যে স্কুলে খাওয়া-পড়া একসঙ্গে


প্রকাশিত: ০৯:৪৫ এএম, ০১ ডিসেম্বর ২০১৫

ঠাকুরগাঁও জেলার হরিপুর উপজেলা সীমান্তবর্তী এলাকা চরভিটা গ্রাম। সীমান্ত এলাকায় ভালো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় অসংখ্য শিশু শিক্ষাবঞ্চিত ছিল। এলাকার সচেতন অভিভাবকরাও এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন। শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।

এমন অবস্থা যখন চলছিল, ঠিক সে সময় এলাকাবাসী একাধিকবার উদ্যোগ নেন একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। অবশেষে ২০০১ সালে বাড়ির পাশে ইরফান আলী নামে একজন নিজের ৪০ শতক জমির উপর এলাকাবাসীর সাহায্য নিয়ে বাঁশের ঘর দিয়ে তৈরি করেন চরভিটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে শুরু হয় ওই বিদ্যালয়ের পাঠদান। সে সময় ৫০ জন ছাত্রছাত্রী পাওয়া যায়।

তাদের নিয়েই আলোর পথে যাওয়ার যুদ্ধ শুরু। কঠিন পরিশ্রম, অনেক চেষ্টা কিন্তু ছাত্রছাত্রী বাড়ছিল না। দারিদ্র পীড়িত এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ খাবার জোটাতে না পেরে পাশের গ্রামে বা দূরে কোথাও নিজের সন্তানকে দিয়েছেন গৃহ শ্রমিকের কাজে। এদের নিয়ে ইরফানের এবার নতুন ভাবনা।

Thakurgaon-charvita-school

তার স্কুলে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের অনুরোধ করে তার সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর অনুরোধ করলেন আর বই খাতা কাগজ কলম ও দুপুরে খাওয়ার দায়িত্ব নিলেন নিজে। শিক্ষার্থী বাড়তে শুরু করলো। বিভিন্ন অফিসে, চেয়ারম্যানের কাছে ধর্ণা দিয়ে খাতা কাগজ, কলম পেয়ে গেলেন। নিজের অর্থে ২০১৪ সালের ১ জুলাই শুরু করলেন মিড ডে মিল। কিছুদিন চালানোর পর হিমশিম খেতে শুরু করলেন।

তারপর প্রতিবেশিদের নিয়ে আলোচনার পর ঠিক হলো রান্নার সময় সব মায়েরা মুষ্টি চাল রাখবেন আর সেটি প্রতি সপ্তাহে দিবেন মিড ডে মিলের তহবিলে। তা দিয়েও চালানো কঠিন। এবার স্কুলের পাশে দুটি পুকুর লিজ নিয়ে সেখানে মাছ ও হাঁস চাষ করেন। এখন সেখানে ১শ ৬০টি হাঁস রয়েছে। স্কুল থেকে একটু দূরে হলেও নিজের জমিতে চাষ করলেন পেঁপে বাগান। হাঁস, মাছ আর পেঁপে থেকে যা আসে তার সঙ্গে যোগ হয় মুষ্টি চাল। নিজের সাধ্যে চালাতে থাকেন দিনের পর দিন।

কিছুদিন আগে স্কুলে জেলা প্রশাসক মূকেশ চন্দ্র বিশ্বাস গেলে তার সহায়তায় তৈরি হয় ইটের দেওয়াল ঘেরা তিনটি কক্ষ। তবে বসার বেঞ্চ নেই। দরকার আরও শ্রেণিকক্ষ। তাই উপায় না পেয়ে এখনো চলছে স্কুল মাঠে ও গাছতলায় পাঠদান। বর্তমানে ১শ ৭৬ জন ছাত্র-ছাত্রী শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।

চারজন শিক্ষকের নিরলস চেষ্টায় প্রথম বছর থেকেই শতভাগ পাশ করেছে। আর গত তিন বছরে ৩টি বৃত্তি পেয়েছে। ২০১৩ সালের ১লা জুলাই সরকারিকরণ করা হয় এই বিদ্যালয়টি। বর্তমান সরকারের ২য় ধাপের এই কর্মসূচিতে এখনো শিক্ষকরা বেতন পাচ্ছেন না। তারপরও চেষ্টার কমতি নেই।

Thakurgaon-charvita-school

ইরফান আলী জাগো নিউজকে জানান, বিদ্যালয়ে যাওয়ার উপযুক্ত সব শিশুকে বিদ্যালয়মুখী করা, প্রাথমিক শিক্ষার মান নিশ্চিত করা এবং ঝরে পড়া রোধে ইরফান আলী গ্রামের লোকজনকে নিয়ে দরিদ্র এই এলাকার স্কুলে মিড ডে মিল চালু করলেন। এজন্য প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৩৩ হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকায় মাসে মাসে এত টাকার যোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। এই অবস্থায় স্থায়ী আয়ের কথা ভাবলেন প্রধান শিক্ষক।

প্রধান শিক্ষক জানালেন, দ্বিতীয় শ্রেণির নিচের শিক্ষার্থীদের সকালে এবং তার উপরের শ্রেণির শিক্ষার্থীদের দুপুরে খাবার দেওয়া হয়। সপ্তাহে তিন দিন দেয়া হয় খিচুড়ি, সঙ্গে একটি করে ডিম। খিচুড়ি তৈরির জন্য দিনে চাল লাগে ২৪ কেজি। স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক দিন বাড়ি থেকে মুঠো চাল নিয়ে আসে। সপ্তাহের বাকি তিন দিন দেওয়া হয় পাউরুটি, সঙ্গে কলা বা ডিম। ডিম অবশ্যই বিদ্যালয়ের খামারের।

ইরফান আলী জাগো নিউজকে বলেন, মিড ডে মিল চালুর আগে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিল অর্ধেকের কম। এখন সব শ্রেণিতেই ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী উপস্থিত থাকে। চলতি বছরের সমাপনী পরীক্ষায় কমপক্ষে ১০ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাবে বলে আশা করছেন তিনি।

চরভিটা গ্রামের আমানের মেয়ে মারিয়া জাগো নিউজকে জানায়, অনেক সময় খেয়ে না-খেয়ে দিন কেটেছে। ক্ষুধা পেটে নিয়ে স্কুলে আসা হতো না। পড়ালেখায় মনোযোগ থাকতো না। এখন স্কুলে খাবার পাই। ভালো লাগে। এবার সমাপনী পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাবে বলে আশা ফাতেমার।

পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী শাহিনুর জাগো নিউজকে জানায়, স্কুলে দুপুরের খাবার না পেলে আমার হয়তো স্কুলেই আসা হতো না। স্কুলের খাবার খেয়ে আমরা এখন নিশ্চিন্তে পড়ালেখা করতে পারছি।

বকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবু তাহের জাগো নিউজকে বলেন, আমার জানা মতে, রংপুর বিভাগে আর কোনো বিদ্যালয়ে মিড ডে মিলের এমন কর্মসূচি চালু নেই। আমরা সমন্বিতভাবে এটাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবু হারেস জাগো নিউজকে জানান, কমিউনিটির (স্থানীয় জনগণ) সক্রিয় অংশ্রহণ নিশ্চিত হলেই যেকোনো কর্মসূচি টিকিয়ে রাখা সম্ভব। চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মিড ডে মিল কর্মসূচি সচল রেখে তারা সেই উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।

তিনি জানান, এ বিদ্যালয়টি জেলার একমাত্র বিদ্যালয়, জন-অংশগ্রহণের মাধ্যমে যেখানে মিড ডে মিল কর্মসূচি সচল আছে।

Thakurgaon-charvita-school

স্থানীয় উদ্যোগে মিড ডে মিল কর্মসূচি সচলের কথা শুনে ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস বিদ্যালয়টি পরিদর্শনে যান। পরিদর্শনের পর অবকাঠামো নির্মাণে চার টন চাল বরাদ্দ করেন। ওই অনুদান দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে একটি টিনশেড ঘর।

মুকেশ চন্দ্র বিশ্বাস জাগো নিউজকে জানান, যে উদ্যোগের সঙ্গে জনগণ সম্পৃক্ত থাকেন, তা কখনোই ব্যর্থ হয় না। চরভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এই উদ্যোগকে উদাহরণ হিসেবে সামনে রেখে জেলার সব উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে মিড ডে মিলের কর্মসূচি চালু করতে পরিকল্পনা নিচ্ছি আমরা।

সম্প্রতি বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করেছেন প্রাথমিক ও গণ শিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান। এসময় তিনি বিদ্যালয়ের মিড ডে মিল কর্মসূচি সচল রাখতে উদ্যোগীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন।

পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী বিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দুই লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দেন। দ্রুত বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণেরও আশ্বাস দেন তিনি।

এমজেড/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।