প্রকল্প সমাপ্তির বিষয়ে সরকারের কড়া নির্দেশনাও কাজে আসছে না

প্রদীপ দাস
প্রদীপ দাস প্রদীপ দাস , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৪৭ পিএম, ১৭ মে ২০২১
গাজীপুর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মধ্যে ২০.৫ কিলোমিটার বিআরটি লাইন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল ২০১২ সালে, কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে, তবে তা এখনো শেষ হয়নি

উন্নয়ন প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা সরকারের বড় চ্যালেঞ্জ। সিংহভাগ ক্ষেত্রেই এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ব্যর্থ সরকার। প্রায় প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন প্রকল্প যুক্ত হলেও সেই তুলনায় পুরোনো প্রকল্প সমাপ্ত না হওয়ায় ভারী হচ্ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার। ফলে বর্তমান এডিপিতে থাকা ১৭০০’র বেশি প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে খাবি খাচ্ছে মন্ত্রণালয়গুলো। এ সমস্যা সমাধানে প্রায় প্রতি অর্থবছরই কিছু প্রকল্প সমাপ্তির জন্য নির্দেশনা দেয় সরকার। কখনো কঠোর নির্দেশনাও সরকার দিয়ে থাকে। তার পরও সেসব প্রকল্প সমাপ্ত করা হয় না। এতে প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হয় জনগণ। বড় আকারের অর্থও গচ্চা দিতে হয় সরকারকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটছে। অসৎ উদ্দেশ্যে বা অপরিকল্পিত কোনো প্রকল্প একবার এডিপিতে ঢুকে গেলে বা জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পেয়ে গেলে, যতই নির্দেশনা দেয়া হোক না কেন তা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন। তাই সমস্যার গোড়া চিহ্নিত করতে হবে। যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে ও অপরিকল্পিত প্রকল্প এডিপিতে ঢুকে যাচ্ছে, তা বন্ধ করা না গেলে এর সমাধান হবে না। সরকার জানার পরও নানা কারণে তা বন্ধ করছে না বলেও বিশেষজ্ঞদের মত।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য মতে, গত ২ মার্চ ২০২০-২১ অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) অনুমোদনের সময় অনুষ্ঠিত এনইসি সভার ৫.৩ নম্বর সিদ্ধান্তে ৪৪২টি প্রকল্প ২০২১ সালের জুনের মধ্যে আবশ্যিকভাবে সমাপ্ত করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অথচ সেই নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করে ৪৪২টির মধ্যে ৫৭টি প্রকল্প ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপিতে পুনরায় অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে। কেবল তাই নয়, এই ৫৭টির মধ্যে ১৫টি ২০১৯-২০ অর্থবছরেও সমাপ্তির জন্য নির্ধারিত ছিল। ২০২০-২১ অর্থবছরের এই ১৫ প্রকল্পসহ মোট ১৩৭টি প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর ২০২১ সালের জনু পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছিল।

এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী জাগো নিউজকে বলেন, ‘মঙ্গলবার (১৮ মে) আবার এনইসি আছে। তখন এগুলো আবার ওঠানো হবে। তখন আলোচনা হবে। প্রধানমন্ত্রীকে দেখানো হবে। তাই এগুলোর ক্ষেত্রে কী হবে, তা জানার জন্য মঙ্গলবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

অবশ্য এ বিষয়ে আইএমইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনিবার্য কারণে কোনো প্রকল্প সমাপ্ত করা সম্ভব না হলে প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির আগে পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের পূর্বানুমোদন/সম্মতি গ্রহণ করতে হবে মর্মে এনইসি সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল।

আইএমইডির তথ্য আরও বলছে, এডিপি প্রণয়নের নির্দেশনায় যেসব প্রকল্পের মেয়াদ ২০২১ সালের জুনে শেষ হবে সেসব প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি ছাড়া ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে (নির্দেশিকা অনুচ্ছেদ ৩.৪)। কিন্তু অনুমোদিত ডিপিপি/টিএপিপি অনুযায়ী, এই জুনে মেয়াদ শেষ হবে এমন ৬৭৮টি প্রকল্প ২০২১-২২ অর্থবছরের এডিপিতে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছে।

অতীত অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করে আইএমইডির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মেয়াদ বৃদ্ধি যথাসময়ে না হওয়ায় অর্থবছরের প্রথম ৪-৫ মাস এসব প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ করা অর্থছাড় ও ব্যয় করা সম্ভব হয় না। ফলে এডিপির বরাদ্দ ব্যবহার কমে এবং সামগ্রিকভাবে এডিপি বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন মেয়াদকাল ২০২১ সালের জুনের মধ্যে বৃদ্ধি বা সংশোধনের সব কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন, যাতে নতুন অর্থবছরের শুরু থেকেই প্রকল্পগুলোর জন্য বরাদ্দ করা অর্থছাড় ও ব্যয় করা সম্ভব হয়। বাস্তবায়ন মেয়াদকাল বাড়ানো ছাড়া এসব প্রকল্পের বরাদ্দ করা অর্থছাড় ও ব্যয় করা যাবে না।

এ বিষয়ে আইএমইডি সচিব বলেন, ‘এগুলোও এনইসিতে আসবে। সম্ভবত আগামী অর্থবছরে তারকা চিহ্নিত প্রকল্প হিসেবে এগুলোকে যুক্ত করা হবে। এগুলো যেহেতু এখন শেষ হবে না বলে ধরেই নেয়া হয়েছে, ফলে তারকা চিহ্নে ব্যাখ্যা আসবে যে, এই প্রকল্পগুলো ২০২১ অর্থবছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল, পরিস্থিতির কারণে এগুলো নতুন অর্থবছরে যুক্ত করা যেতে পারে।’

সরকারের নির্দেশনার ফল বাস্তবায়নে দেখা যায় না
সরকার নির্দেশনা দিলেও প্রকল্প সমাপ্তির ক্ষেত্রে তার ফল দেখা যায় না বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতি বছরই এরকম ঘটনা আমরা দেখি। অসমাপ্ত প্রকল্পের একটা লক্ষ্য থাকে যে, আগামী অর্থবছরে এতগুলো প্রকল্প শেষ করা হবে। এডিপি থেকে বেরিয়ে যাবে। প্রতি বছরই আবার শেষের দিকে দেখা যায় যে, এগুলো টার্গেটের অনেক পেছনে আছে। কিছু ক্ষেত্রে দেখি প্রকল্প সমাপ্ত হয় নাই, তারপরও সমাপ্ত করে দেয়া হয়েছে। পরে আবার অন্যভাবে ওটা ম্যানেজ করা হয়। ইতিহাসই আসলে বলে দিচ্ছে, এ ধরনের নির্দেশনার কোনো ফলাফলই এডিপির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। একই প্রক্রিয়া বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটে।’

সমস্যার গোড়া কোথায়
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এসব সমস্যা সমাধানে সমস্যার গোড়া চিহ্নিত করতে হবে। এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে কেন? একবার একটা কিছু হয়ে গেলে সেটা নির্দেশনা দিয়ে উল্টে দেয়া যায় না। প্রকল্প একবার এডিপিতে ঢুকে গেল, বরাদ্দ দেয়া হলো, প্রতি বছর ব্যয় হলো, পাঁচ বছর পর এসে বলা হচ্ছে এটা এখনো সমাপ্ত হচ্ছে না কেন! বাদ দিয়ে দেন!’

যে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রকল্পটি এডিপিতে ঢুকে গিয়েছিল তা যদি বন্ধ করা না যায়, তাহলে এর সমাধান হবে না বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বিশ্বব্যাংকের সাবেক এ লিড ইকোনমিস্ট বলেন, ‘বালতিতে যদি একটা ছিদ্র থেকে যায়, পানি ঢালবেন আর পানি পড়া বন্ধ করবেন একটা স্কচটেপ লাগিয়ে, তাহলে ওই স্কচটেপ তো বেশিদিন টিকবে না। যেহেতু উপরে পানি ঢালছেনই, ওই স্কচটেপ তো বেশিদিন টিকবে না।’

সমস্যা চিহ্নিত করার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, ‘এডিপিতে ঢোকার পরে দেখা যায়, প্রকল্পগুলো সুপরিকল্পিতভাবে ঢুকে নাই। বাস্তবায়নের জন্য এগুলো প্রস্তুত নয়। নকশায় ত্রুটি আছে বা নকশা পুরোপুরি চিন্তা করে ডিপিপি তৈরি হয় নাই। ডিপিপি তৈরি হয়েছে এটাকে পাস করানোর জন্য। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় অর্থায়নেরও ব্যবস্থা করা হয় না। ভূমি অধিগ্রহণের সমস্যার সমাধান হয় না। কর্মকর্তা নিয়েও জটিলতা থাকে। কেনাকাটায় পরিকল্পনা নাই। দুর্নীতি তো প্রত্যেক ক্ষেত্রেই আছে, এটা তো কমন। কাজেই প্রস্তুত প্রকল্পগুলো যদি এডিপিতে ঢোকানো বন্ধ করা না যায়, তাহলে সমস্যা প্রতি বছর থেকেই যাবে। আর একবার এডিপিতে ঢুকে গেলে ওই প্রকল্পকে যতই নির্দেশনা দেয়া হয় না কেন, সেটা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন হয়ে যায়।’

অসমাপ্ত প্রকল্প সমাপ্ত করার লক্ষ্যে নিয়েও অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত
ড. জাহিদ বলেন, ‘আমরা তো দেখেছি, অসমাপ্ত প্রকল্প সমাপ্ত করার প্রকল্প নেয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। ওই প্রকল্পই সমাপ্ত করা হয় নাই। সেটাকেই অসমাপ্ত অবস্থায় সমাপ্ত বলে শেষ করে দেয়া হয়েছে। কাজেই সমস্যা যে কত গভীরে গেছে, তা বোঝা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহেই এডিপিতে নতুন প্রকল্প যুক্ত হচ্ছে। ফলে এখন প্রায় ১৭০০’র মতো প্রকল্প হয়েছে। মানে এডিপি খুব ভারী হয়ে যাচ্ছে। এমন না যে বড় বড় প্রকল্প নিয়ে এডিপির আকার বাড়াচ্ছি। প্রকল্পের সংখ্যা বাড়িয়ে এডিপির আকার বাড়াচ্ছি। এডিপিতে প্রবেশ ও বাতিলের মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকতে হবে। সেই ভারসাম্য না থাকার কারণে এডিপি ভারী হয়ে যাচ্ছে। এটাই গোড়ার সমস্যা।’

ডিপিপির সমস্যা নিয়ে প্রচুর সুপারিশ আছে। সরকার যে জানে না তা নয়। টেকনিক্যাল সমাধানগুলো জানা আছে। নানা কারণে সরকার হয়তো সেই পথে হাঁটে না বলেও মনে করেন তিনি।

সরকারের প্রকল্প যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া ঠিকমতো কাজ করছে না
প্রকল্প বাছাই করার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা আছে উল্লেখ করে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমরা ঠিকমতো বাছাই করতে পারি না। বাছাই করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক যে কাঠামো আছে, তা পুরোপুরি কাজ করছে না। মানে মন্ত্রণালয় তৈরি করবে, সচিব অনুমোদন করবেন, মন্ত্রী দেখবেন, তারপর এটা পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যাবে, পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তা দেখবে, তারা এটাকে যাচাই-বাছাই করে দেখবে। মানে তৃতীয় পক্ষের মূল্যায়ন। তারপর তারা প্রশ্ন করবে, সেটা মন্ত্রণালয়ে ফিরে যাবে। মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনের প্রশ্নের উত্তর দেবে। সংশোধন করবে। আবার পরিকল্পনা কমিশনে আসবে। তারপর প্রস্তুত হলে এটা একনেকে যাবে। এই প্রক্রিয়া তো ঠিকমতো কাজ করছে না। সেটা তো প্রকল্প দেখলেই বোঝা যায়।’

যে পথে সমাধান
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘এটা সমাধানের যে সংস্কারগুলো দরকার, সেটা করার পর যদি বলা হয় যে, আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে তো এডিপিতে প্রকল্প এসে গেছে। ঠিক আছে, এগুলো এখন সমাপ্ত করার জন্য আমরা কী করতে পারি। হয় এগুলো অসমাপ্ত অবস্থায় প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া যেতে পারে অথবা নির্মাণ প্রকল্প যেমন সেতু, স্কুল, রাস্তা—যেগুলো নির্মাণভিত্তিক কাজ, সেগুলো শেষ করা যেতে পারে। কারণ এগুলো করলে হয়তো অর্থনীতি উপকার পাবে। এছাড়া তো প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি—এ ধরনের সফট প্রকল্প থাকে। এগুলো শেষ না করে বাদ দিয়ে দিলেও খুব একটা প্রভাব পড়বে না। যাচাই-বাছাই করে এই সমস্যার সমাধান করা যায়।’

পিডি/এসএইচএস/এইচএ/এমকেএইচ

আমরা তো দেখেছি, অসমাপ্ত প্রকল্প সমাপ্ত করার প্রকল্প নেয়া হয়েছিল কয়েক বছর আগে। ওই প্রকল্পই সমাপ্ত করা হয় নাই। সেটাকেই অসমাপ্ত অবস্থায় সমাপ্ত বলে শেষ করে দেয়া হয়েছে। কাজেই সমস্যা যে কত গভীরে গেছে, তা বোঝা যায়

আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে তো এডিপিতে প্রকল্প এসে গেছে। ঠিক আছে, এগুলো এখন সমাপ্ত করার জন্য আমরা কী করতে পারি। হয় এগুলো অসমাপ্ত অবস্থায় প্রকল্প থেকে বাদ দেয়া যেতে পারে। অথবা নির্মাণ প্রকল্প যেমন সেতু, স্কুল, রাস্তা – যেগুলো নির্মাণভিত্তিক কাজ, সেগুলো শেষ করা যেতে পারে

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।