গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ প্রতিরোধে পথ দেখাচ্ছে এফএও’র টিকা
২০১৯ সালে দেশে প্রথম দেখা যায় গরুর লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি)। সে বছর থেকে গবাদিপশুর এ ভাইরাসজনিত নতুন রোগটি জুন মাসে শুরু হয়ে জুলাইয়ে গিয়ে মহামারি আকার নিচ্ছে। প্রথম বছর প্রায় আড়াই লাখ, দ্বিতীয় বছর তিন লাখ পশু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। দেশে এখনও এ রোগের প্রতিষেধক ও সঠিক ওষুধ না থাকায় সংক্রমণ মৌসুমে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন খামারিরা।
এমন পরিস্থিতিতে কিছুটা স্বস্তির খবর দিচ্ছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) একটি টিকা কার্যক্রম। যদিও প্রকল্পটি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে, তবে এখন পর্যন্ত এটি মহামারি প্রতিরোধে আশার আলো দেখাচ্ছে।
সংস্থাটি এলএসডি প্রতিরোধী মডেল হিসেবে এ পর্যন্ত দেশের ৭০ হাজার গরুকে ওই টিকা দিয়েছে। পরীক্ষামূলকভাবে দেশের তিন জেলা চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও দিনাজপুরের তিন উপজেলায় এ টিকা দেয়া হয়েছে। টিকা দেয়া সেসব গরু এখন পর্যবেক্ষণে রয়েছে।
এফএও’র এ কাজে সহায়তা দিচ্ছে প্রাণিসম্পদ অধিদফতর। এটির পরীক্ষা পর্যায় শেষে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে সারাদেশেই প্রয়োগ শুরু হবে।
এ বিষয়ে অধিদফতরের উপপরিচালক (প্রাণী স্বাস্থ্য) ডা. মো. শাহিনুর আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ পাইলটিং সফল হলে সেটা সারাদেশে চালুর জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। অনুমোদন পেলে সব এলাকায় এলএসডির টিকা দেয়া হবে।’
এফএও’র এ প্রকল্পে সরাসরি কাজ করছেন উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. মোজাফ্ফর ওসমানী জুয়েল। তিনি বলেন, ‘এফএও’র একটি জরুরি তহবিল থেকে এ ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। এ ভ্যাকসিন কতোটুকু সুরক্ষা দেয় সেটা এখন পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। আমরা ইতিমধ্যে ভ্যাকসিন দেয়া পরবর্তী কার্যক্রমগুলো করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘এফএও এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য নিচ্ছে, পরামর্শ দিচ্ছে। সেগুলো সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। তারা প্রশিক্ষণও দিচ্ছে। এসব ভ্যাকসিন এফএও’র জর্ডানের ফরমুলায় দেশের একটি কোম্পানির কাছে তৈরি করে নিয়েছে। এখন সারাদেশে কতো ভ্যাকসিনের প্রয়োজন, কেমন খরচ হবে এবং এজন্য কত জনবল প্রয়োজন এসব বিষয়ে আমরা কাজ করছি। সম্পূর্ণ প্রস্তাবনা তৈরি করে সেটা মন্ত্রণালয়ে দেয়া হবে।’
এদিকে এ বছর ইতিমধ্যে দেশের কিছু এলাকায় এলএসডি সংক্রমণের খবর মিলেছে। এখনও ভ্যাকসিন দেয়া ওই ৭০ হাজার গরুর কোনোটি আক্রান্ত হয়নি। এছাড়া প্রাণিসম্পদ অধিদফতর বলছে, বিগত সময়ে গোট পক্সের টিকা দিয়ে চিকিৎসা করা হয়েছে অনেক গরুকে। তাতে কিছুটা সুফলতাও পাওয়া গিয়েছিল। সেসব গরুর আক্রান্তের শঙ্কা এখন কম।
এফএও’র টিকা দেয়া হয়েছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলায়। সেখানকার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আনিসুর ইসলাম বলেন, ‘এ উপজেলায় ২৫ হাজার গরুকে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি টিকা দেয়া হয়েছিল। চারটি ইউনিয়নে সার্ভের মাধ্যমে ২৫ হাজার গরুকে এ টিকা দেয়া হয়েছে। ওই চার ইউনিয়নের মধ্যে এখনও এলএসডি নেই। কিন্তু ইতিমধ্যে অন্য ইউনিয়নে এলএসডি দেখা দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এফএও’র সঙ্গে গত ১০ তারিখে আমাদের মিটিং হয়েছে। তাদের সিদ্ধান্ত মতো ওই চার ইউনিয়ন ও পাশে আরও চারটি ইউনিয়ন যেখানে টিকা দেয়া হয়নি, এমন আটটি ইউনিয়নে ১৬ জন কর্মকর্তার মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং শুরু হয়েছে। এতে টিকা দেয়া এলাকায় এলএসডি আক্রান্ত গরু পাওয়া যায়নি। কিন্তু এর বাইরের এলাকায় দুটি আক্রান্ত গরু পাওয়া গেছে।’
আনিসুর ইসলাম আরও বলেন, ‘এ পর্যন্ত এ মডেল সম্পূর্ণ সফল মনে হচ্ছে। এমন টিকা সব গরুকে দেয়া হলে এলএসডি মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। পর্যবেক্ষণ এলাকায় গত বছর প্রায় ২৫০-৩০০ গরু এলএসডিতে আক্রান্ত ছিল।’
এলএসডির বিস্তার যেভাবে
এলএসডি প্রথম দেখা দেয় চট্টগ্রামে। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে কর্ণফুলী উপজেলার একটি খামারে ধরা পড়ে রোগটি। পরবর্তী সময়ে ছড়ায় অন্যান্য জেলায়।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, প্রথম বছরই ৪০টি জেলায় ছড়িয়েছে রোগটি। এসব জেলায় আক্রান্ত হয়েছে প্রায় আড়াই লাখ গরু। বেশকিছু গরু মারাও গেছে। পরের বছর আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩ লাখ। গোট পক্সের টিকার মাধ্যমে চিকিৎসা করায় মৃত্যুর হার কমেছে। এ বছরও প্রচুর গরুকে বিকল্প হিসেবে গোট পক্সের টিকা দেয়া হয়েছে।
সংক্রমণের ধরন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা-মাছি ও পোকার মাধ্যমে ছড়ায় এ রোগ। এ রোগে আক্রান্ত গরুর শরীরের তাপমাত্রা ১০৩-১০৫ ডিগ্রিতে বেড়ে দাঁড়ায়। গরু খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়। শরীরে প্রচণ্ড জ্বর আসে। পাশাপাশি গরুর শরীরের বসন্তের মতো গুটি গুটি চাকা দেখা দেয়। পরে সেখান থেকে পুঁজ জমে ফেটে মাংস খসে পড়ে। ফলে দুধ উৎপাদনও কমে যায়।
খামারিরা অভিযোগ করেন, দেশে প্রতি বছর ভুটান, নেপাল, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে গরু আমদানি করা হয়। এমনকি কার্গো বিমানে ব্রাহামা জাতের গরুও আনা হচ্ছে। কিন্তু আমদানিকারকরা কী ধরনের গরু আনছেন বা আমদানি করা গরুর শরীরে প্রাণঘাতী ভাইরাস আছে কি না, সে পরীক্ষা করা হচ্ছে না, যা রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মাহবুব আলম বলেন, ‘মূলত মশা ও মাছির মাধ্যমে ভাইরাসজনিত রোগটি সারাদেশে সম্প্রসারিত হচ্ছে। আগে এ ধরনের রোগ দেশে ছিল না। ওষুধেরও তাই প্রয়োজন পড়েনি। লাম্পি স্কিন ডিজিজের চিকিৎসায় গোট পক্সের ভ্যাকসিন প্রাথমিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। তবে এ ভ্যাকসিনেরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে দেশে।’
এনএইচ/এমএইচআর/এসএইচএস/জিকেএস