কার অনুমোদনে বিদেশ যেতে পারবেন খালেদা জিয়া?
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাদণ্ড স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ শর্তসাপেক্ষে আরও ছয় মাস বাড়ানোর পর এখন আলোচনা চলছে, খালেদা জিয়া কি উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে পারবেন? যদি যেতে চান, তবে কি আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে? নাকি সরকারের কাছেই ধরনা দিতে হবে?
এ বিষয়ে কিছু আইনবিদ বলছেন, খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে সরকার। এক্ষেত্রে তাকে বিদেশে না যাওয়ার শর্ত দেয়া হয়েছে। যেহেতু সরকার তাকে মুক্তি দিয়েছে, বিদেশে যাওয়ার অনুমতিও সরকার দিতে পারে। এ নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন নেই।
আবার যে মামলায় খালেদা জিয়া সাজা ভোগ করছিলেন, সে মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবীরা বলছেন, খালেদা জিয়া যেহেতু দণ্ডিত, সেহেতু বিদেশে যেতে হলে তার আদালতের অনুমোদন লাগবে।
দুর্নীতির মামলায় সাজার রায়ের পর খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হন। চলতি বছরের ২৫ মার্চ তিনি সরকারের নির্বাহী আদেশে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পান। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মানবিক দিক বিবেচনায় সরকার সাজা স্থগিত করে তাকে মুক্তি দেয়। আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর ওই ছয় মাস শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত ১৫ সেপ্টেম্বর সরকার খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়ে দেয়। বাসায় থেকে দেশেই চিকিৎসা করাবেন এবং দেশের বাইরে যেতে পারবেন না— এমন শর্তে মুক্তির পর গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজায়’ অবস্থান করছেন তিনি।
তবে দীর্ঘদিন ধরে ৭৫ বছর বয়সী খালেদা জিয়া চোখ ও দাঁতের সমস্যা, আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছেন। মুক্তি পেলেও করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে এখনও তার উন্নত চিকিৎসা শুরু হয়নি। তার জন্য দলীয় চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি টিম রয়েছে। ওই টিমের এক-দুজন নিয়মিত বিএনপিপ্রধানের শারীরিক অবস্থার ফলোআপ করছেন। এছাড়া বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেনসহ দলের সিনিয়র চিকিৎসকদের একটি দল খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর রাখছেন। পুত্রবধূ ডা. জোবায়দা রহমানও তার চিকিৎসার নিয়মিত তদারকি করছেন।
খুরশিদ আলম খান ও এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের আইনজীবী ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন জাগো নিউজকে বলেন, ‘খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। তাকে বিদেশে চিকিৎসা করানোর জন্যই পরিবার মুক্তি চেয়েছিল। কিন্তু যখন তিনি মুক্তি পান, তখন করোনা মহামারির কারণে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন সর্বশেষ চিকিৎসা নিয়েছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। এর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রেও চিকিৎসা নিয়েছিলেন। প্রায় দুই বছর ধরে তার ফলোআপ চিকিৎসা হচ্ছে না। এ কারণে এবার আরও লম্বা সময়ের জন্য খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করেছিল পরিবার। স্বজনরা চেয়েছিলেন, সরকারপ্রধান এবার খালেদা জিয়ার স্থায়ী মুক্তির ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এবারও আগের শর্তে সরকার তার মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে।
তিনি দুর্নীতি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত, বিদেশে যেতে চাইলে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে কি-না, জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘যদিও দুর্নীতি মামলায় সাজা হয়েছে, কিন্তু এখানে আদালত, দুদকের আইনজীবী ও আমাদের আইনজীবীদের কোনো কাজ নেই, সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব সরকারের। আমাদের সবারই প্রচণ্ড ইচ্ছা, তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হোক। বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিক সরকার। যেহেতু সরকার দুটি শর্তে তার মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়েছে, এখন যদি শর্ত কাটছাঁট করতে হয় বা নতুন করে যদি বিদেশে নেয়ার জন্য আবারও আবেদন করার প্রয়োজন হয়, তাহলে সরকারই তার বিদেশ যাওয়ার অনুমোদন দিতে পারে। সেক্ষেত্রে আর আদালতের প্রয়োজন নেই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুপ্রিম কোর্টের এক সিনিয়র আইনজীবী এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, বিদেশে যেতে পারবেন না— এমন শর্ত দিয়ে যেহেতু সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে, এখন চাইলে সরকারই তাকে আবার বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে। এছাড়া বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করতে যাওয়ার জন্য যদি প্রয়োজনে আদালতের দ্বারস্থ হতে হয় সেটাও লাগতে পারে।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হলে সরকারই অনুমোদন দিতে পারে। কারণ তাকে সরকারের সিদ্ধান্তে মুক্তি দেয়া হয়েছে। তবে তিনি যদি মনে করেন যে, তার চিকিৎসা এ দেশে করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে আদালতের দ্বারস্থ হতে হবে। তখন উভয়পক্ষ শুনানি করবে, তাতে তারা জানাতে পারবেন যে, এ দেশে তার চিকিৎসা করানো আর সম্ভব নয়। তখন আদালত হয়তো কনসিডার (বিবেচনা) করতে পারেন বিদেশে চিকিৎসার ব্যাপারটা।
সাবেক এ আইনমন্ত্রী আরও বলেন, আদালতের ডিরেকশন (দিকনির্দেশ) ছাড়া তো তিনি দেশের বাইরে চলে যেতে পারবেন না। যেহেতু আদালত তাকে কনভিকশন (দণ্ডাদেশ) দিয়েছেন।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাওয়ার অনুমোদন একমাত্র সরকারই দিতে পারে। কারণ সরকার ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা অনুযায়ী শর্ত দিয়ে তার মুক্তি দিয়েছে। আমার অভিমত হলো, সাজা স্থগিতের সিদ্ধান্ত সরকার দিয়েছে, এখন আবার নতুন করে মুক্তির মেয়াদও বাড়িয়েছে। এখানে তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে, আমার ধারণা আদালতের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই, যা করার সরকারই করতে পারবে।
তবে দুদকের প্রধান আইন কর্মকর্তা খুরশিদ আলম খান মনে করেন, ‘চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হলে খালেদা জিয়াকে আদালতের অনুমতি নিতে হবে।’
খুরশিদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, খালেদা জিয়ার পরিবারের আবেদনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তার মুক্তির সিদ্ধান্ত দেয়া হলেও বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হলে আদালতের অনুমোদন লাগবে। সরকার যে আদেশ দিয়েছে, তাতে বিদেশ যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন বিদেশে যেতে হলে আইনজীবীর মাধ্যমে তাকে আদালতে আবেদন করতে হবে। আবেদনের পর এমন প্রশ্নও আসে যে, বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে আদালত কতটা কনসিডার (বিবেচনা) করবেন। এ বিষয়ে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
বিএনপির নেতা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, সরকারের আরেকটা নির্বাহী আদেশ লাগবে। এজন্য একটা নতুন আবেদন করতে হবে। সাজাটা স্থগিত আছে, থাকবে। এটা থাকাবস্থায় আরেকটা আবেদন করতে হবে। যাতে তিনি মুভ করতে পারেন, দেশের বাইরে চিকিৎসা নিতে পারেন।
আদালতের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে কি-না, এমন প্রশ্নের জবাবে বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, ‘না, কারণ এটা নির্বাহী আদেশের প্রশ্ন। আদালতের ফাংশন (কর্তব্য) এখানে নেই। কারণ ম্যাটারটা (বিষয়টা) তো আদালতের কাছে নেই এখন। সাজাটা সাসপেন্ড (স্থগিত) হয়ে গেছে নির্বাহী আদেশে, কাজেই আদালতের আর সুযোগ নেই। এখন পরিবার থেকে আবেদন করলে, প্রোপার চ্যানেলে, অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার (প্রধানমন্ত্রী) যদি অনুমোদন দেন, তাহলেই সম্ভব বিদেশে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা দেয়া।’
এফএইচ/এইচএ/এমএআর/পিআর