ওষুধ ও জনবল সঙ্কটে চলছে কিশোরগঞ্জের কমিউনিটি ক্লিনিক


প্রকাশিত: ১২:৫৫ পিএম, ০৮ নভেম্বর ২০১৫

হাওরবেষ্টিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম জেলা কিশোরগঞ্জ। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় এখানকার অনেক এলাকার মানুষের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। পল্লীর হতদরিদ্র মানুষের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেয়ার জন্য দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০১৩ সালে সারা দেশে চালু করা হয় কমিউনিটি ক্লিনিক।

কিন্তু পর্যাপ্ত লোকবল না থাকা, অবকাঠামোগত সুবিধার অভাব আর প্রয়োজনীয় ওষুধ ও অন্যান্য উপকরণ না থাকায় স্বাস্থ্যসেবায় কাঙ্খিত ফল মিলছে না কিশোরগঞ্জের ক্লিনিকগুলোতে। আর প্রয়োজনীয় তদারকি না থাকায় অনেক কমিউনিটি ক্লিনিকের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের সময় মতো অফিসে পাওয়া যায় না। অনেকে অফিসে আসেন দেরিতে, আবার ক্লিনিক ছাড়েন নির্ধারিত সময়ের আগে। তবে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অনেক ক্লিনিকের সিএইচসিপিরা কাজ করছেন আন্তরিকতার সঙ্গে।

কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকে সরেজমিনে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মী, রোগী ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। এ সকল কারণে জেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে রোগীরা চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রতিফলিত হচ্ছে না সরকারের আসল উদ্দেশ্য।

তবে সবচেয়ে বেশি বিড়ম্বনায় পড়ছেন রোগীরা। কমিউিনিটি ক্লিনিকে এসে সাধারণ জ্বর-সর্দির ওষুধও মিলে না প্রয়োজনের সময়। সিএইচসিপিরা জানিয়েছেন, মাসে যে পরিমাণ ওষুধ দেয়া হয় তা দিয়ে এক সপ্তাহই চলে না। বাকি সময় খালি হাতেই ফিরতে হয় রোগীদের।

Clinic-kishoreganj

কিশোরগঞ্জ জেলা সদর ও করিমগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে স্বাস্থ্য সেবার নানা অসঙ্গতি ও সমস্যা চোখে পড়ে। করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়ি ঈশা খাঁ কমিউনিটি ক্লিনিকে সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিতে এসেছেন মুসলিমপাড়া গ্রামের গৃহবধূ ইয়াসমিন বেগম। রোদে পুড়ে ক্লিনিকে আসার পর সিএইচসিপি জানালেন, প্যারাসিটামল শেষ হয়ে গেছে। বিফল মনে ফিরে যাচ্ছেন তিনি। এ সময় ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাধারণ প্যরাসিটামল, হিস্টাসিনও যদি না পাওয়া যায় তাহলে হাসপাতালে (ক্লিনিক) আইসা লাভ কি?’ তিনি বলেন, আমি ডায়াবেটিকের রোগী। কিন্তু এখানে ডায়াবেটিকের কোনো চিকিৎসা নেই।

ঈশা খাঁ কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি সানজিদা সামান্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘মাসে যে পরিমাণ ওষুধ দেয়া হয় তা দিয়ে অর্ধেক সময়ও চলে না। দেড় মাসে মাত্র এক হাজার প্যরাসিটামল দেয়া হয়। তা দিয়ে এক সপ্তাহও চলে না। তিনি বলেন, প্রতি দেড় মাসের জন্য ২৯টি ওষুধ সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এগুলোর মধ্যে ভালো মানের এন্টিবায়োটিক নেই।

ওই ক্লিনেকের ফ্যামিলি ওয়েল ফেয়ার অ্যাসিসটেন্ট (এফডব্লিউএ) কিংবা স্বাস্থ্য সরকারীকে পাওয়া যায়নি। সানজিদা সামান্তা জানান, ‘আজকে স্বাস্থ্য সহকারী সাইফুল ইসলাম ক্লিনিকে থাকার কথা। কিন্তু তিনি আসেননি। উপজেলা সদরে ইপিআই প্রোগ্রাম থাকায় তিনি আসতে পারেননি।

সাঁতারপুর কমিউনিটি ক্লিনিকে গিয়ে চোখে পড়লো অনেক মায়েরা তাদের শিশুদের নিয়ে ক্লিনিকে এসেছেন। স্বাস্থ্য সহকারী মোছা. সামিয়া সুলতানা একটি শিশুকে টিকা দিচ্ছেন। এ ক্লিনিকের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিএইচসিপি জানালেন, ‘আজ ক্লিনিকের মাসিক ইপিআই (সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি)।

৬০ বছরের বৃদ্ধা মহিলা খাতুনের হাত ভেঙে গেছে কিছুদিন আগে। হাতের ব্যাথার চিকিৎসার জন্য তিনি এসেছেন ক্লিনিকে। কিন্তু সিএইচসিপি জানালেন, ‘ব্যাথার কোনো ওষুধ নেই।’

সাতারপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপি মো. আল-আমিন জানান, প্রতি মাসে ক্লিনিকে এক হাজার থেকে ১২’শ রোগী আসে। দেড় মাসের জন্য যে পরিমাণ ওষুধ দেয়া হয় তা দিয়ে এক সপ্তাহও চলে না। সাধারণ এমক্সিসিলিন ক্যাপসুল পায় মাত্র ৫’শ। এ ছাড়া এমক্সিসিলিন সিরাফ দেয়া হয় ১২ পিচ, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স ট্যাবলেট দেড় হাজার, এন্টাসিড আড়াই হাজারসহ ২৯ প্রকারের ওষুধ দেয়া হয়।

এখানে বাচ্চাদের টিকা দিতে আসা অনিকা ও সুফিয়া বলেন, তারা ছোটখাট অসুখে ক্লিনিকে আসেন। কিন্তু পর্যাপ্ত ওষুধ পাওয়া যায় না বলে জানান।

Clinic-kishoreganj

কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মারিয়া ইউনিয়নের বুরুঙ্গারচর কমিউনিটি ক্লিনিকে গেলে ওই ক্লিনিকের সিএইচসিপি শিউলী রানী জানান, প্রতিদিন তার ক্লিনিকে ৪০/৪৫ জন রোগী আসে। আজ চিকিৎসা নিয়েছেন ১০ জন। তিনি জানান, এ ক্লিনিকে এ পর্যন্ত ১৩ জন মায়ের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। এ ক্লিনিকের সেবায় এলাকার মানুষ সন্তুষ্ট। ক্লিনিকটি ২০১৩ সালে ঢাকা বিভাগে প্রথম হয়েছে।

কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে জ্বর, আমাশায়, সর্দি, কাশি, গ্যাস্ট্রিকসহ সাধারণ রোগীরাই বেশি আসেন। তারা প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে এসব ক্লিনিকে আসেন। প্রতিটি ক্লিনিক সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত খোলা থাকার কথা। তবে অনেক ক্লিনিকের সিএইচসিপিরা সময় মতো ক্লিনিকে আসেননা।

সরেজমিনে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মারিয়া ইউনিয়নের প্যারাভাঙ্গা কমিউনিটি ক্লিনিক, রশিদাবাদ ইউনিয়নের শ্রীমন্তপুর কমিউনিটি ক্লিনিক ও একই ইউনিয়নের বেরুয়াইল কমিউনিটি ক্লিনিক তালাবদ্ধ অবস্থায় পাওয়া গেছে।

কেরুয়াইল গ্রামের ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর জানান, ক্লিনিকের কর্মকর্তা দেরিতে আসেন আবার আগেই চলে যান। জেলার হাওরে অবস্থিত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোর অবস্থা আরও খারাপ।

কিশোরগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জানা গেছে, জেলার ১৩টি উপজেলায় মোট ২৯৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ সদরে ২৮টি, তাড়াইলে ২১টি, ইটনায় ২১টি, হোসেনপুরে ২০টি, করিমগঞ্জে ৩৩টি, অষ্টগ্রামে ১৯টি, নিকলীতে ১৬টি, ভৈরবে ১৯টি, বাজিতপুরে ২৩টি, কুলিয়ারচরে ১৬টি ও কটিয়াদীতে ৪১টি ক্লিনিক আছে। এসব ক্লিনিকে একজন করে সিএইচসিপি পদে লোক নিয়োগ রয়েছে।

জেলা সিভিল সার্জন  ডা. মোখলেছুর রহমান জাগো নিউজকে জানান, জেলার কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সাধ্যমতো চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। অনেকগুলো ক্লিনিক জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে উল্লেখ করে সিভিল সার্জন বলেন, এগুলো জরুরি ভিত্তিতে মেরামতের জন্য স্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

তবে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ওষুধের কোনো অভাব নেই দাবি করে তিনি বলেন, চাহিদা মতো ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। আর প্রতিনিয়ত ক্লিনিকগুলো মনিটরিং করা হয়ে থাকে। তিনি নিজে, উপজেলা স্বাস্থ্য প্রশাসকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা নিয়মিত ক্লিনিকগুলো মনিটরিং করেন বলেও জানান তিনি।

সিভিল সার্জন বলেন, কোনো সিএইচসিপি এর বিরুদ্ধে ক্লিনিকে অনুপস্থিত থাকাসহ অন্য কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

এসএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।