ভারত ‘শূন্য’, চীনের এত বিনিয়োগ কেন?
অডিও শুনুন
>> গত অর্থবছরে চীনের অর্থছাড় ১০৩৩.৩৭ মিলিয়ন ডলার
>> সেখানে ভারত মাত্র ১২৫ মিলিয়ন ডলার অর্থছাড় করেছে
>> নতুন করে ২৪৪ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয় চীনের সঙ্গে
>> সেখানে ভারতের সঙ্গে কোনো চুক্তি হয়নি বাংলাদেশের
ভারত ও চীন— উভয় দেশের জন্যই এখন অভূতপূর্ব গুরুত্বের জায়গা হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। নিজেদের গুরুত্ব বজায় রাখতে চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে; অন্যদিকে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে ভারতও। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এদেশে বিনিয়োগ কমেছে প্রতিবেশী দেশটির।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে চীন চুক্তিবদ্ধ অর্থছাড় করেছে এক হাজার ৩৩ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন (১০৩ কোটি) মার্কিন ডলার। সেখানে ভারত ছাড় করেছে কেবল ১২৫ মিলিয়ন (সাড়ে ১২ কোটি) ডলার। গত অর্থবছরে বাংলাদেশকে চীন দুই হাজার ৪৪১ দশমিক ৫৮ মিলিয়ন (২৪৪ কোটি) ডলার ঋণ-অনুদান দেবে বলে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে; যেখানে ভারতের সঙ্গে এ ধরনের কোনো চুক্তিই হয়নি।
এমন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ঘুরছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের সক্ষমতা ভারতের নেই, নাকি তারা নীতিগতভাবে এখানে বিনিয়োগ করা থেকে বিরত থাকতে চায়? অন্যদিকে বাংলাদেশে এত বিশাল বিনিয়োগ কেন করছে চীন?
ভারতের বিনিয়োগ কম আসার বিষয়ে জানতে চাইলে ইআরডির কর্মকর্তারা বলছেন, ভারতের সক্ষমতাই নেই বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার।
আলতাফ পারভেজ ও ইমতিয়াজ আহমেদ
তবে ইআরডির কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নন দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘এই সিজনে না দিলেও আগে তো ভারত বাংলাদেশকে সহায়তা দিয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক— সবধরনের সম্পর্কই আছে। আমাদের তো বড় প্রতিবেশী তারাই। ভারত কত টাকা দিল আর চীন কত টাকা দিল—এই হিসাব করলে চীন এগিয়ে থাকবে। কিন্তু ভারত তো আমাদের ইমিডিয়েট প্রতিবেশী। এটা তো বাস্তবতা। প্রতিবেশী তো পরিবর্তন করা যায় না। আবার শুধু টাকা দিয়ে তো সম্পর্কের গভীরতা মাপাও যায় না। সম্পর্কের ক্ষেত্রে টাকা, অনুদান, ঋণ একটা ব্যাপার; তবে এটাই সব নয়।’
আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘ভারতের বিনিয়োগের সক্ষমতা আছে। তারা বিনিয়োগ করেছেও। হয়তো পরিমাণ কম। হয়তো প্রত্যাশার তুলনায় কম এবং চীন-জাপানের তুলনায় কম; কিন্তু আছে। ভারত বিনিয়োগ করবে কি-না, সেটা তো তাদের হিসাবের ওপর নির্ভর করে। হয়তো সেগুলো ব্যাটে-বলে হচ্ছে না, দুইয়ে দুইয়ে চার হচ্ছে না হয়তো।’
গত অর্থবছরে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঋণচুক্তি সই না হলেও নতুন অর্থবছরে একটি প্রকল্পে ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তারা। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেই ‘বারইয়ারহাট-হেঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ’ প্রকল্পে খরচ হবে ৮৪৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দেবে ২৬৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, ভারত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৫৮১ কোটি ২০ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগের সক্ষমতা আছে বলে মনে করেন না। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভারতের অর্থনীতি করোনা মহামারির আগে থেকেই ভালো করছিল না। তাদের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। তারা এমনিতেই অর্থনৈতিক চাপে ছিল। সেই জায়গা থেকে ঋণ দেয়ার প্রতিশ্রুতি, সেটা রাখা অত সহজ ভারতের জন্য হওয়ার কথা নয়। দ্বিতীয়ত, ভারতের আমলান্ত্রিক জটিলতা অনেক বেশি। দিল্লি সরকার হয়তো একটা সিদ্ধান্ত নিল, কিন্তু দেখা গেল রাজ্য সরকার হয়তো তাতে উৎসাহী নয়। এরকম বিভিন্ন ধরনের বিষয় রয়েছে। ভারতে আমলাতান্ত্রিকতার জন্য অনেক কিছু পিছিয়ে যায়। তৃতীয়ত, করোনা এসে তো আরও তাদের সমস্যা বাড়িয়ে দিল। তারা এখনও সামাল দিতে পারেনি। সেখানে অন্য দেশকে সাহায্য করার যে বিষয়গুলো, স্বাভাবিকভাবে অত গুরুত্ব পায় না।’
বিপরীতে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগের সক্ষমতা তুলে ধরে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘সেই জায়গা থেকে যদি তুলনা করি চীনের সঙ্গে (ভারতের), বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতি এখন চীনের। তাদের যে মূলধন আছে, সেটা বিশাল। সেটা তাদের জন্য সুবিধা। দ্বিতীয়ত, চীন তাদের এফিশিয়েন্সির ব্যাপারে প্রচণ্ড ফার্স্ট। তারা এত তাড়াতাড়ি জিনিসপত্র দিতে পারে, যেটা অনেক দেশই পারে না। অনেক দেশই স্বীকার করেছে যে, চীনের ডিজবার্সমেন্ট (অর্থছাড় করা) করার বা কোনো কিছু যদি বানাতে চায়, সেটা যথাসময়ে করার ব্যাপারে একধরনের এফিশিয়েন্সি (সক্ষমতা) তৈরি করতে পেরেছে তারা। তৃতীয়ত, চীন করোনা অনেক আগেই সামাল দিতে পেরেছে। বলতে গেলে, এপ্রিল মাসেই তারা সামাল দিয়ে ফেলেছে। অন্য দেশগুলো যখন হাবুডুবু খাচ্ছিল, তখন তারা কিন্তু সামাল দিয়ে ফেলেছিল। মে মাসে তারা উৎপাদনে চলে গেছে। সবমিলিয়ে চীন যত সহজে বাংলাদেশকে ঋণ দিতে পারে, সেটা শুধু ভারতের ব্যাপার নয়, অনেক দেশই পারবে না।’
‘সেই জায়গায় বাংলাদেশ তো আর অপেক্ষা করে থাকতে পারবে না। স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ যে দেশ থেকে সহজে ও তাড়াতাড়ি ঋণ পাবে, সেই দেশের কাছ থেকেই নেবে। আমার মনে হয়, দুটো দেশের সঙ্গে তুলনা করার বিষয় নয় যে, ভারতকে সরিয়ে চীনকে আনা হচ্ছে। বরং চীনের যে মূলধন, ভারত তো তার কাছাকাছি নয়। সেই অবস্থা নেই ভারতের এখন। আমার মনে হয় না যে, বাংলাদেশ একটা দেশকে ছেড়ে আরেকটা দেশে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ার যে চেষ্টা, সেখানে সে মনে করছে যে, যে দেশ তাড়াতাড়ি ঋণ দিতে পারবে, সেই দেশের কাছ থেকেই ঋণটা নেবে’— বলেন ঢাবির এ অধ্যাপক।
চীনের বিনিয়োগ উত্তরোত্তর বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করে ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘বেশকিছু বছর ধরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বাংলাদেশ তো সেই আগের বাংলাদেশ নেই। অনেক ধরনের সমস্যা থাকার পরও প্রবৃদ্ধি নিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে যেকোনো দেশ চেষ্টা করবে এখানে বিনিয়োগ করতে। যেন তার লাভটা সে নিতে পারে। এটা শুধু চীন নয়, জাপানকেও আমরা দেখেছি, বড় আকারে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করছে। সেই জায়গায় আমি মনে করি, একটা দেশকে ছেড়ে আরেকটা দেশে যাওয়া নয়, কারণ আমরা সব দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখতে চাচ্ছি।’
বিষয়টিকে এতটা সাদামাটা হিসেবে দেখছেন না আলতাফ পারভেজ। তিনি মনে করেন, ‘যে টাকা দেবে সে আরও কিছু প্রভাবও রাখতে চাইবে। সেটা স্বাভাবিক। তবে বাংলাদেশ কাকে কতটুকু ছাড় দেবে, না দেবে; সেটা বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করবে।’
ইআরডির তথ্য অনুযায়ী, ভারত ও চীন ছাড়াও ২০১৯-২০ অর্থবছরে উল্লেখযোগ্যভাবে এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) ছাড় করেছে এক হাজার ৬৫৬ দশমিক ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, জাইকা (জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি) এক হাজার ৬৮৫ দশমিক ৭৪ মিলিয়ন ডলার এবং বিশ্ব ব্যাংক ছাড় করেছে এক হাজার ৪১০ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার।
গত অর্থবছরে অর্থ দেয়ার চুক্তি হয় এডিবির সঙ্গে এক হাজার ৭৯৪ দশমিক ৮৬ ডলারের, জাইকার সঙ্গে তিন হাজার ১১৭ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন ডলারের এবং বিশ্ব ব্যাংকের সঙ্গে ৮০৫ দশমিক ৭১ মিলিয়ন ডলারের।
পিডি/এইচএ/এমএআর/জেআইএম