গ্রেনাডার পাসপোর্টও আছে পি কে হালদারের
অডিও শুনুন
দুর্নীতি ও অর্থপাচারের মাধ্যমে বিদেশে বাড়ি বানানো বা কেনা—এমন বাংলাদেশি নাগরিক, যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট আছে এবং যারা দেশের বিমানবন্দর দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন—তাদের বিষয়ে তথ্য জানাতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেই নির্দেশনা মোতাবেক সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে জানানো হয়েছে, দেশে ১৩ থেকে ১৪ হাজার দ্বৈত পাসপোর্টধারী রয়েছেন। হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় বিদেশে পলাতক এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারও তাদের একজন। পি কে হালদার বাংলাদেশের পাশাপাশি ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপরাষ্ট্র গ্রেনাডার পাসপোর্টধারী।
গত বছরের ২১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ ওই দ্বৈত নাগরিকত্ব বা পাসপোর্টধারীদের বিষয়ে তথ্য জানানোর আদেশ দিয়েছিলেন। আদেশে বাংলাদেশ পুলিশের ইমিগ্রেশন বিভাগের পুলিশ সুপারকে হলফনামা আকারে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয়ার কথা বলা হয়।
সূত্র জানায়, লিখিত প্রতিবেদন আদালতে জমা না দিলেও ইমিগ্রেশন বিভাগের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে একটি পরিসংখ্যান অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিককে জানানো হয়েছে। ওই তথ্য অনুযায়ী, দেশে দ্বৈত পাসপোর্টধারীর সংখ্যা ১৩ থেকে ১৪ হাজারের মতো। এর মধ্যে পি কে হালদারও রয়েছেন।
এ বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ৩০ মার্চ দিন ধার্য রয়েছে। শুনানির আগেই প্রতিবেদনটি আদালতে জমা দেয়া হবে বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সূত্রে জানা গেছে। ওই দিনই জানা যাবে প্রকৃতপক্ষে কতজন বাংলাদেশি নাগরিক দ্বৈত পাসপোর্টধারী।
হাইকোর্টে অর্থ পাচারকারী ও পাসপোর্টধারীদের তথ্য চাওয়ার সূত্রপাত
গত বছরের ১৮ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) আয়োজিত মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বিদেশে অর্থপাচারের বিষয়ে বলেন, কানাডায় খবর নিয়েছি, প্রাথমিকভাবে কিছু সত্যতা পেয়েছি। মনে করছিলাম রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু দেখা গেল রাজনীতিবিদ চারজন। সরকারি কর্মচারীর সংখ্যা বেশি। এছাড়া কিছু ব্যবসায়ীও আছেন।
এ নিয়ে গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে ২২ নভেম্বর হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত রুল জারি করে আদেশ দেন। দেশের বাইরে অর্থপাচারে জড়িত দুর্বৃত্তদের নাম-ঠিকানা, পাচার করা অর্থে তাদের বিদেশে বাড়ি তৈরিসহ বিস্তারিত তথ্যও জানতে চান আদালত।
ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপরাষ্ট্র গ্রেনাডার ম্যাপ
এরপর ১৭ ডিসেম্বর বিষয়টি আদালতে ওঠে। সেদিন আদালত দেশের বাইরে অর্থপাচারে জড়িত ও পাচার করা অর্থে যারা বিদেশে বাড়ি তৈরি করেছেন, তাদের নাম-ঠিকানা ও তাদের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানতে দিন ধার্য করেন।
পরে ২১ ডিসেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চুয়াল বেঞ্চ দুর্নীতি ও অর্থপাচারের মাধ্যমে বিদেশে বাড়ি বানানো বা কেনা—এমন বাংলাদেশি নাগরিক, যাদের দ্বৈত নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট আছে এবং যারা দেশের বিমানবন্দরগুলো দিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন—তাদের বিষয়ে তথ্য জানাতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন।
ওই দিন শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল এম এম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘কতগুলো আন্তর্জাতিক চুক্তি আছে, যে কারণে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) নাম প্রকাশ্যে দিতে পারে না। তবে তদন্তের জন্য বিএফআইইউ এ সংক্রান্ত তথ্য দুদককে দিয়েছে।’
সেদিন শুনানিতে বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা জানিয়ে দুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘অর্থ পাচারকারীদের নাম, ঠিকানা ও ক্রয় করা বাড়ি বা ফ্ল্যাটের তথ্য সংগ্রহের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিএফআইইউ ও পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে অনুরোধ করা হয়েছে। কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। জবাব পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি আদালতকে জানান, পানামা পেপারসে উঠে আসা দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। প্যারাডাইস পেপারসে উঠে আসা দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশিদের তালিকায় (ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি) মুসা বিন শমসের ও আবদুল আউয়াল মিন্টু উল্লেখযোগ্য।
যেভাবে সামনে এলেন পি কে হালদার
২০১৪ সালের আগে-পরে কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন হয়। ওই চার প্রতিষ্ঠানের একটি বিলুপ্তের পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে না পেরে ধুঁকছে। কৌশলে এসব প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়েছিলেন পি কে হালদার।
দুর্নীতি দমন কমিশন
প্রতিষ্ঠান আয়ত্তে রাখতে নামে-বেনামে তিনি অসংখ্য কোম্পানি খোলেন, শেয়ারবাজার থেকে কেনেন বিপুল পরিমাণ শেয়ার। দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে শত কোটি থেকে হাজার কোটি টাকাও সরিয়ে দেশের বাইরেও খোলেন কোম্পানি। তার বিরুদ্ধে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগের তদন্ত চলছে। গ্রাহকের টাকা না দিয়ে ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে পালিয়ে যান।
যদিও পি কে হালদার যাতে দেশত্যাগ করতে না পারেন, সেজন্য পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চকে (এসবি) আগের দিন ২২ অক্টোবর চিঠি দেয় দুদক। দুদকের ওই চিঠি ডাকযোগে পাঠানো হয়। এর পরদিন ২৩ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৪টায় চিঠি পায় এসবির সদর দফতর। এরপর সদর দফতর থেকে এসবির সব ইমিগ্রেশন ইউনিটকে ওইদিনই বিকেল ৫টা ৪৭ মিনিটে মেইলে এই চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু চিঠি পাওয়ার দুই ঘণ্টা ৯ মিনিট আগেই চম্পট দেন পি কে হালদার। তিনি এখন অবস্থান করছেন বিদেশে।
সূত্র জানায়, প্রতিষ্ঠানগুলো দখলের সময় পি কে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি ছিলেন। এসব কাজে তাকে সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা।
মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন- এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা মামলায় আটকদের স্বীকারোক্তিতে উঠে এসেছে।
পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা ও হাইকোর্টে রুল
প্রায় ২৭৫ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বেনাপোল বন্দর দিয়ে পালিয়ে যান পি কে হালদার
এসব ঘটনাকে কেন্দ্র করে হাইকোর্টের জারি করা স্বপ্রণোদিত রুলের ওপর এক আদালতে শুনানি চলমান। পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডে নামে কোম্পানি খুলে পি কে হালদার যে গ্রাহকদের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের অপর একটি আদালতে চলছে আরেক মামলা।
দেশে প্রায় ১৪ হাজার দ্বৈত পাসপোর্টধারী
হাইকোর্টের ২১ ডিসেম্বরের আদেশে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবির) সুপারকে (ইমিগ্রেশন) ১১ নম্বর বিবাদী হিসেবে পক্ষভুক্ত করা হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থপাচারকারীদের সুনির্দিষ্ট তালিকা দিতে বলা হয় দুদকসহ সরকারের পাঁচটি সংস্থাকে। পরে সংস্থার পক্ষ থেকে সময় চাওয়া হয়।
এরপর নির্ধারিত দিনের শুনানিতে ইমিগ্রেশন পুলিশের বরাত দিয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক আদালতকে বলেন, ইমিগ্রেশন পুলিশ সময় চেয়েছে। কারণ দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে নথি প্রস্তুত করা হচ্ছে। প্রায় এক হাজার পৃষ্ঠার নথি আসার অপেক্ষায়, যেখানে ১৩ থেকে ১৪ হাজার দ্বৈত পাসপোর্টধারী ও নাগরিক রয়েছেন।
সূত্র জানায়, দ্বৈত নাগরিকত্ব খুঁজে বের করতে গিয়ে দেখা গেছে, পি কে হালদারেরও দুটি পাসপোর্ট রয়েছে। একটি বাংলাদেশের, অপরটি গ্রেনাডার।
এ বিষয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাইকোর্ট দ্বৈত পাসপোর্টধারী ও নাগরিকদের বিষয়ে তথ্য জমা দিতে আদেশ দিয়েছিলেন। তারই আলোকে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ থেকে জানানো হয় যে দেশে প্রায় ১৪ হাজার দ্বৈত পাসপোর্টধারী ও নাগরিক রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারও দ্বৈত পাসপোর্টধারী। বাংলাদেশের পাশাপাশি তিনি গ্রেনাডারও পাসপোর্টধারী। এ প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হবে।’
এফএইচ/ইএ/এইচএ/এমএস