দিল্লির দাঙ্গার পর সর্বভারতে বিজেপির ভোট আরও বাড়বে
আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসবিষয়ক গবেষক। লিখছেন রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। দিল্লির দাঙ্গা নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। দাঙ্গার ফলে বিজেপির জনপ্রিয়তা আরও বাড়বে বলে মত দেন।
বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ায় বিজেপিকে মোকাবিলা দুরূহ হয়ে পড়ছে বলেও উল্লেখ করেন। দিল্লির আগুন যেন বাংলাদেশে না লাগে, সেজন্য সতর্ক থাকারও আহ্বান জানান এ বিশ্লেষক। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : দাঙ্গার আগুন নিভে গেছে। কিন্তু মানুষের মনে দিল্লির আগুনের ক্ষত দগ দগ করছে। ঘর পুড়ল, মসজিদ পুড়ল। মানুষও মরল। সভ্যতার এমন সময়ে রাজধানী দিল্লির মতো জায়গায় এ নৃশংসতা! কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?
আলতাফ পারভেজ : প্রথমত বলব, এ দাঙ্গা আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল না। ভারতের অনেক জায়গায়ই হরহামেশা ছোট ছোট আকারে এমন দাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। বলতে পারেন, দিল্লির দাঙ্গা একটি বড় সংস্করণ। এ কারণেই বড় আকারে সামনে এসেছে। আসলে দাঙ্গার ঘটনা বড় কিছু নয়। ভিন্ন কিছুও নয়।
মনে রাখতে হবে, এমন দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেই আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ) রাজনৈতিক শাখা বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। এটি কিন্তু অপরিকল্পিত ঘটনা নয়।
জাগো নিউজ : অনেকে দিল্লির দাঙ্গাকে গুজরাটের দাঙ্গার সঙ্গে তুলনা করছেন। আপনি কী মনে করেন?
আলতাফ পারভেজ : অবশ্যই গুজরাটের দাঙ্গার সঙ্গে দিল্লির দাঙ্গা তুলনীয়। এর ব্যাখ্যাও আছে। বিজেপির নীতি হচ্ছে, ভারতে হিন্দু-মুসলমান ভাগ করে ফেলা এবং হিন্দুদের ভোট নিয়ে ক্ষমতায় থাকা।
বিজেপি জনগণকে বিভক্ত করে দেশের ব্যবসা ও খনিজ সম্পদ তুলে দিতে চায় করপোরেটদের হাতে। করপোরেটদের সঙ্গে বিজেপির এটিই হচ্ছে সমঝোতা। অর্থাৎ আরএসএস-বিজেপি হিন্দু-মুসলমান ভাগ করে রাজনীতি করবে, মানুষ এ রাজনীতি নিয়ে মেতে থাকবে। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা দেশের সম্পদ, খনিজ সম্পদ নিয়ে নিজেদের মতো করে ব্যবসা করবে, ভোগ করবে। এটিই হচ্ছে গুজরাট মডেল। এ মডেল দিল্লিতে এলো। আসামে আসছে। পশ্চিমবঙ্গে আসবে। বলতে পারেন, গুজরাট মডেলের ভারতীয়করণ বা জাতীয়করণ চলছে।
জাগো নিউজ : ভারতে করপোরেটরা তো ব্যবসা করেই আসছে। এখন এ মডেলে যেতে হচ্ছে কেন?
আলতাফ পারভেজ : বিশ্বের যে কয়টি দেশে বিলিয়নিয়ার (১০০ কোটি ডলারের মালিক) দ্রুত গতিতে বাড়ছে, ভারত তার মধ্যে অন্যতম। এটি ভারতে ঘটছে নরেন্দ্র মোদির আমলে। তার মানে একদিকে ফ্যাসিবাদী শাসন, সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়ন অন্যদিকে বিলিয়নিয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি। নরেন্দ্র মোদি এ মডেলেই গুজরাট সাজিয়েছেন। এখন ভারত সাজাতে চাইছেন। ভারতের গণমাধ্যমগুলো এখন তা-ই বলছে।
জাগো নিউজ : বিভাজনের রাজনীতিতে ভর করে এ মডেল। একুশ শতকে এসেও দাঙ্গা দেখতে হচ্ছে। সে দাঙ্গা বিজেপিকে সুবিধা দিচ্ছে, করপোরেটদের সুবিধা দিচ্ছে বলছেন। কিন্তু ভারতের রাজনীতি কী এমন মডেল ধারণ করে?
আলতাফ পারভেজ : এ রাজনীতি অনেকের কাছেই খারাপ লাগবে। বিশেষ করে যারা মানবতাবাদী তারা এ রাজনীতি কোনোভাবেই ধারণ করতে পারছেন না। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির এ মডেল যদি আপনি একটি প্রডাক্ট হিসেবে দেখেন, তাহলে বুঝবেন ভারতের হিন্দুরা এটি লুফে নিয়েছে। গুজরাট দাঙ্গার পর নরেন্দ্র মোদি দীর্ঘ সময় সেখানকার ক্ষমতায় ছিলেন। সেখানে নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে।
আমার কাছে মনে হচ্ছে, দিল্লির দাঙ্গার পর সর্বভারতে বিজেপির ভোট আরও বাড়বে। অনন্ত কমবে না, তা বলতে পারি। যদিও আমার এ কথা শুনতে খারাপ শোনাচ্ছে। কিন্তু এটিই হচ্ছে বাস্তবতা।
বিজেপি দুটি নীতিকে প্রডাক্ট বানিয়ে রাজনীতি করছে। একটি হচ্ছে, পাকিস্তানের সঙ্গে ছদ্ম যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে রাখা। আরেকটি হচ্ছে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানো। এ দুটি নীতিই বিজেপির জন্য লাভজনক। বিজেপি এ নীতিতে খুবই সচেতন এবং পরিকল্পিতভাবে অনুসরণ করে আসছে।
বিজেপির এ নীতি অনেককে কষ্ট দিচ্ছে। অনেকেই হা-হুতাশ করছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে হলে বিজেপিকে ওই দুই নীতি নাড়াচাড়া করতে হবে এবং তা-ই করছে তারা।
জাগো নিউজ : এমন নীতি কতদিন টেকসই হবে?
আলতাফ পারভেজ : বিজেপি তার মাঠ সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছে। বিচারব্যবস্থা, সংস্থা, পুলিশ, প্রচার মাধ্যমগুলো বিজেপি নিজের মতো করে সাজিয়েছে।
আপনি দেখবেন, ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বিজেপিনীতির বিরোধিতা করছে না, বরং এক ধরনের সহযোগিতা করছে। ভারতের বিরোধী দলগুলোও অনেকটা নিষ্ক্রিয়। তারা ব্যাপকভাবে বিজেপিনীতির বিরোধিতা করছে না। একধরনের সফট (সহনীয়) হিন্দুত্ববাদী নীতির রাজনীতি দেখাতে চায় বিরোধী দলগুলো। যদিও এ সহনীয় হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি দিয়ে বিজেপির রাজনীতিকে রুখতে পারবে না তারা (বিরোধী দলগুলো)।
জাগো নিউজ : যদি রুখতে না পারে, তাহলে কংগ্রেসের মতো দলগুলো কেন এ ‘সহনীয়’ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করছে?
আলতাফ পারভেজ : তারা রাজনীতিতে টিকে থাকার চেষ্টায় এ প্রয়াস চালাচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হবে না। কারণ মানুষ ছোট হিন্দুত্ববাদী থেকে বড় হিন্দুত্ববাদীকেই গ্রহণ করবে। ভারতে কংগ্রেস ও সেক্যুলার দলগুলোর রাজনীতি শেষ হয়ে গেছে।
দেশটিতে একমাত্র বামপন্থী দলগুলোর একপ্রকার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু কংগ্রেসের ছায়াতলে থাকায় একধরনের বদ অভ্যাস দেখা দিয়েছে তাদের মধ্যে। এ কারণে তারা খুব সুবিধা করতে পারছে না। তবুও তাদের সামনে সুযোগ আছে, কংগ্রেস ও বাকি সেক্যুলার দলগুলোর সে সুযোগ ক্রমশই ফুরিয়ে যাচ্ছে।
২৮ রাজ্যের মধ্যে ১৭-১৮ রাজ্যে বিজেপি ইতোমধ্যে ক্ষমতায় চলে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, কেরালা গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য। এ তিনটিতেও বিজেপি চলে আসবে। নিশ্চিত না হলেও সার্বিক পরিস্থিতি সে কথাই জানান দিচ্ছে।
এএসএস/এমএআর/এমএস