ঈদের পর সরকার পতনের একদফা আন্দোলনে নামছে বিএনপি
সরকার পতনের একদফা কর্মসূচি নিয়ে শিগগিরই মাঠে নামার জোরালো প্রস্তুতি নিচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। এজন্য মাঠপর্যায়ে দল গোছানোর কাজ চলছে। রাজপথে নেমে টিকে থাকার উপযোগী করে পুরো দলকে আরও সুসংগঠিত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সরকারবিরোধী বৃহৎ প্লাটফরম তৈরির পরিকল্পনাও নিয়েছে দলটি। রাজধানী ঢাকাকে আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ধরে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার রূপরেখা তৈরি করা হচ্ছে। এবারের আন্দোলনের রূপরেখায়ও দিনক্ষণ সেই ‘ঈদের পর’।
জানা গেছে, ২০১৪ সালে ‘দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠেকাও আন্দোলন’ এবং পরের বছর সরকারবিরোধী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর রাজপথের জোরালো আন্দোলন থেকে কার্যত সরে আসে দলটি। পরে বিভিন্ন ইস্যুতে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিলেও তাতে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, দলীয় নেতাকর্মীদের অংশগ্রহণের চিত্রও ‘হতাশাজনক’ ছিল।
এমনকি ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে নেয়া কিংবা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও দলটি রাজপথে কার্যত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।
সম্প্রতি জিয়ার খেতাব বাতিলের চেষ্টার প্রতিবাদ
দলের বড় একটি অংশ মনে করে, নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচির আন্দোলন দিয়ে সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। দাবি আদায়ের জন্য রাজপথে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এ ব্যাপারে দলীয় হাইকমান্ডও সম্মত হয়েছে। এ কারণে দলকে দুর্বার আন্দোলনমুখী করতে তৃণমূল বিএনপিকে শক্তিশালী করা হচ্ছে। এজন্য নানাবিধ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মেয়রপ্রার্থীদের নেতৃত্বে ‘নিরপেক্ষ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের’ অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ‘নগর সমাবেশ’ কর্মসূচি পালন করে বিএনপি। এই সমাবেশ থেকে আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে দলের তৃণমূল থেকে শুরু করে হাইকমান্ড পর্যন্ত সবার প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।
আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে নির্দেশনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট রফিক শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আন্দোলন তো শুরু হয়ে গেছে। আন্দোলনে দানা বেঁধেছে। একদফা সরকার পতনের আন্দোলন ছাড়া বিকল্প নেই।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সাংগঠনিক পুনর্গঠন চলছে, দলীয় কর্মসূচিও রয়েছে। সরকারের দুঃশাসনে মানুষও অতিষ্ঠ। ফলে আন্দোলনের জন্য জনমত তৈরি হয়েছে। সামনে রমজান মাস। এখন এটা রোজার আগে না পরে চূড়ান্ত রূপ নেবে, সেটা এই মুহূর্তে বলতে পারছি না। তবে জনসম্পৃক্তাতা গড়ে তুলেই অধিকার আদায় করা হবে।’
সূত্রমতে, আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু রাজধানী ঢাকা ধরে সাজানো হচ্ছে বিভিন্ন পরিকল্পনা। পাশাপাশি দলকে গতিশীল করতে মিডিয়া সেল, প্রযুক্তি ও গবেষণা সেল, প্রচার সেল, আইনি সহায়তা সেলসহ বিভিন্ন বিষয়ে সেল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। যে কোনো সময় যে কোনো প্রয়োজনে রাজপথে নামার জন্য তৃণমূল বিএনপির একটি বড় অংশকে প্রস্তুত রাখতে প্রতিনিয়ত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন দলের হাইকমান্ড। ঝুঁকি যত বড়ই হোক, দল তার পাশে থাকবে- এমন মনোভাব গড়ে তোলা হচ্ছে প্রতিটি নেতাকর্মীর মধ্যে।
বিএনপিকর্মীদের পুলিশের লাঠিপেটা
দলের অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে দলের সাংগঠনিক ভিত্তিকে মজবুত করার জন্য ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে প্রাধান্য দিয়ে সারাদেশের ওয়ার্ড-ইউনিয়ন থেকে এসব সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
ইতোমধ্যে এসব অঙ্গ সংগঠনের বেশিরভাগ ইউনিট কমিটি গঠন কার্যক্রম শেষ হয়েছে। সারাদেশের ৮০টি সাংগঠনিক ইউনিট কমিটির মধ্যে ৩০টি জেলা কমিটি ভেঙে নতুন আহ্বায়ক কমিটি এবং আটটি পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এসব কমিটির মধ্যেও বেশিরভাগ আবার মেয়দোত্তীর্ণের তালিকায় রয়েছে। সবকিছু ঠিক করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে রাজপথে দৃশ্যমান কর্মসূচিতে ফেরার জন্য দলের নেতাকর্মীদের প্রতি এক ধরনের বার্তা রয়েছে। এসবের পাশাপাশি সরকারবিরোধী বৃহৎ প্লাটফর্ম তৈরির কাজও অনেকটা এগিয়ে আনা হয়েছে। এই প্লাটফর্মে ডান-বাম সব মতাদর্শকে এক কাতারে, এক মঞ্চে নিয়ে আসা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন বলেন, ‘দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। ফলে দেশে আরও হাজারটা নির্বাচন করলেও সুষ্ঠু হবে না। এজন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে আন্দোলনের বিকল্প নেই।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এখন দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছি। পুনর্গঠন প্রক্রিয়া মোটামুটি একটি পর্যায়ে এসেছে। এর মধ্যে আমরা অন্য দলগুলোর সঙ্গে কথাও বলতে শুরু করেছি। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে আমরা ভবিষ্যতে কী করব। বিএনপি একটি উদারপন্থী রাজনৈতিক দল। আমরা অবশ্যই মনে করি, নির্বাচনই হচ্ছে ক্ষমতা পরিবর্তনের একমাত্র পথ। আন্দোলন ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশের ক্ষমতা পরিবর্তনের সম্ভাবনা খুব কম। সে জন্যই আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করছি।’
পুলিশের লাঠিচার্জে আহত বিএনপিকর্মী
তিনি বলেন, ‘সরকার সবক্ষেত্রে ব্যর্থ। দুর্নীতি, অনিয়ম, গুম-খুন সরকারের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ হয়ে উঠেছে। এসব অপকর্মের বিরুদ্ধে যারাই প্রতিবাদ করছে তাদের নানাভাবে হয়রানি ও নির্যাতন করা হচ্ছে। জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করে তারা একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করছে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এভাবে একটি দেশ চলতে পারে না। গণতান্ত্রিক দল হিসেবে আমরাও নীরব থাকতে পারি না। তাই জনগণের অধিকার আদায়ে আমরা তৎপর আছি এবং থাকবো।’
মির্জা ফখরুল আরও বলেন, ‘দলকে সংগঠিত করে এ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এর অংশ হিসেবে আমরা বিভাগীয় শহরে সমাবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ভবিষ্যতে আমাদের এ আন্দোলন আরও বেগবান হবে। আশা করি, আমাদের দাবির সঙ্গে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ একাত্মতা ঘোষণা করবেন।’
কেএইচ/এএএইচ/এসএইচএস/এমকেএইচ