আঁধারে আলোর দিশা
জলসা হরিজন (১৫)। একটা সময় এই নামটি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হরিজন পল্লীর অবহেলিত এক কন্যা শিশুর নাম। কিন্তু আজ সেই জলসাই হরিজন পল্লীর আলোর দিশা। যুগ যুগ ধরে শিক্ষার আলো বঞ্চিত হরিজন পল্লীর প্রতিটি ঘরে আশার প্রদীপ জ্বেলেছে সে। জলসাকে দেখে উৎসাহিত হয়ে এখন হরিজন পল্লীর বেশ কয়েকজন শিশু ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন নামি-দামি স্কুলে লেখাপড়া করছে।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে জলসা জানায়, পরিবারে তাদের তিন বোন দুই ভাই রয়েছে। মা আসমানি হরিজন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের গভ. মডেল গার্লস হাই স্কুলে ঝাড়ুদারের কাজ করেন। আর বাবা সুনিল হরিজন করেন সুইপারের কাজ। লেখাপড়ার প্রতি ছোটবেলা থেকেই প্রবল আগ্রহ ছিল জলসার। সেই প্রবল আগ্রহের কারণেই মা আসমানি হরিজন তাকে ভর্তি করে দেন শহরের গভ. মডেল গার্লস হাই স্কুলে। বর্তমানে জলসা ৮ম শ্রেণিতে লেখাপড়া করছে। চলতি বছরের জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করেছে সে।
জলসা আরও জানায়, এক সময় বৈষম্যের শিকার হওয়ার ভয়ে হরিজন শিশু হওয়ার কথাটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ছাড়া অন্য কোনো সহপাঠীকে জানায়নি সে। তবে ধীরে ধীরে বেশ কয়েকজন সহপাঠীর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। এখন বিদ্যালয়ের অনেকই জানে জলসা হরিজন সম্প্রদায়ের। বিষয়টি জানার পরও সবাই তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণই করে বলে জানিয়েছে জলসা।
জলসার মা আসমানি হরিজন জাগো নিউজকে জানান, গভ. মডেল গার্লস হাই স্কুলে চাকরির সুবাদে সেখানকার শিক্ষক-শিক্ষিকারা জলসাকে স্কুলে ভর্তি করে দেয়ার জন্য তাকে উৎসাহিত করেছেন। এরপর তিনি জলসাকে স্কুল ভর্তি করে দেন। নিজের মেয়েকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য নানা প্রতিবন্ধকতার মাঝেও অনেক কষ্ট করে তিনি মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে যাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা কার্যালয়ের পেছনে অবস্থিত হরিজন পল্লীতে বর্তমানে ৪০/৫০টি পরিবারের বসবাস। প্রতিটি পরিবারেই একাধিক শিশু রয়েছে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশুই সামাজিক বৈষম্যের শিকার হওয়ার ভয়ে স্কুলে যেতে চায় না। প্রথমে দুই-চারজন স্কুলে যেতে চাইলেও কয়েকদিন যাওয়ার পরই নানা কারণে পরিবারে পক্ষ থেকেই তাদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়া হয়। তবে জলসাকে দেখে এখন অনেক পরিবারই তাদের সন্তানকে শিক্ষিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য স্কুলে পাঠানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।
বর্তমানে জলসাসহ হরিজন পল্লীর ৫ জন শিশু লেখাপড়া শুরু করেছে। এই ৫ জনের মধ্যে টিটু হরিজন (১২) শহরের গ্রিন ভ্যালী স্কুলে পড়ছে ৪র্থ শ্রেণিতে, সজিব হরিজন (১১) তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে আদর্শ কিন্ডার গার্ডেনে, কৃষ্ণা হরিজন (১৩) ৪র্থ শ্রেণিতে ও বিশাল হরিজন (১৫) ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে রামকানাই হাই একাডেমিতে। এছাড়া অবহেলিত এই হরিজন পল্লীর অনেক শিশুই লেখাপড়ায় উৎসাহিত হচ্ছে।
টিটু ও সজিব হরিজন জানায়, স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম দিকে কিছুটা বৈষম্যের শিকার হলেও বর্তমানে স্কুলের সব শিক্ষার্থীই তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে।
জলসা আরও জানায়, বাংলাদেশি হওয়া সত্ত্বেও যুগ যুগ ধরে তাদের সম্প্রদায়ের লোকজন সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে রাষ্ট্রীয় নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। তবে শুধু দেশের স্বার্থে হরিজন পল্লীর প্রতিটি শিশুকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ গ্রহণে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছে জলসা।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সরকার সব শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার জন্য বিনামূলে বই বিতরণ ও উপবৃত্তি প্রদানসহ নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। হরিজন পল্লীর শিশুরাও এই কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে। তাদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করার জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, হরিজন পল্লীর কোনো শিশু স্কুলে গিয়ে যেন বৈষম্যের শিকার না হয় সেজন্য প্রতিটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এসএস/এমএস