করোনা দুর্যোগেও থেমে নেই মাদক কারবারিরা
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছেই। বাড়ছে সংক্রমণের ভীতিও। কিন্তু করোনার এই দুর্যোগকালেও বসে নেই মাদক কারবারিরা। নিত্যনতুন কৌশলে মাদকের চোরাচালান আসছে। কখনও ত্রাণবাহী কিংবা জরুরি পণ্যবাহী বাহনে, কখনও পায়ুপথে, কখনও-বা যানবাহনের ইঞ্জিনের কাভারে গন্তব্যে পৌঁছে যাচ্ছে গাঁজা, ফেনসিডিল কিংবা ইয়াবা। লকডাউনের মধ্যে মাদকসেবীদের জন্য হোম ডেলিভারিও হচ্ছে।
করোনাকালে রাজধানীসহ সারাদেশে অপরাধ কমলেও মাদকের চালান আসছেই। লকডাউনের মধ্যে সবজি, চাল, ডাল ও অ্যাম্বুলেন্সে স্থানান্তর হচ্ছে ইয়াবা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ইয়াবা, ফেনসিডিলের চালান ধরা পড়ছে।
করোনার এই সময়েও পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির মাদকবিরোধী অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হচ্ছেন মাদক-ব্যবসায়ীরা।
র্যাব সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, গত ৮ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হয়েছেন ৮৮০ জন। এ সময় উদ্ধার হয়েছে চার লাখ ৪০ হাজার ৩৯২ পিস ইয়াবা, সোয়া ছয় কেজি হেরোইন, ১৫ হাজার ৪১৭ পিস ফেনসিডিল, গাঁজা ৯৫৪ কেজি, বিদেশি মদ ৭৭৭ বোতল, দেশি ১ হাজার ৯০৫ লিটার এবং বিয়ারের ক্যান জব্দ হয়েছে ১ হাজার ৩২৭টি।
গত ১ থেকে ৭ মে পর্যন্ত র্যাবের অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য জব্দ হয়। এই সাতদিনে গ্রেফতার হন ৭২ জন, জব্দ হয় ৭৬ হাজার ১৭৫ পিস ইয়াবা, আধা কেজি হেরোইন, ১ হাজার ৯৮২ বোতল ফেনসিডিল, ২৯৬ কেজি গাঁজা, ৪৭ কেজি দেশি মদ।
এর মধ্যে শুধু ঢাকায়ই জব্দ হয় ১ হাজার ৫ পিস ইয়াবা, ফেনসিডিল ৭৪১ বোতল ও গাঁজা ৮৫ কেজি। গ্রেফতার হন ১৭ জন।
গত মঙ্গলবার (১২ মে) রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানাধীন শ্যামলী শিশু মেলার সামনে থেকে পেটের ভেতরে বিশেষ কায়দায় লুকিয়ে ইয়াবা বহন ও মাদক ক্রয়-বিক্রয়কালে বাবুল ওরফে হালু (৩৫) ও মো. সুমন নামে দুজনকে আটক করেন র্যাব-২ এর সদস্যরা। তাদের কাছ থেকে নগদ ১৮ লাখ টাকা জব্দ করা হয়। সুমনের পেট থেকে বিশেষ কায়দায় বের করা হয় ৫৫টি পলিথিনে মোড়ানো ২ হাজার ৪৭৫ পিস ইয়াবা।
র্যাব-২ এর আরেকটি দল গত ৯ মে দুপুরে মোহাম্মদপুরের টাউন হল থেকে আলুবোঝাই পিকআপ ভ্যানের পাটাতনের বিশেষ চেম্বারে লুকিয়ে আনা ৫০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধারসহ পাঁচ মাদক-কারবারিকে গ্রেফতার করে।
অন্যদিকে গত ১০ মে রাতে নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জ থানাধীন কাঞ্চন পৌরসভার কালাদী এলাকায় অভিযান চালিয়ে দুই মাদক কারবারিকে ১৩ হাজার ২৩০ পিস ইয়াবা, একটি মাইক্রোবাসসহ হাতেনাতে আটক করে র্যাব সদস্যরা।
গত ৬ মে একই এলাকায় একটি ট্রাক থেকে ৯ হাজার ৬০০ পিস ইয়াবাসহ দুই মাদক-কারবারিকে আটক করে র্যাব-১ এর সদস্যরা। একই দিন একই এলাকায় চেকপোস্ট বসিয়ে মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত একটি জিপ ও ৪০ কেজি গাঁজা জব্দ এবং দুই মাদক-করাবারিকে আটক করা হয়। র্যাব-১ জানায়, জব্দ জিপটির সামনে ‘পুলিশ’ লেখা সাদা কাগজের স্টিকার লাগানো ছিল।
একই এলাকা থেকে গত ৩ মে তিন মাদক-কারবারিকে সাড়ে ৫ কেজি গাঁজা ও পিকআপ গাড়িসহ আটক করে র্যাব-১ এর সদস্যরা।
গত ২ মে ঢাকার সাভার ও রাজধানীর দারুসসালাম থানাধীন এলাকায় পৃথক অভিযানে এক হাজার ১০৬ বোতল ফেনসিডিলসহ তিন মাদক-কারবারিকে আটক করে র্যাব-৪ এর সদস্যরা। এ সময় মাদক পরিবহনে ব্যবহৃত পিকআপভ্যান ও একটি ট্রাক জব্দ করা হয়।
অন্যদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দফতরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে ১৪ কোটি ৯৪ লক্ষাধিক টাকার চোরাচালান ও মাদকদ্রব্য জব্দ করা হয়েছে। এসব মাদকের মধ্যে রয়েছে তিন লাখ ১০ হাজার ৬২১ পিস ইয়াবা, ২২ হাজার ৯৫১ বোতল ফেনসিডিল, ১ হাজার ৪৩৯ বোতল বিদেশি মদ, ২৯০ লিটার বাংলা মদ, ২৯ ক্যান বিয়ার, ৫৬০ কেজি গাঁজা, ৪০০ গ্রাম হেরোইন, ১ হাজার ৫৪টি ইনজেকশন, ২ হাজার ১৭৯টি এ্যানেগ্রা/সেনেগ্রা ট্যাবলেট এবং ৮৭ হাজার ৪৭০টি অন্যান্য ট্যাবলেট।
শুধু এপ্রিলেই মাদকের জোন হিসেবে খ্যাত সীমান্তবর্তী জেলা কক্সাবাজার থেকে র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির অভিযানে জব্দ করা হয়েছে সাড়ে তিন লাখ পিস ইয়াবা। বিজিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন একজন। সর্বশেষ গত ৪ মে রাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে টেকনাফের নাফ নদীতে অভিযান চালিয়ে ৪০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে বিজিবি।
তবে পুলিশ সদর দফতরের হিসেব অনুযায়ী, গত জানুয়ারি মাসে মাদক উদ্ধারজনিত মামলা ৯১৫০টি, ফেব্রুয়ারিতে ৮৫৩১টি ও মার্চে ৭৬২৩টি। তিন মাসে মাদক উদ্ধারজনিত মামলা ২৫ হাজার ৩০৪ টি।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, করোনার মধ্যে পুলিশ অনেক বেশি মানবিক কাজে জড়িত। তবে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা বিশেষ করে রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলায় মাদকের কারবার বন্ধে কাজ করছে পুলিশ সদস্যরা। মাদকের ব্যাপারে পুলিশ সদরের নির্দেশনা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির বাস্তবায়ন এ সময়ও চলছে।
এ ব্যাপারে বিজিবি সদর দফতরের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, করোনার মধ্যেও মাদক কারবারিরা থেমে নেই। তবে সীমান্তে বিজিবির সতর্ক প্রহরার কারণে চোরাচালানের পরিমাণ কমেছে। সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বিজিবি কাজ করছে। সেখানে করোনাকেন্দ্রীক সচেতনতামূলক কাজের পাশাপাশি মাদকবিরোধী কাজ করা হচ্ছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার-বিন-কাশেম জাগো নিউজকে বলেন, করোনাকালে র্যাব সদস্যরা এখনও আশঙ্কাজনকভাবে আক্রান্ত হননি। করোনাকে জয় করে র্যাব সদস্যরা মাদকের চোরাচালান, সন্ত্রাসী, ছিনতাই, ডাকাতি বিশেষ করে জঙ্গি দমনে কাজ করে যাচ্ছে। করোনায় ফাঁকা সড়কে মাদকের চোরাচালান বন্ধে সক্রিয় নজরদারি রেখেছে র্যাব সদস্যরা।
জেইউ/এমএআর/পিআর