কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে উপকৃত হচ্ছেন রাঙামাটির মানুষ

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৭:৩২ এএম, ১৬ নভেম্বর ২০১৫

সাপছড়ি কমিউনিটি ক্লিনিকটি স্থাপিত হয়েছে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলার ওয়াগ্গা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি পাহাড়ি এলাকায়। তবে এলাকাটি দুর্গম হলেও ক্লিনিকটি মূল সড়কের পাশে নির্মিত হওয়ায় সেখান থেকে স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে মানুষজন উপকৃত হচ্ছেন।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ওয়াগ্গা ইউনিয়নের সাপছড়ি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিচ্ছেন স্থানীয় লোকজন। সেবা নিতে যাওয়া রোগীদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ক্লিনিকটি চালু হওয়ায় এলাকার লোকজন যথেষ্ট উপকৃত হচ্ছেন। ক্লিনিকটি প্রতিদিন সকাল-বিকাল খোলা থাকে। বিনামূল্যে ওষুধ মেলে। তাই খুঁটিনাটি চিকিৎসার জন্য দূরে কোথাও যাওয়া লাগে না। ক্লিনিকে একজন ডাক্তার থাকলে পূর্ণ চিকিৎসাসহ সেবা পুরোপুরি পাওয়া যেত। এসব ক্লিনিকের সেবার মান পুরোপুরি নিশ্চিত দরকার বলে দাবি করেন স্থানীয়রা।

সেবা নিতে যাওয়া স্থানীয় বাসিন্দা উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা (৩৫) বলেন, তার কয়েক দিন ধরে গলা ব্যথা হচ্ছিল। এতে চিকিৎসা নিতে ক্লিনিকে এসেছেন তিনি। রোগের লক্ষণ অনুযায়ী বিনামূল্যে ওষুধ দিয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা।

সেবার জন্য যাওয়া আরেক রোগী বিনতা তঞ্চঙ্গ্যা (৩০) বলেন, ক্লিনিকটি চালু হওয়ার পর থেকেই ছোটখাটো অসুখে আর দূরে না গেলেও চলে। ক্লিনিকে গিয়ে ওষুধ পাওয়া যায়। আগে সামান্য অসুখ হলেও চন্দ্রঘোনা, কাপ্তাই অথবা জেলা সদর বা চট্টগ্রাম গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো।

আরেক রোগী রবি চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা (৫৫) বলেন, তিনি শারীরিভাবে খুব দুর্বল। সেজন্য ক্লিনিকে এসেছেন। তাকে ক্লিনিক থেকে ভিটামিন জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়েছে বিনামূল্যে।

মো. মুসলিম মিয়া (৫৮)। কয়েক দিন ধরে ব্যথা ও চুলকানির সমস্যায় ভুগছেন। দূরে কোথাও যেতে পারছেন না চিকিৎসার জন্য। প্রাথমিকভাবে ক্লিনিকে এসেছেন চিকিৎসা নিতে। তাকেও ব্যথা নিরাময় ও এলার্জির ওষুধ দেয়া হয়েছে।

এভাবে প্রতিদিন সাপছড়ি কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা নিতে যান স্থানীয় লোকজন। ক্লিনিকে দায়িত্বরত হেলথকেয়ার প্রোভাইডার লিলি তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, শনিবার সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মোট ১৮ জন রোগী ক্লিনিকে এসে সেবা নিয়েছেন।

সেবার মান কেমন ও কি কি সেবা দেয়া হয় জানতে চাইলে লিলি তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, আমরা তিনজন সার্বক্ষণিক সেবায় নিয়োজিত থাকি। এছাড়াও জেলা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে স্বাস্থ্য সহকারী দীপ্তি রাণী তঞ্চঙ্গ্যা প্রতি বুধবার এবং জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে স্বাস্থ্য সহকারী বিজয় চাকমা প্রতি মঙ্গল-বুধবার ও মো. মহসিন প্রতি শনি-রোববার ওই ক্লিনিকে গিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা  দেন।

লিলি তঞ্চঙ্গ্যা জানান, সাপছড়ি স্বাস্থ্য ক্লিনিকটি চালু হয় ২০১২ সালে। ক্লিনিকে তাদের দায়িত্ব হল প্রাথমিক চিকিৎসা, স্বাস্থ্য, মা ও শিশুর স্বাস্থ্য, গর্ভবতী, প্রসূতি ও প্রসব এবং পরিবার পরিকল্পনা সেবা দেয়া। এছাড়া রোগীদের লক্ষণ অনুযায়ী ম্যালেরিয়া ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়। প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্যারাসিটামল, মেট্রোনিডাজল, খাবার স্যালাইন, অ্যান্টাসিড, পেনিসিলিন ও ভিটামিন জাতীয়সহ ৩০ ধরনের ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হয়।

সমস্যার কথা জানতে চাইলে লিলি তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, তারা নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু ঠিকমতো বেতন-ভাতা পান না। এছাড়া প্রকল্পের অধীন তাদের চাকরি আজও স্থায়ী করা হয়নি। প্রকল্পের মেয়াদ আগামী ২০১৬ সাল নাগাদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ক্লিনিকসহ তাদের চাকরি রয়ে গেছে অনিশ্চয়তায়। ফলে ক্লিনিক চালু আছে ঠিক কিন্তু সেবা আজও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি।

Rangamati

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জেলার দশ উপজেলায় বিভিন্ন ইউনিয়নে সরকার কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করলেও সেগুলোর সেবা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেনি। অবকাঠামোগত ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রয়োজনীয় লোকবল নেই। প্রতিটি ক্লিনিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে কেবল একজন করে হেলথ প্রোভাইডার। কেউ কেউ নিয়মিত কর্মস্থলে উপস্থিত থাকেন না বলেও স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। ফলে জনগোষ্ঠী ক্লিনিকগুলোর নুন্যতম সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

এদিকে এলাকার লোকজন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর অবকাঠামোগত ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু জনগণ আজও কাঙ্খিত সুফল পাচ্ছেন না। তবে কিছুটা হলেও উপকারে এসেছে ক্লিনিকগুলো চালু করে। পুরোপুরি সেবা নিশ্চিত করতে হলে প্রতিটি ক্লিনিকে চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর্মী দরকার।

রাঙামাটি সদরের বন্দুকভাঙা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরুণ কান্তি চাকমা বলেন, তার ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক ভবন চালু হলেও আজও কাঙ্খিত সেবা নিশ্চিত হয়নি।

নানিয়ারচর উপজেলার ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অমর জীবন চাকমা বলেন, সেবা নিশ্চিত করতে হলে চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় লোকবল দরকার। তার ইউনিয়নে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হলেও নানা সমস্যার কারণে কাঙ্খিত সেবা পাচ্ছেন না জনগণ।

জানা যায়, ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে জেলায় ৪২টি কমিউনিটি ক্লিনিকের অবকাঠামো নির্মাণ করা হলেও বিএনপির নেতৃত্বাধীন চার দলীয় জোট সরকার সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের গত মেয়াদে পুনরায় চালু হয় কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। বর্তমানে ৮১টি ক্লিনিক চালু আছে জেলায়।

জেলা সিভিল সার্জন অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. শাহজাহান মজুমদার বলেন, জেলার দশটি উপজেলায় মোট ১৪৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের প্রস্তাব রয়েছে। এ পর্যন্ত ৮১টি চালু হয়েছে। বাকি ৬৬টি ক্লিনিক জমি না পাওয়ায় এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রস্তাবিত ১৪৭ ক্লিনিকের সবগুলোতে একজন করে হেলথ প্রোভাইডার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যে সকল ক্লিনিক চালু হতে পারেনি সেগুলোর হেলথ প্রোভাইডাররা পাশের ক্লিনিকের সার্ভিসে রয়েছেন।   

তিনি জানান, ক্লিনিকগুলোর মধ্যে রাঙামাটি সদরে এ পর্যন্ত চালু হয়েছে ৮টি, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ১০টির, কাউখালীতে চালু হয়েছে ৮টি, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ৪টির, নানিয়ারচরে চালু হয়েছে ৭টি, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ৫টির, কাপ্তাইয়ে চালু হয়েছে ৬টি, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ৯টির, বিলাইছড়িতে চালু হয়েছে ৩টি, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ৬টির, রাজস্থলীতে চালু হয়েছে ৩টি, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ৬টির, বাঘাইছড়িতে চালু হয়েছে ১২, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ৭টির, বরকলে চালু হয়েছে ১৩টি, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ২টির, জুরাছড়িতে ৩টি, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ৯টির এবং লংগদু উপজেলায় চালু হয়েছে ১৮টি, জমি পাওয়া যাচ্ছে না ৩টির। এছাড়া ২৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক জরাজীর্ণ অবস্থায় এবং আগের নির্মিত ৪৫টি ক্লিনিকের মেরামত বা পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন বলে জানান শাহজাহান মজুমদার।

তিনি বলেন, চালু হওয়া ৮১টি ক্লিনিকে নিয়মিত সেবা কার্যক্রম চলছে। ক্লিনিকে নিয়োগপ্রাপ্ত এবং জেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের স্বাস্থ্যকর্মীরা মিলে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ক্লিনিকগুলো যাতে বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য সরকার আইন-বিধি প্রণয়নের উদ্যোগ নিচ্ছে বলে জানা গেছে।

এসএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।