তবু সহসা সরছে না রাসায়নিক গুদাম

মুসা আহমেদ
মুসা আহমেদ মুসা আহমেদ
প্রকাশিত: ১০:১৩ এএম, ২৫ এপ্রিল ২০২১
২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশনে আগুনে মারা যান ৭১ জন

অডিও শুনুন

পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নিতে এক যুগের বেশি সময় ধরে আলোচনা চলছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব গুদাম স্থানান্তর প্রক্রিয়াই শুরু হয়নি। ফলে আবাসিক ভবনে রাসায়নিক দোকান এবং গুদাম থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে মানুষের প্রাণহানি ঘটেই চলছে।

সবশেষ গত বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) দিবাগত রাত সোয়া ৩টায় পুরান ঢাকার আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশন নামের একটি আবাসিক ভবনের নিচতলায় রাসায়নিক গুদামে আগুন লাগে। এই ঘটনায় ভবনটিতে বসবাসরত এক নারীসহ চারজনের মৃত্যু হয়। এছাড়া ভবনের আরও ২২ জন বাসিন্দা আহত হন। তাদের মধ্যে ২০ জন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এক নবদম্পতিসহ চারজন ভর্তি আছেন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। আর আগুন নেভানোর সময় হঠাৎ বিস্ফোরণে ছিটকে পড়ে আহত হন ফায়ার সার্ভিসেরও চার কর্মী আহত হন। তাদের মধ্যে একজনের হাত ও পা ভেঙে গেছে।

এর আগে পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদামে আগুন থেকে দুটি বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এর মধ্যে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর একটি ভবনে আগুনে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার ৯ বছর পর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ওয়াহেদ ম্যানশন নামের একটি ভবনে আগুনে মারা যান ৭১ জন।

top2

২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ ঝরে যায় ১২৪ জনের

মানা হয়নি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
২০১০ সালে নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের ব্যবসা মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে সরিয়ে নিতে রাসায়নিক শিল্পনগর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু এই প্রকল্প চূড়ান্ত করতে লেগে যায় নয় বছর। এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ডের পর দ্রুত রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরে নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তখন অস্থায়ীভাবে রাজধানীর শ্যামপুরে উজালা ম্যাচ কারখানা ও গাজীপুরের টঙ্গীর কাঠালদিয়া মৌজায় রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এসব রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তর করার কথা ছিল। কিন্তু এখনো স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। এই দুটি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন মাসুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরান ঢাকায় দেড় হাজারেরও বেশি রাসায়নিকের দোকান এবং গুদাম রয়েছে। এর মধ্যে শ্যামপুরে ৬ দশমিক ১৭ একর জমিতে ৫৪টি এবং টঙ্গীতে ৫৪টি রাসায়নিক গুদাম তৈরি করতে ওই দুটি প্রকল্প নিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত অবকাঠামো নির্মাণকাজই শেষ হয়নি।’

তিনি বলেন, আজ শনিবার (২৪ এপ্রিল) এসব রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তর নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। তারা ২০২২ সালের আগ পর্যন্ত এই স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন।’

top2

এসব রাসায়নিক সামগ্রীই অগ্নিকাণ্ডকে ভয়াবহ রূপ দেয়

তবে শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘টঙ্গীতে রাসায়নিক গুদাম তৈরির কাজ প্রায় শেষ। শ্যামপুরের কাজ শেষ করতে আরও দু-তিন মাস লাগবে। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের কাজ বাস্তবায়ন করবে ঢাকা জেলা প্রশাসন। তবে এখন পুরান ঢাকার যেসব বাড়ির নিচে রাসায়নিক গুদাম রয়েছে সেগুলো অপসারণের দায়িত্ব সিটি করপোরশনের।’

তিনি বলেন, ‘মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে রাসায়নিক শিল্পনগরের কাজও এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে সেখানে মাটি ভরাটের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজ দ্রুত সবার মধ্যে শেষ করতে ঠিকাদারকে বলা হয়েছে।’

হাজী মুসা ম্যানশন
২২ এপ্রিল রাতে অগ্নিকাণ্ডকবলিত হাজী মুসা ম্যানশন নামে ছয় তলা ভবনটির অবস্থান আরমানিটোলা মাঠের পাশে। ভবনের প্রতিটি তলায় লম্বালম্বি করে তিনটি ইউনিট। ভবনটির নিচতলার পুরোটা জুড়ে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের দোকান এবং গুদাম।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা এবং স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, হাজী মুসা ম্যানশনের নিচতলাজুড়ে রাসায়নিক দ্রব্যের ১৮টি দোকান ছিল। এর মধ্যে ভেতরের একটি দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। এসব দোকান এবং গুদামে সোডিয়াম পার অক্সাইড অ্যাসিটিক অ্যাসিড, সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড, জেলাটিন নামের রাসায়নিক দ্রব্য ছিল। তবে এই ম্যানশনের মালিক মোস্তাক আহমেদ চিশতীয়া থাকেন ধানমন্ডিতে। আগুন লাগার পর গতকাল শুক্রবার (২৩ এপ্রিল) দিনভর তাকে ঘটনাস্থল দেখা যায়নি। পরে ওই দোকান এবং গুদামগুলো থেকে সাত পিকআপ রাসায়নিক অপসারণ করে ভবনটি সিলগালা করে দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

top2

আরমানিটোলার অগ্নিকাণ্ডকবলিত হাজী মুসা ম্যানশন থেকে সাত পিকআপ রাসায়নিক অপসারণ করা হয়

আরমানিটোলার আরমানিয়ান স্ট্রিটের বাসিন্দা নুরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আরমানিটোলায় এমন আরও অনেক আবাসিক ভবনে অবৈধভাবে রাসায়নিক পদার্থের দোকান এবং গুদাম রয়েছে। কিন্তু সিটি করপোরেশন কিংবা অন্যান্য সরকারি সংস্থার এসবের বিরুদ্ধে কোনো অভিযান করে না। ফলে কিছু দিন পরপরই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। অবিলম্বে পুরান ঢাকা থেকে এসব রাসায়নিক পদার্থের গুদাম সরিয়ে নিতে হবে।’

মুসা ম্যানশনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রধান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-পরিচালক উন্নয়ন নুরুল হাসান আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত চলছে। এই ঘটনায় রাসায়নিক গুদামজাত করার বৈধতা আছে কি-না, আগুন লাগল কিভাবে, এর দায় কার—এসব বিষয় খতিয়ে দেখা হবে। আগামী ১০ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।’

আরমানিটোলা এলাকাটি ডিএসসিসির অঞ্চল-৪ এর আওতাধীন। এ অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হায়দার আলী জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসা করার জন্য কাউকেই ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়নি। আগে যাদের দেয়া হয়েছিল, কয়েক বছর আগ থেকেই তাদের লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে মুসা ম্যানশনে দোকান পরিচালনায় সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক পরিদফতরের ছাড়পত্র ছিল না। এখন নতুন করে কাউকে রাসায়নিক ব্যবসা পরিচালনায় অনুমোদন দেয়া হবে না।’

এমএমএ/এইচএ/এমএস

পুরান ঢাকায় দেড় হাজারেরও বেশি রাসায়নিকের দোকান এবং গুদাম রয়েছে। এর মধ্যে শ্যামপুরে ৬ দশমিক ১৭ একর জমিতে ৫৪টি এবং টঙ্গীতে ৫৪টি রাসায়নিক গুদাম তৈরি করতে ওই দুটি প্রকল্প নিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত অবকাঠামো নির্মাণকাজই শেষ হয়নি

পুরান ঢাকায় রাসায়নিক ব্যবসা করার জন্য কাউকেই ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়নি। আগে যাদের দেয়া হয়েছিল, কয়েক বছর আগ থেকেই তাদের লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে মুসা ম্যানশনে দোকান পরিচালনায় সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিস ও বিস্ফোরক পরিদফতরের ছাড়পত্র ছিল না। এখন নতুন করে কাউকে রাসায়নিক ব্যবসা পরিচালনায় অনুমোদন দেয়া হবে না

টঙ্গীতে রাসায়নিক গুদাম তৈরির কাজ প্রায় শেষ। শ্যামপুরের কাজ শেষ করতে আরও দু-তিন মাস লাগবে। সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম স্থানান্তরের কাজ বাস্তবায়ন করবে ঢাকা জেলা প্রশাসন। তবে এখন পুরান ঢাকার যেসব বাড়ির নিচে রাসায়নিক গুদাম রয়েছে সেগুলো অপসারণের দায়িত্ব সিটি করপোরশনের

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।