লেবু চাষে ভাগ্য বদল


প্রকাশিত: ০৩:৪৭ এএম, ১১ অক্টোবর ২০১৫

লেবু চাষে করে দেশের ভাগ্যটাকেই বদলে দেয়া যায়। অব্যহৃত পাহাড় আর টিলায় লেবু চাষ করে প্রতি বছর আয় করা যায় কয়েক শ কোটি টাকা। লেবু কিংবা লেবুর জুস বিদেশে রফতানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। আর এ অপার সম্ভাবনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাদের অব্যবহৃত পাহাড়গুলো।

সুসংবাদ এটাই যে, দেশে আশা জাগানিয়া লেবুর উৎপাদন দিন দিনই বাড়ছে। শুরু হয়েছে এর বাণিজ্যিক চাষ। প্রতি বছর প্রায় ৫ হাজার লেবু বাগানে উৎপাদিত হচ্ছে ১০ হাজার টন কাঁচা লেবু । কেবল দেশেই নয় বিদেশেও বেড়েছে এর চাহিদা। সম্ভাবনাময় এ লেবুর ব্যাপক চাষ করে লেবুকে প্রধান অর্থকরী ফসলের তালিকায় আনা সম্ভব।

দেশের সিলেট, সুনামগঞ্জ,চট্রগ্রাম, বান্দরবানসহ বিভিন্ন এলাকার অব্যবহৃত পাহাড় টিলাগুলো কাজে লাগিয়ে কেবল লেবু চাষেই প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। আশার কথা এটাই এ পাহাড়ে লেবু চাষ করে ভাল ফলন পাচ্ছে লেবু চাষিরা। তবে যে পরিমাণ লেবু এ দেশে উৎপাদন হচ্ছে আর যতটুকু বিদেশে রফতানি হচ্ছে তাতে মোটেও খুশি হওয়ার কারন নেই।

lamon

সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা, কৃষি বিভাগের প্রচার প্রচারণা, বেকার শিক্ষিত যুব সমাজকে লেবু চাষে উদ্বদ্ধকরণ এবং লেবু চাষিদের স্বল্প সুদে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করলে লেবু থেকে প্রতি বছর কয়েক শ’কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এছাড়া লেবু চাষে দেশের বেকারত্ব সমস্যার সমাধান সেই সঙ্গে পাহাড়ি জনগোষ্টির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

বিভিন্ন প্রসাধন ও কেমিকেল কোম্পানিগুলো লেবুর বড় ক্রেতা। এছাড়াও বেভারেজ কোম্পানি ও লেমন কোল্ড ড্রিংকস এর জন্য কাগজি লেবু ক্রয় করছে অনেক কোম্পানি। প্রসাধন ও লেমন কোল্ড ড্রিংকস কোম্পানিগুলো এখান থেকে পাইকারি হারে লেবু ক্রয় করায় চাষিরা দামও ভাল পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন কয়েকজন লেবু চাষি। অপরদিকে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, সৌদিআরব ও দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত লেবু রফতানি হচ্ছে। লেবু চাষের সম্ভাবনা নিয়েই বিভিন্ন অঞ্চলের লেবু চাষের উপর তৈরি করা হয়েছে আজকের এ প্রতিবেদন।

lamon

বিশাল এলাকা জুড়ে লেবু বাগান আর লেবু বাগান। রয়েছে কাগজি লেবু, জারা লেবু, ঝোটা লেবু, চাইনা লেবু, এলাচি লেবু ও শরবতি লেবুসহ বিভিন্ন জাতের লেবু। বাগানের গাছগুলো লেবুতে ভরে গেছে। কোন কোন গাছ থোকা থোকা লেবুর ভারে নুয়ে পড়ছে। বর্তমানে চলছে লেবুর ভরা মৌসুম। প্রতিদিন ভোর থেকে চাষিরা বাগান থেকে লেবু ছিঁড়ে টুকরি ভর্তি করে ও কাপড় মুড়িয়ে কাঁধে করে পাহাড়ী আঁকা-বাঁকা পথ বেয়ে বাজারে নিয়ে আসে।

প্রতি বছর লেবুর মৌসুমে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সুনামগঞ্জ ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের দোহাজারী, বাগিচাহাট, খাঁনহাট, কাঞ্চননগর, হাশিমপুর, বাদামতলা, রৌশনহাট, কমল মুন্সির হাট, চক্রশালাসহ বিভিন্ন স্থানে লেবু বিক্রির অস্থায়ী হাট বসে। পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদারেরা এখান থেকে লেবু ক্রয় করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়।

চাষিরা জানিয়েছেন, এ সকল এলাকা থেকে প্রতিদিন দেড়শ থেকে দু’শ ট্রাক লেবু ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে। পটিয়া-চন্দনাইশের বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে লেবু চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে অনেক চাষি। সিলেটের শ্রীমঙ্গল, মৌলভিবাজার, সুনামগঞ্জে বাণিজ্যিকভাবে লেবুর চাষ হচ্ছে।  বাণিজ্যিকভাবে চাষ হওয়া লেবু কেবল দেশে নয় বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। এখানকার উৎপাদিত লেবুর স্বাদে, ঘ্রাণে ও গুণে-মানে সেরা বিধায় স্বদেশের ক্রেতাদের পাশাপাশি মন জয় করছে দেশের বাইরের ক্রেতাদেরও। 

lamon

লেবুচাষ অধিক লাভজনক হওয়ায় এ অঞ্চলের মানুষ লেবুচাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছে বলে জানা গেছে। দেশের অনেক অঞ্চলের অনেক বেকার যুবকের ভাগ্যও বদলে দিয়েছে লেবু চাষ। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে লেবু চাষের সাফল্য এখনো একটা নির্দিষ্ট পর্যায় পার হতে পারছে না। গ্রামীণ দরিদ্র চাষিরা উন্নত প্রযুক্তি, ভালো দাম এবং সংরক্ষণের সুযোগ পেলে লেবু চাষ কৃষি সাফল্যের উদাহরণ হয়ে থাকবে। লেবুও অর্থকরী ফসলের তালিকার এর নাম লিখাতে সক্ষম হবে।

চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের আওতাধীন লালুটিয়া, ধোপাছড়ি, সাঙ্গু ও পটিয়ার শ্রীমাই, গুনগুরি বিটের প্রায় ২০ হাজার একরের অধিক এলাকাজুড়ে নানা জাতের লেবুর আবাদ করা হয়েছে। এছাড়া চন্দনাইশ, দোহাজারি ও পটিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় কাগজি লেবু, জারা লেবু, শরবতি লেবু ও এলাচি লেবুসহ নানা জাতের লেবুর চাষ হচ্ছে। বেশিরভাগ এলাকার ভালো ফলনও হচ্ছে। এ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা না থাকায় পাহাড়ি উর্বর মাটিতে লেবুচাষ ভালো হয় বিধায় অনুকূল পরিবেশও বিদ্যমান।

এদিকে দক্ষিণ চট্টগ্রামে বহু বেকার যুবক লেবুচাষের মাধ্যমে তাদের ভাগ্য ফিরিয়েছেন। তবে তারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলেও এই সম্ভাবনাময় খাতটি বেশি দূর এগিয়ে নিতে পারছেন না। এর কারণ হিসেবে বেশ কয়েকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জানা গেছে, ব্যাপক হারে লেবু উৎপাদিত হলেও যোগাযোগ সমস্যা এখনো বড় একটি সমস্যা রয়ে গেছে। দুর্গম যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে বাগান থেকে বাজারে লেবু আনতে খরচ বহুগুণ বেড়ে যায়। এছাড়া সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় আড়তদারদের বেঁধে দেয়া দামেই লেবু বিক্রি করতে বাধ্য হয় ক্রেতারা।

কাগজি লেবুর চাষাবাদ লাভজনক হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলায় কাগজি লেবু চাষের প্রতি চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে। মৌলভীবাজার জেলায় এক হাজার পঞ্চাশ হেক্টর জায়গায় লেবু চাষ হয়। জেলার সাত উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার লেবু বাগান রয়েছে। যার সঙ্গে মালিক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী মিলিয়ে প্রায় অর্ধলক্ষাধিক লোক সম্পৃক্ত রয়েছেন। বিভিন্ন প্রসাধনী ও কেমিকেল কোম্পানিগুলো কিনে নিচ্ছে কাগজি লেবু। তাছাড়া বেভারেজ কোম্পানিও লেমন কোল্ড ড্রিঙ্কসের জন্য বিপুল পরিমাণ কাগজি লেবু ক্রয় করছে। বছরের সব সময় কাগজি লেবু উৎপাদন হলেও মৌসুমে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়ে যায় কয়েকগুণ।

ফলে মৌসুমে কাগজি লেবুর দামও অনেক হ্রাস পায়। প্রতি বছরে শুধু মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে কমপক্ষে অর্ধশত কোটি টাকার কাগজি লেবু বেচাকেনা হয়ে থাকে। মৌলভীবাজার জেলার বিস্তীর্ণ টিলা ও সমতল ভূমির দিগন্ত জুড়ে কাগজি লেবুর বাগান। উঁচু-নিচু টিলা, পাহাড়ের ঢালু, ফসলি জমির মাঠ, বাড়ির আঙিনাসহ আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে এসব কাগজি লেবুর বাগান। আদিকাল থেকে মৌলভীবাজারে বিভিন্ন প্রজাতির লেবুর চাষ কমবেশি হলেও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষাবাদ শুরু হয় ষাটের দশক থেকে। প্রচুর পরিমাণে লাভজনক হওয়ায় মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, বড়লেখায় কাগজি লেবুর ব্যাপক চাষাবাদ করা হচ্ছে। লাভজনক হওয়াতে লেবু চাষের প্রতি চাষীদের উৎসাহ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

lamon

তবে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে এর চাষাবাদ সবচেয়ে বেশি হয়। যা অন্যান্য অঞ্চলের উৎপাদিত কাগজি লেবুর চেয়ে স্বাদ, গন্ধ ও আকৃতিতে আলাদা। শ্রীমঙ্গলের কাগজি লেবুর চাহিদা দেশের অভ্যন্তরে যেমন রয়েছে তেমনি বিদেশেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা জানান। প্রতি বছরেই লন্ডনসহ মধ্যপ্রাচ্যে শ্রীমঙ্গলের কাগজি লেবু রফতানি করা হয়ে থাকে। চট্টগ্রাম ও টাঙ্গাইলের মধুপুরের পাহাড়ি এলাকায় কাগজি লেবুর চাষ করা হলেও তা শ্রীমঙ্গলের লেবুর মতো উন্নত ও মানসম্পন্ন নয়।

লেবু চাষিরা জানান, চলতি বছরে অনাবৃষ্টির কারণে কাগজি লেবুর ফলন কম হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত বৃষ্টি ও সার সংকট না থাকলে ফলন আরো অনেকগুণ বেশি হতো। লেবু চাষিরা আরো জানান, প্রতি বছরই সার তাদের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। বাজারে সার কিনতে যেমন সমস্যা হয় তেমনি কৃষি অফিস থেকে চাহিদা মতো সারের বরাদ্দ পাওয়া যায় না।

এদিকে লেবু চাষ করে ভাগ্যের পরিবর্তন করেছেন কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার পাত্রখাতা খন্দকারপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক কাশেম আলী। লেবু চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় এ জেলায় তার পথ অনুসরণ করে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন অনেকেই। লেবুর চাহিদা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা মতো লেবু সরবরাহ করতে অনেক সময় হিমশিম খেতে হয় তাকে। প্রতি বছর লেবু বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করছেন ২ লাখ টাকা।

১৯৭১ সালের দিকে কাশেম আলী তার ৬০ ডেসিমেল জমির ১২ ডেসিমেল জমিতে লেবু চাষের জন্য কৃষি খামার গড়ে তোলেন। শুরুতে তিনি ফার্মে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি, ফলমূল ও লেবু চাষ শুরু করেন। কিন্তু ১৯৭৮ সালের দিকে লেবু চাষের প্রতি ঝুঁকে পড়েন তিনি। তখন থেকে তার লেবু চাষের গতি বেড়ে যায়। লেবু চাষি কাশেম আলী প্রতি বছর গড়ে ৮০ হাজার পিচ লেবু বিক্রি করে প্রায় ২ লাখ টাকা মুনাফা অর্জন করেন। প্রতিটি লেবু বিক্রি করেন ২/৩ টাকা দরে। লেবু চাষি কাশেম আলী তার গ্রামের লোকজনদেরবিনা পয়সায় লেবু বিতরণ করেও নজর কেড়েছেন। কাশেম আলী তার কৃষি ফার্মে তিন জাতের লেবু চাষ করেন। তিন জাতের লেবুর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় কাগজি জাত, চায়না ও ডাকজামির জাতের লেবু।

পটিয়া-চন্দনাইশের বিস্তৃর্ণ এলাকা জুড়ে লেবু চাষ করে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে অনেক চাষি।

লেবু বাগান মালিক সমিতির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চন্দনাইশ ও পটিয়ায় প্রতি বছর প্রায় ৫-৬ কোটি টাকার লেবু উৎপাদিত হয়। লেবু চাষের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ আন্তরিক হয়ে লেবু চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান, লেবু সংরক্ষণের জন্য কোল্ড স্টোরেজ স্থাপন, লেবু বিক্রির জন্য সাধারণ বিক্রি কেন্দ্র স্থাপন ও লেবু চাষিদের কৃষি প্রযুক্তির আওতায় আনতে পারলে এ এলাকার চাষিরা লেবু চাষ করে মজবুত অর্থনীতির ভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হবে।

এসএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।