বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না আ.লীগের উপ-কমিটির
**পদায়নে মানা হয়নি সিনিয়র-জুনিয়র
**অমান্য হয়েছে গঠনতন্ত্র ও সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশনা
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিতে বিতর্কিত সাহেদ করিমদের যুগ শেষ হলেও অবসান হয়নি বিতর্কের। এবারও উপ-কমিটি গঠনে মানা হয়নি গঠনতন্ত্র এবং সাধারণ সম্পাদকের নির্দেশনা। জায়গা পেয়েছেন বিতর্কিত অনেকেই। পদায়নে মানা হয়নি সিনিয়র-জুনিয়র। তবে বেশ কয়েকটি কমিটি তুলনামূলক ভালো হয়েছে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ৬ ধারায় বিভাগীয় উপ-কমিটি গঠনের বিধান রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রত্যেক সম্পাদকীয় বিভাগের কার্যক্রম অধিকতর গতিশীল ও সমন্বিত করার লক্ষ্যে একটি করে উপ-কমিটি গঠিত হবে। একজন চেয়ারম্যান, একজন সম্পাদক (সংশ্লিষ্ট বিষয়ক, গঠিত কমিটিতে সদস্য সচিব), প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষজ্ঞ সদস্য, সংশ্লিষ্ট সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্যের সমন্বয়ে তা গঠিত হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও পদাধিকার বলে এই কমিটির সদস্য হবেন।
এই উপ-কমিটির সদস্য সংখ্যা কত হবে, তা সুনির্দিষ্ট করে বলা নেই ওই বিধানে। বলা হয়েছে, এটি সভাপতি নির্ধারণ করবেন। গত বছর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সভায় এ উপ-কমিটির সদস্য সংখ্যা ৩৫ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সম্প্রতি গঠিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনোটাতেই মানা হয়নি গঠনতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা। এমনকি সাধারণ সম্পাদক যে ৩৫ সংখ্যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সেটিও কেউ মানেননি। এর দ্বিগুণ, তিনগুণ বা চার-পাঁচগুণ সদস্য নিয়েও কমিটি হয়েছে। এছাড়া উপ-কমিটির পদায়নে মানা হয়নি বয়স বা সাংগঠনিক সিনিয়রিটি-জুনিয়রিটি। প্রাধান্য পেয়েছে চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের মর্জি। যোগ্যতায় আসেন না, কিন্তু নিজ এলাকার লোক, ব্যক্তিগত সহকারী, জীবনে রাজনীতি করেননি—এমন লোককেও রাখা হয়েছে কমিটিতে। কয়েকটিতে আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এসব বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক নেতিবাচক আলোচনা পরিলক্ষিত হয়েছে। সমালোচনা হয়েছে রাজনৈতিক আড্ডায়ও। জানতে চাইলে কোনোটারই সদুত্তর দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট সম্পাদক অর্থাৎ সদস্য সচিবরা। তবে তাদের জমা দেয়া কমিটিতে অনুমোদনের সময় নতুন সদস্য যুক্ত করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৯টি সম্পাদকীয় বিভাগের অধীনে উপ-কমিটি হয়। এর মধ্যে ধর্ম ও দফতর ছাড়া সব বিভাগের উপ-কমিটির অনুমোদন হয়েছে। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মানেনি সদস্যের নির্ধারিতসীমা। এর মধ্যে যুব ও ক্রীড়া উপ-কমিটিতে সদস্য সংখ্যা ৮৫, তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটিতে ১৬০, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপ-কমিটিতে ১৩৫, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপ-কমিটিতে ৫৪, মহিলা বিষয়ক উপ-কমিটিতে ৫০, বন ও পরিবেশ উপ-কমিটিতে ১০০, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক উপ-কমিটিতে ৪০, শ্রম ও জনশক্তি উপ-কমিটিতে ৮৩, শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটিতে ৬০, স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপ-কমিটিতে ৪২, সাংস্কৃতিক বিষয়ক উপ-কমিটিতে ৪৫, কৃষি ও সমবায় বিষয়ক উপ-কমিটিতে ৫৫, আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটিতে ৫৬ এবং আইন বিষয়ক উপ-কমিটিতে সদস্য সংখ্যা ৬১।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া উপ-কমিটিতে সদস্য সচিব হারুনুর রশিদের নিজ জেলা লক্ষ্মীপুর থেকে নয় জনকে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে হারুনের উপজেলা রায়পুরেরই সাতজন। এরা হলেন- রায়পুরের বাসিন্দা হারুনের রশীদ, আক্তার হোসেন, আলমগীর হোসেন, মিরাজ মুক্তাদির, গিয়াস উদ্দিন রুবেল ভাট, আবদুল কাদের, হাওলাদার নূরে আলম জিকু, রামগতির আবদুজ্জাহের সাজু ও লক্ষ্মীপুর সদরের আদনান চৌধুরী। অনুমোদনকৃত কমিটির তালিকায় তারা ১৭, ৩০, ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪১, ৪২ ও ৪৩ নম্বর সদস্য পদে রয়েছেন।
এদিকে তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটি নিয়েও আলোচনার শেষ নেই। কমিটি প্রকাশের সাতদিনের মাথায় বিতর্কের মুখে ওই কমিটির সদস্য অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিনকে বাদ দেয়া হয়েছে। তার পরিবর্তে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনসুরুল হক চৌধুরীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কমিটির বিতর্কের অবসান করতে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সদস্য সচিব ড. সেলিম মাহমুদ বলেছেন, ‘আমরা লক্ষ্য করেছি, অনেকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা দিয়ে আওয়ামী লীগের উপ-কমিটিকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়েছেন।’
তথ্য ও গবেষণা উপ-কমিটিতে একাধিক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, ব্যাংকের চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, চিকিৎসক, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, পত্রিকার প্রকাশক, সম্পাদক, সাবেক আমলা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা এবং ডাকসাইটে সাবেক ছাত্রনেতাদের পদায়ন করা হয়েছে। পাশাপাশি কমিটির সদস্য সচিবের এলাকার উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ের একাধিক নেতাকেও রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
কমিটির সদস্য সংখ্যা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড. সেলিম মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্দিষ্ট করে এটা বলা যাবে না, অনেক সময় পরিবর্তন হতে পারে। নতুন সংযুক্তি আসতে পারে।’
তবে এই কমিটির সদস্য সংখ্যা ১৬০ বলে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য জানিয়েছেন।
উপ-কমিটির এমন বহর দেখে ব্যঙ্গ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম। এতে তিনি লিখেছেন, ‘মাননীয়রা আপনাদের উপ-কমিটি দেয়া শেষ হইলে দয়া করে একটা প্রেস রিলিজ দিয়া জানাইয়েন যে, একটি সফল কর্মযজ্ঞের (চেইন অব কমান্ড ভঙ্গের খেলা) সমাপ্তি হয়েছে। তাইলে আমরাও যারা আমকর্মী আছি অর্থাৎ অভিনন্দন পার্টি। আমরাও আমাদের অভিনন্দন জানানো ক্ষান্ত দিতে পারব।’
তিনি বলেন, ‘নেতার নেতা, তার নেতা, নেতা, নেতার কর্মী, কর্মীর কর্মী, জীবনে প্রথম পদওয়ালাদের দেখতে দেখতে হ-য-ব-র-ল লাগতাছে। খালি একটা উদাহরণ দেই; পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য লেভেলের একজন শিক্ষকও উপ-কমিটির সদস্য, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি/সাধারণ সম্পাদকও সদস্য, আবার আমাদের দুই কমিটির পরের কমিটির নেতাও একই ক্যাটাগরির সদস্য।’
সিদ্দিকী নাজমুল আলম অভিযোগ করেন, ‘কারও কারও বাসার ব্যক্তিগত লোকও উপ-কমিটির সদস্য, আবার কারও কারও নিজের গ্রুপ ভারী করার জন্য ইউনিয়ন লেভেল থেকেও সদস্য করেছেন। এদের আমরা অভিনন্দন জানাতে জানাতে ক্লান্ত! আবারও সবাইকে অভিনন্দন। কারণ দলীয় সিদ্ধান্ত অপছন্দ হইলেও মানতে বাধ্য।’
এদিকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির বহর এতো লম্বা হলেও নেতাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ। তিনি তার ফেসবুকে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘এই যে এতো উপ-কমিটি, এতো সদস্য, এতো ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্য। কিন্তু অনলাইনে জাতির পিতা, আদর্শ, দল ও নেত্রীর পক্ষে ভূমিকায় কেন এতো অনীহা? কেন আপনারা নিজেদের আড্ডা, ফুলেল শ্রদ্ধা ও নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের পক্ষে দুটি লাইনও লিখেন না?’
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া উপ-কমিটির সদস্য সচিব হারুনুর রশিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার এলাকার কয়জন আমি গুনি নাই। বেশি সদস্য রাখার কারণ যারা অনুমোদন দিয়েছেন, তারা ভালো বলতে পারবেন। আমি প্রথমে ৩৫ দিয়েছে ছিলাম, পরে ৮৫ করতে হয়েছে। বেশি লোক কাজ করতে চায়, না রাখলে বিদ্রোহ করে। এজন্য তাদের রেখেছি।’
আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক এবং সংক্রান্ত উপ-কমিটির সদস্য সচিব দেলোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নির্ধারিত সংখ্যক সদস্য দিয়ে কমিটি করা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে আমারটা আমি পারিনি। কারণ, এখানে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, নির্দিষ্ট সংখ্যক বিশেষজ্ঞ, সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদক এবং মূল কাজ করার জন্য সাবেক ছাত্রনেতাদের রাখতে হয়। আমার যে সেক্টর তাতে বিশেষজ্ঞই রাখতে হয়েছে ১৭ জন। স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ সংসদ সদস্য রেখেছি সাতজন। এভাবে সব দিক বিবেচনা করে সদস্য সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি যে উপ-কমিটি গঠন করেছে, তাতে ৬৬ জনকে সহ-সম্পাদক করা হয়। পরে আরও ৪৫০ জনকে একই পদ দেয়া হয়। সেই থেকে বিতর্কের শুরু। ২০১৩ সালের দিকে ওই পদে আরও কিছু পদায়ন করা হয়।
২০১৬ সালের অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের পর সহ-সম্পাদক পদায়ন নিয়ে বঞ্চিতদের বিক্ষোভও হয়। নানা বিতর্কের মুখে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দলের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে বিলুপ্ত করা হয় সহ-সম্পাদক পদ। তখন উপ-কমিটির চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের বাইরে সবাই উপ-কমিটির সদস্য হবেন বলে নির্দেশনা দেয়া হয়। যদিও করোনা চিকিৎসায় জালিয়াতির কারণে গ্রেফতার সাহেদ করিম ওরফে মোহাম্মদ সাহেদসহ বেশ কয়েকজন সদস্য নিয়েও গতবার বিতর্ক হয়। এবার বিতর্কের অবসান করতে সদস্য সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। সময় নিয়ে যাচাই-বাছাই করে দেয়া হয় কমিটি। কিন্তু তাতেও মিলল না ফল।
এসইউজে/এইচএ/জিকেএস