাম কী করা যায়। আর কাজ না করলে খাবো কী? বড় ভাই আবারও বললেন- তুমি কাজে লেগে দেখো সবাই টাকা দিবেন। ভয় হলো টাকা না পেলে তো পরিবার চালানো যাবে না।
১৯৮৫ সালে ৩০ জন বাচ্চাকে নিয়ে টিউশনি শুরু হলো। অভিভাবকরা খুশি হয়ে টাকা দিতে শুরু করলেন। আমি বাচ্চাদের ভালোভাবে পড়ানো শুরু করলাম। মাস শেষ হলে বাচ্চারা টাকা নিয়ে আসে। ৩০ জনের ফলাফলও ভালো হলো। সবাই তো প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া সম্ভব নয়। অনুপাত অনুসারে তারা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। মান অনুুসারে তারা ফলাফল ভালো করলো।
মাস্টার জানান, পরের বছর বাচ্চাদের সংখ্যা বেড়ে গেলো। একটা ব্যাচ (গ্রুপ-দল) করে বাড়ি বাড়ি যেয়ে পড়ানো শুরু করলাম। স্কুলের বারান্দায় এবং বাড়িতে যেয়ে পড়াতাম। তখনও কাজ করতাম পরের বাড়িতে। বাচ্চাদের সংখ্যা যখন বৃদ্ধি পেলো আলমগীর ভাই তখন বললেন, তুমি আর কাজ করো না। কাজ ছেড়ে দিয়ে এখন টিউশনিতে মন দাও।
কালীগ্রামে অবস্থিত শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘরের পরিচালক ভাই জাহাঙ্গীর আলম শাহ একদিন আমাকে ডেকে বললেন, বাড়ি বাড়ি যেয়ে টিউশনি না করে জাদুঘরে বসে বাচ্চাদের পড়াতে। বাচ্চারা লাইব্রেরিমুখি হবে। তারা এখানে এসে বসে বিভিন্ন গল্পের বই পড়বে। অনেক কিছু শিখতে ও জানতে পারবে। ২০০৮ সাল থেকে এই জাদুঘর পড়ানো শুরু হয়। ১ম থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে ১০টা এবং দুপুর ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কয়েকটি স্কুলের ৭০ জনের মতো বাচ্চাদের পড়ানো হয়। গ্রামের প্রায় সবাই গরিব পরিবারের সন্তান। শ্রেণি অনুসারে টাকা বেশি না নিয়ে সবার কাছ থেকে ১’শ টাকা করে বেতন নেয়া হয়।
জাদুঘরের বারান্দায় বাচ্চাদের বসার জন্য মাদুর ও গরমের সময় স্ট্যান ফ্যান, বাথরুমের সঙ্গে পানির ট্যাফ এবং রাতের ব্যাচের জন্য লাইটের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বড় কথা হচ্ছে বাচ্চাদের কলম ফুরিয়ে গেলে পুরাতন কলম জমা নিয়ে আবার নতুন কলম দেয়া হয়। বাচ্চাদের লাইব্রেরির প্রতি আগ্রহ বাড়াতে এটি শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘর থেকে দেয়া হয়।
করিম মাস্টার আনন্দের সঙ্গে জানান, সবচেয়ে ভালো লাগে শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগার ও কৃষি জাদুঘরে নতুন কোনো অতিথি এলে বাচ্চারা তাকে সালাম দেন ও কুশল বিনিময় করেন। এছাড়া হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে কথা বলতে, কবিতা আবৃত্তি ও গান বলতে পারে। কিন্তু আমাদের মতো অনেকেই আছেন যারা মঞ্চে উঠে কথা বলতে কাঁপাকাপি ও ভীতি বোধ করি। এখানে কোনো বাচ্চাদের মধ্যে সেই জড়তা নেই। তারা আনন্দ বিনোদনের সঙ্গে পড়াশুনা করতে পারে।
এখন আর পরের বাড়িতে কামলা দিতে হয় না। টিউশনি করে ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় সংসার ও ছেলের পড়াশুনার খরচ যোগান। ছেলেকে দিয়ে স্বপ্ন পূণি করতে চান আবদুল করিম।
তিনি বিশ্বাস করেন, স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে পড়াশুনাই শুধু পড়াশুনা নয়। বাহিরের জগতকে জানা, জগতের সঙ্গে মেশাটাই বড় কথা। অর্থ সকল অনর্থের মূল, কথাটা কিন্তু ঠিক, ঠিক না। অর্থ থাকলে সব হয় না। অর্থ ছাড়া মানুষ চরম শিখরে পৌঁছতে পারে না। আবার অর্থ ছাড়া মানুষ চলতে পারে না।
আব্বাস আলী/বিএ