যেমন চলছে ঢাবির হলগুলো (পর্ব-২)
কীর্তিমান লেখক আহমদ ছফা বলেছেন, ‘ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলের এই দেশের যা কিছু আশা-ভরসার, তার সবটাই তো ধারণ করে এ (ঢাকা) বিশ্ববিদ্যালয়।’ নিজস্ব ঐতিহ্য ও গৌরবে অনন্য এবং বাংলাদেশের অহংকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এ বিদ্যাপিঠ জন্ম দিয়েছে বহু জ্ঞানীগুণী, পণ্ডিত, শিল্পী-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। যারা নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও।
ইতিহাস ঐতিহ্যে বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্বের যেকোনো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে অনন্য। কারণ পৃথিবীর বুকে এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয় আর খুঁজে পাওয়া যায় না, যেটি তার জাতিকে একটি নিজস্ব ভাষা ও মানচিত্র উপহার দিতে পেরেছে। বাঙালি জাতির সকল আন্দোলন সংগ্রামে এ শিক্ষালয়টির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা ছিলেন নেতৃত্বের অগ্রভাগে। এদের মধ্যে অনেকেই থেকেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির বিভিন্ন হলে। এ সমস্ত হলেরও রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। সময়ের পরিক্রমায় ফিকে যাচ্ছে হলগুলোর ঐতিহ্য। হলগুলোর বর্তমান অবস্থা নিয়ে জাগো নিউজের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে আজ থাকছে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের কথা।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে তিনটি হল নিয়ে যাত্রা শুরু করে তার মধ্যে অন্যতম সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হল। শুরুতে এ হলের নাম মুসলিম হল হলেও প্রায় দশ বছর পর আবদুল্লাহ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবে এ হলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর এই হলটি বর্তমানে বেশ কিছু সমস্যায় জর্জরিত।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থীর হলে অবস্থান, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, রাজনীতি, মাদকের রমরমা বাণিজ্য, রাজনীতির নামে চাঁদাবাজি ও ছিনতাইসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত এ হলটি। তাছাড়া বয়সের ভারে যেন নুয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে প্রাচীন এ হলটির স্থাপনাগুলো। বেশ কিছু জায়গায় দেখা দিয়েছে ফাটল। তাই ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই থাকতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, ‘হল প্রশাসনের অনীহা এবং ছাত্রলীগের দাপটের কারণে সমস্যাগুলোর কোনো ধরনের সুরাহা হয় না।’ অন্যদিকে হল প্রশাসন বলছে ‘কিছু সমস্যা রয়েছে যেগুলো একেবারে সমাধান করা সম্ভব নয়, যতটুকু সম্ভব সমস্যাসমূহ সমাধানে আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’ এতো সমস্যার মধ্যেও হলটির স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন বাঁধনসহ ডিবেটিং ক্লাবের রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি। তাছাড়া ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, টেবিল টেনিস, ক্যারম, দাবাসহ সব ধরনের খেলায় রয়েছে এ হলের শিক্ষার্থীদের ভালো খেলার নজির।
আবাসন সংকট
হল অফিস সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এ হলে আবাসিক শিক্ষার্থী ৪০৫ জন, দ্বৈতাবাসিক ৪০৫ এবং অনাবাসিক এক হাজার ৯০০ জন শিক্ষার্থী। তবে অনাবাসিকের সংখ্যা আরো বেশি বলে দাবি তাদের। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিশ শতকে নির্মিত দ্বিতলবিশিষ্ট মাত্র একটি ভবন। এখানে থাকতে হচ্ছে সবাইকে। আবাসন সংকটের কারণে হলের বিভিন্ন রুমের বারান্দায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন এ হলের আবাসিক ছাত্ররা।
সরেজমিনে দেখা যায়, হলের দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের রুমের বারান্দাসহ বেশিরভাগ রুমের বারান্দায় দিনাতিপাত করছেন হলের ১ম, ২য় এবং ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে ঝড়-বৃষ্টি ও শীতকালে এদের এখানে খুব কষ্ট করে থাকতে হয়। তারপরও ছাত্রলীগের প্রভাবশালী কয়েকজন নেতার আশ্রয়ে হলে বহিরাগতরা থেকে আবাসন সংকট আরো তীব্র করছেন। দ্বিতীয়তলায় মসজিদের পশ্চিম পাশ থেকে কর্নার পর্যন্ত সিঙ্গেল রুমগুলোর বেশির ভাগই বহিরাগত ও সাবেকদের দখলে। হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বহিরাগতদের আমরা বিভিন্ন সময় হল থেকে বের করেছি। কিন্তু তিন চার মাস পর তারা আবারও হলে ওঠে বড় ভাইদের ইশারায়। তাছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েকজন রয়েছেন যাদের আমরা হল থেকে বের করতে গেলে বিভিন্ন জায়গা থেকে কল আসা শুরু হয়। যার কারণে একেবারে বহিরাগতমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমাদের চেষ্টা অব্যহত রয়েছে।’
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে পুরাতন হল হওয়ায় অনেকটা বয়সের বারে যেন নুয়ে পড়ছে এর মূল ভবনটিও। সরেজমিনে দেখা যায়, হলের দ্বিতীয়তলার বিভিন্ন রুমে পলেস্তরা খসে পড়েছে। পলেস্তরা খসে পড়ায় বিভিন্ন স্থানে রড বেরিয়ে আসছে। তবে এগুলো সংস্কারেরও কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেয়নি হল কর্তৃপক্ষ।
মাদকের রমরমা বাণিজ্য
বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক চালান ও মাদক সেবনের নিরাপদ জায়গা সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। এ হলের বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতার হাত ধরেই চলছে এ অবৈধ ব্যবসা। হলের ১৭৭ নম্বর রুমসহ বেশ কয়েকটি রুমে চলে এ সর্বনাশা দ্রব্যসেবন। হল প্রধ্যক্ষ বলেন, ‘হলের পাশেই লালবাগ, পলাশী, আজিমপুর হওয়ায় অপরাধী চক্র খুব সহজে এগুলো সংগ্রহ করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন মাদকবিরোধী বিভিন্ন ধরনের সেমিনার এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। আর বিশ্ববিদ্যালয় যদি এ ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের একেবারেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের কয়েকটি নজির দেখাতে পারতো, তাহলে এটি নিয়ন্ত্রণে আসতে পারতো।’
নিম্নমানের খাবার পরিবেশন
হলের সমস্যাসমূহের মধ্যে আরেকটি অন্যতম সমস্যা হচ্ছে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন। খাবারের মান খারাপ হওয়ায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীকেই বাইরে গিয়ে খেতে দেখা যায়। হল প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাব ও ছাত্রলীগ নেতাদের ফাউ খাওয়ার কারণে এমনটা হচ্ছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। তবে হল প্রাধ্যক্ষ জাগো নিউজকে বলেন, ‘খাবারের মান খারাপ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর ফাউ খাওয়া। ফাউ খাওয়া যতোদিন বন্ধ না হবে ততোদিন খাবারের মানও একেবারেই ভালো করা সম্ভব নয়।’ তবে ফাউ খাওয়া কেন বন্ধ হচ্ছে না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কেন বন্ধ করা সম্ভব নয় তা সবারই জানা। যতোদিন না আমাদের রাজনীতির আইডোলজি চেঞ্জ না হবে ততোদিন এটি বন্ধ করা সম্ভব নয়।’
রাজনীতি
রাজনীতির নামে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে প্রতিনিয়তই চলে নোংরামি। চাঁদাবাজি এ হলের ছাত্রলীগের নেতাদের নিত্যনৈমত্তিক কর্মকাণ্ডে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া প্রভাবশালী ছাত্রলীগ নেতাদের ইশারায় এখানে চলে সবচেয়ে বেশি মাদক বেচা-কেনা। হলের মূল গেইটের সামনে, পলাশী, স্বাধীনতা সংগ্রাম ভাস্কর্য এলাকা এবং ফুলার রোড এদের চাঁদাবাজির প্রধান স্পট। গত ১২ সেপ্টেম্বরও রাত সাড়ে হলের মূল ফটকের সামনের রাস্তায় পলাশীমুখী একটি সিএনজি থামিয়ে ১০ হাজার টাকা চাঁদা নেয় হলের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা। ওই ঘটনার মূলহোতা ছিলেন অবৈধভাবে হলে থাকা রাজু নামের এক ছাত্রলীগ নেতা। তিনি হলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাগরের ঘনিষ্ঠ বড় ভাই। এছাড়াও ওই সময় সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন তানিম, পিকুল, তাহসান এবং আসিফ, সাজু ও ফারুকসহ প্রায় ১৫-২০ জন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। এরা হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী।
বইয়ের সংকট হল লাইব্রেরিতে
প্রতিষ্ঠার ৯৪ বছর পেরিয়ে ৯৫ বছরে পা রাখলেও এখনো সমৃদ্ধ হয়নি হল লাইব্রেরি। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট থেকে বই ক্রয়ের নিয়ম থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। হল লাইব্রেরি সমৃদ্ধ করতে কোনো ধরনের উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে না হল প্রশাসনের। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ পর্যাপ্ত রেফারেন্স বুক পাওয়া যায় না হল লাইব্রেরিতে। তাছাড়া হল লাইব্রেরিয়ান নিয়োগে ছাত্রলীগের কাছে ধর্ণা দিতে হচ্ছে হল প্রশাসনকে। যার কারণে বেশ কিছু দিন বন্ধও ছিল হল লাইব্রেরি।
স্বেচ্ছায় রক্তদান প্রতিষ্ঠান বাঁধন
শত সমস্যার মধ্যেও মানবতার সেবায় কাজ করার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রয়েছে এ হলের শিক্ষার্থীদের। ‘একের রক্ত অন্যের জীবন’ স্লোগানকে সামনে রেখে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হল শাখা বাঁধনের মাধ্যমে এ হলের শিক্ষার্থীরা। নিয়মিত রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে অসুস্থ মানুষদের রক্ত দিয়ে সেবা করছে এখানকার ছাত্ররা। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় বাঁধন অফিস থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বাঁধনের হয়ে সর্বোচ্চ রক্ত দিয়ে রেকর্ড করেছে এ হলটি। সর্বশেষ ২০১৪ সালে হলটি প্রায় এক হাজার ৩০০ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করেছে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ডিবেটিং ক্লাব
বিতর্কেও রয়েছে এ হলের শিক্ষার্থীদের দাপট। টেলিভিশনসহ বিভিন্ন জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতার শ্রেষ্ঠত্বের নজির রয়েছে এ হলের। দুই বছর আগে জাতীয়ভাবে ভালো সুনাম থাকলেও মধ্যখানে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছে ডিবেটিং ক্লাবটি। বর্তমানে আবার ভালো করার লক্ষ্যে কাজ করছে হলটি।
খেলাধুলা
এছাড়াও এ হলের শিক্ষার্থীদের ফুটবল, ক্রিকেট ভলিবল, টেবিল টেনিসসহ খেলাধুলার সকল অঙ্গনে অনেক সুনাম রয়েছে।
শিক্ষাবৃত্তি
দেরিতে হলেও এ বছর থেকে হলের আবাসিক ও দ্বৈতাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হয়েছে হল প্রভোস্ট বৃত্তি। যার জন্য আট লাখ টাকার একটি ফান্ডও তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হল প্রাধ্যক্ষ গোলাম মোহাম্মদ ভূঁইয়া। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ টাকাগুলো আমরা একটা জায়গায় ইনভেস্ট করছি যেখান থেকে বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আসবে। তা থেকে আমরা ১২ জন শিক্ষার্থীকে প্রতি বছর পাঁচ হাজার টাকা করে বৃত্তি দেবো।’
হলের ২৩ নম্বর কক্ষের আবাসিক শিক্ষার্থী আনিম ইরতিজা শোভন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের হলের খাবারের মান সবচেয়ে খারাপ। যার কারণে প্রায় সময়ই আমাদের হলের বাইরে গিয়ে খেতে হয়। তাছাড়া নিয়মিত এটি করতে গেলে ছাত্র হিসেবে আমাদের জন্য একটু কঠিনও হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়াও হলের আবাসন সংকট ব্যাপক। যার দরুণ অনেককে হলের বারান্দায় থাকতে হয়। যেটি বর্ষা ও শীতকালে খুবই কষ্টকর। হল প্রশাসন মনেযোগী হলে এগুলোর সহজ সমাধান সম্ভব।’
এমএইচ/বিএ