অনলাইনে আস্থার সংকট, পশুর হাটে যেতে ভয়
নির্ধারিত হয়েছে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপনের দিন। বাঙালি সমাজে কোরবানির ঈদ নামেও পরিচিত মুসলমানদের অন্যতম প্রধান এই ধর্মীয় উৎসব পালিত হবে আগামী ১ আগস্ট, শনিবার। ত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হতে বাকি আর মাত্র নয়দিন।
ঈদের নামাজ শেষে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি করবেন সামর্থ্যবান মুসলমানরা। অন্যান্যবার ঠিক এই সময়ে কোরবানির পশু কিনতে ভিড় দেখা যেত হাটগুলোতে। কিন্তু এবারের চিত্র যেন ভিন্ন। করোনার প্রাদুর্ভাবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি নানা বিধিনিষেধ এসেছে হাট-বাজারগুলোতে। কোরবানি পশুর হাটের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
জাগো নিউজের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি জানান, আসন্ন কোরবানি উপলক্ষে চট্টগ্রাম মহানগরীতে তিনটি স্থায়ীসহ সাতটি অস্থায়ী পশুর হাটের অনুমতি দিয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক)। তবে কোরবানির মাত্র নয়দিন বাকি থাকলেও এখনও কোথাও বেচাবিক্রি শুরু হয়নি। এছাড়া কুষ্টিয়া, যশোরসহ উত্তরবঙ্গ থেকেও কোরবানির পশু নিয়ে তেমন কেউ আসছেন না, জানিয়েছেন পশুর হাটের ইজারাদাররা।
চট্টগ্রামে হাট বসলেও এখনও শুরু হয়নি বেচাবিক্রি। মুখে মুখে অনলাইনে বেচাবিক্রির কথা হলেও, মূলত চলছে দেখাদেখি। দু-একটি অনলাইন সাইট আর ফেসবুকে পশু বিক্রির চেষ্টা থাকলেও ক্রেতাদের আস্থায় নিতে পারছেন না বিক্রেতারা। অন্যদিকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে পশুর হাটে যেতে ভয় পাচ্ছেন অনেক ক্রেতা।
এদিকে জেলা প্রাণিসম্পদ অফিস জানিয়েছে, এবার চট্টগ্রামে মোটাতাজা করা হয়েছে ছয় লাখ ৮৯ হাজার ২২টি পশু। এর মধ্যে গরু চার লাখ ৬৪ হাজার ৫৭২টি, মহিষ ৫৭ হাজার ১৩১টি, ছাগল ও ভেড়া এক লাখ ৬৭ হাজার ২১০টি এবং অন্যান্য পশু ১০৯টি। কোরবানির পশুর কোনো সংকট হবে না।
অনলাইনে আস্থার সংকট
করোনার ঝুঁকি এড়াতে কোরবানির পশু ক্রেতাদের অনেকেই অনলাইনে প্রিয় প্রাণীটি কেনার কথা ভাবছেন। কিন্তু এসব ক্রেতাকে আস্থায় নিতে পারছেন না অনলাইন বিক্রেতারা। দু-একটি ফার্ম ওয়েবসাইটে গরুর ছবি ও ভিডিও পোস্ট করে ক্রেতা টানার চেষ্টা করলেও অধিকাংশ ক্রেতাই ভাবছেন, শেষ পর্যন্ত তাদের বাজারেই যেতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘চাটগাঁইয়া গরুর হাট’, ‘সিটিজিবাইডটকম’, ‘গরু-ছাগলের অনলাইন হাট চট্টগ্রাম’, ‘অনলাইন কোরবানির গরুর বাজার চট্টগ্রাম’, ‘শাহ আমানত অ্যাগ্রো’, ‘নাহার অ্যাগ্রো’সহ বিভিন্ন গ্রুপে কোরবানির পশু বিক্রির চেষ্টা চলছে।
গ্রুপগুলোতে খামারি ও বিক্রেতাদের অনেকে ছবি-ভিডিও পোস্ট করে নিজেদের পশুর বিষয়ে জানান দিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনলাইনে পশুর দাম বেশি চাওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ ক্রেতাদের। গুটিকয়েক ব্যক্তি যারা অনলাইনে পশু কিনছেন তারা অনলাইনে পশু দেখলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খামার কিংবা বিক্রেতার বাড়িতে গিয়ে পশু দেখে যাচাই করে ক্রয় করছেন।
জিসান আহমেদ নামের এক ক্রেতা অভিযোগ করে বলেন, ‘অনলাইনে দেখা পশু আর বাস্তবের পশুর মধ্যে ফারাক অনেক। অন্তুত দুটি খামারে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে। ফেসবুকে যেসব পোস্ট দেয়া হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তবের সঙ্গে তার মিল থাকে না। এছাড়া ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার গরু অনলাইনে চাওয়া হচ্ছে ৯০ হাজার টাকা।’
নগরের চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা হাফিজ হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেসবুকে দেখে গত তিনদিনে পটিয়া ও কর্ণফুলী এলাকার তিনটি খামারে গিয়েছি। কিন্তু বাজারের চেয়ে খামারে অনেক বেশি দাম চাওয়া হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, করোনার ভয়ে মানুষ বাধ্য হয়েই অনলাইনে পশু কিনবেন, আসলে বিষয়টা এমন নয়। কিছু শৌখিন মানুষ হয়তো বেশি দামে অনলাইনে পশু কিনতে পারেন। কিন্তু অধিকাংশ ক্রেতা শেষ পর্যন্ত বাজারেই যাবেন।’
অভিযোগ শুধু ক্রেতাদের নয়, আছে বিক্রেতাদেরও। বোয়ালখালীর খামারি আশরাফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফেসবুকে ছবি দেখে অনেকেই ফোন করছেন, কিন্তু বিক্রিতে এর কোনো প্রভাব নেই। কেউ দাম শুনে আর যোগাযোগ করছেন না। আবার অনেকে বাড়িতে আসবেন জানিয়ে আর ফোন ধরেন না।’
কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহাধীন শাহ আমানত অ্যাগ্রোর মালিক মো. আখতার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে কোরবানির গরু বিক্রি করছি। এবার করোনাভাইরাসের কারণে বাজারে না গিয়ে খামার থেকেই অনলাইনে বিক্রির চেষ্টা করছি। অনেকেই যোগাযোগ করছেন। তবে বেশিরভাগই মোবাইলে যোগাযোগ করলেও সরাসরি খামারে এসে গরু কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এর মধ্যে ৩০টির মতো গরু বিক্রি হয়েছে। এবার গরুর প্রকৃত দাম পাব কি-না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছি।’
পটিয়ার খামারি দিদারুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘এবার বিক্রির জন্য ৩০টির মতো গরু তৈরি করেছি। ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপে গরুর ছবি ও ভিডিও পোস্ট করে ক্রেতাদের জানানোর চেষ্টা করছি। আমার মতো অনেকেই এমনটা করছেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখাদেখি পর্যন্তই, এরপর আর কেউ এগোচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত বাজারেই যেতে হবে। মূলত, অনলাইনে পশু বিক্রি নিয়ে যতটা বলা হচ্ছে বাস্তবে এর ছিঁটেফোঁটাও নেই। দু-একটি বড় ফার্ম শৌখিন ক্রেতাদের কাছে দু-একটি করে হয়তো পশু বিক্রি করছে, তাও সরাসরি অনলাইনে নয়। ছবি দেখে খামারে গিয়েই কিনছেন তারা, পেমেন্টও হচ্ছে হাতে হাতে।’
তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত হয়তো ৩ থেকে ৪ শতাংশ মানুষ অনলাইনে পশু কিনবেন। বাকিদের বাজারেই যেতে হবে। কিন্তু শঙ্কা হলো, এখন বাজারে ক্রেতা না থাকলেও শেষ দিকে ক্রেতাদের চাপ সামলাতে পারবে না বাজার। তখন চট্টগ্রামে পশুর সংকট দেখা দিতে পারে।’
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রেয়াজুল হক জানান, চট্টগ্রামে এবার কোরবানির পশুর কোনো সংকট হবে না। তবে ক্রেতাদের বড় অংশকেই বাজারে যেতে হবে। চট্টগ্রামে এবার কোরবানির পশুর চাহিদা সাত লাখ ৩১ হাজার। কিন্তু এত বেশিসংখ্যক পশু অনলাইনে বেচাকেনা সম্ভব নয়। তাই ক্রেতারা যদি এখন থেকে পশু কেনা শুরু করেন তবে করোনার সংক্রমণ কিছুটা হলেও ঠেকিয়ে দেয়া যাবে।
আবু আজাদ/এমএআর/এমএস