দুশ্চিন্তার নাম গণশৌচাগার
ঢাকা মহানগরীর জনসংখ্যা দুই কোটি ছুঁই ছুঁই। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ নগরীতে জনসংখ্যা এবং আকাশচুম্বী ভবন যেমন বাড়ছে, তেমনি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে নাগরিক সমস্যার পরিধি। এ সমস্যা কাটিয়ে নগরের বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে অর্থাৎ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভাগ করা হয়। কিছুক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন ভাগ করার ফল মিললেও অনেক ক্ষেত্রেই নাগরিক সেবা থেকে যাচ্ছে অধরা। এমন অধরা নাগরিক সেবাগুলোর মধ্যে একটি হলো গণশৌচাগার।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকায় বসবাসরত ও বহিরাগত মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রতিদিন চলাচল করে। এই অর্ধকোটি মানুষের চাহিদার তুলনায় রাজধানীতে পাবলিক টয়লেট বা গণশৌচাগারের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। সেজন্য ঘনবসতিপূর্ণ এ শহরে গণশৌচাগারের খোঁজেও হয়রান হতে হয় নাগরিকদের। বিশেষ করে ভুগতে হয় নারী, শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের।
দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) মোট ওয়ার্ডের সংখ্যা ৫৪। এর মধ্যে নতুন ওয়ার্ড ১৮। ১৯৬ দশমিক ২২ বার্গকিলোমিটার আয়তনের এই সিটি করপোরেশনে পাবলিক টয়লেট আছে ২৫টি। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি) মোট ওয়ার্ড আছে ৭৫টি। যার মধ্যে ১৮টি নতুন ওয়ার্ড। ১০৯ দশমিক ২৫১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই সিটি করপোরেশনে পাবলিক টয়লেট আছে মাত্র ৩৭টি। এর মধ্যে ২৯টি নতুন ও পুরোনো ৮টি।
জানা গেছে, রাজধানীতে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ, সংস্কার, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের। পাবলিক টয়লেটের সংস্কার ও পরিচালনা বাবদ যাবতীয় ব্যয় সিটি করপোরেশন নিজস্ব তহবিল অথবা যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প থেকে বহন করবে অথবা কোনো দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক এনজিও, বিভিন্ন লাভজনক প্রতিষ্ঠানের করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) তহবিল, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, অন্য কোনো বৈধ উদ্যোগী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির তহবিলের মাধ্যমে করার কথা। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন পাবলিক টয়লেট নির্মাণের পর তা ইজারাদারদের কাছে হস্তান্তর করে। তারাই মূলত এগুলো দেখভাল করে। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকার বিনিময়ে তারা সাধারণ মানুষকে শৌচাগার সেবা দিয়ে থাকে।
জনসংখ্যার তুলনায় গণশৌচাগারের সংখ্যা নিয়ে নগরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যহ যত লোক ঢাকার রাস্তায় চলাচল করে, তার তুলনায় খুবই কম গণশৌচাগার। এই শৌচাগার সংকটের কারণে ঘরের বাইরে গেলে বিভিন্ন সময় নানা সমস্যা পোহাতে হয় নাগরিকদের। পড়তে হয় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। সবচেয়ে বেশি ভুগতে হয় নারী, শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের।
ঢাকা শহরের যানজটের নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঢাকায় গাড়ির গতি প্রতি ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৪ কিলোমিটার। অর্থাৎ ঢাকায় খুব ধীরগতিতে যানচলাচল করে। এতে যাত্রীদের দীর্ঘসময় গাড়িতে বসে থাকতে হয়। কর্মজীবীদের দিনের বেশিরভাগ সময়ই বাইরে থাকতে হয়। এ রিপোর্টের সূত্র টেনে নগরের অনেকে বলছেন, চলার পথে অনেকেই গণশৌচাগার নিকটে পান না। সেজন্য তাদের বেশ ভুগতে হয়। পরিস্থিতি বিবেচনায় অনেকে প্রকৃতির ডাক চেপে রাখেন, পরে তাদের স্বাস্থ্যগত নানা সমস্যাও দেখা দেয়।
এ প্রসঙ্গে কথা হচ্ছিল রাজধানীর বাসিন্দা সাইফুল ইসলামের সঙ্গে। শৌচাগার সংকটের বিষয়ে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি অফিসে যাওয়া-আসার পথে বেশিরভাগ দিন যানজট থাকে। যে কারণে অনেক সময় বাস থেকে নেমে হেঁটেই গন্তব্যের দিকে যাই। এছাড়া অনেকে যানজটের কারণে দীর্ঘ সময় বাসে বসে থাকার কারণে টয়লেটে যাওয়ার দরকার পড়ে। কিন্তু এত মানুষের বসবাসের এই শহরে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নেই। যে কারণে অনেক সময় কিছু লোক রাস্তার পাশে মূত্রত্যাগ করে পরিবেশ দূষিত করে। এছাড়া পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট না থাকায় কাজে বের হওয়া নারীদের সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। তাই শহরের অন্যান্য নাগরিক সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নির্মাণ জরুরি।
রাজধানীর আরেক বাসিন্দা নাদিম আহমেদ ঢাকার নবনির্বাচিত দুই মেয়রের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, এই শহরের আয়তন ও জনসংখ্যা অনুযায়ী আরও বেশি পরিমাণে আধুনিক গণশৌচাগার দরকার। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে যারা নগরপিতা নির্বাচিত হয়েছেন, নাগরিকদের এই সমস্যা উপলব্ধি করে তাদের পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া উচিত।
এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিদায়ী মেয়র সাঈদ খোকন জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকা দক্ষিণের নাগরিকদের ব্যবহারের জন্য এখন পর্যন্ত অত্যাধুনিক ৩০টি পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করে উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। পুরনো আটটি টয়লেট সংস্কার করে দেয়া হয়েছে। আরও ৪৭টির মধ্যে ১৫টির নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ হওয়ার পথে। প্রতিবন্ধীবান্ধব এসব আধুনিক টয়লেটে ব্রেস্ট ফিডিং রুম, চেঞ্জ রুম, খাবার পানি, গোসল করার ব্যবস্থাসহ নানাবিধ সুবিধা রয়েছে।
অন্যদিকে গত মেয়াদে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে দায়িত্বপালনকারী (নবনির্বাচিত মেয়র) আতিকুল ইসলাম বলেন, ২৭৯ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উন্মুক্ত স্থানসমূহের আধুনিকায়ন ও সবুজায়ন প্রকল্প’ চলমান রয়েছে। যা ২০২১ সালের জুন মাসে শেষ হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ২২টি পার্ক এবং চারটি খেলার মাঠ উন্নয়ন, ১৫টি ফুটওভার ব্রিজ উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন, ৭৩টি স্বাস্থ্যসম্মত পাবলিক টয়লেট নির্মাণ এবং চারটি কবরস্থানের উন্নয়নকাজ করা হবে।
সূত্র বলছে, ডিএনসিসিতে যে ৭৩টি আধুনিক গণশৌচাগার নির্মাণ হবে, সেগুলোর পেছনে ব্যয় হবে ৩০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আধুনিক সুবিধার এই শৌচাগারগুলোতে নারী ও পুরুষের আলাদা ব্লক, প্রতিবন্ধীদের প্রবেশগম্যতা এবং আলাদা ব্লক, নিরাপত্তার জন্য সিসি ক্যামেরা, নিরাপদ খাবার পানি, হাত ধোয়ার জন্য তরল সাবান এবং শুকানোর জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আইপিএস বা সোলারের ব্যবস্থা, স্যানিটারি ন্যাপকিন, টিস্যু পেপারের ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া নারীদের শৌচাগারের অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে নারীকর্মী নিয়োগ, টয়লেট চত্বরে সবুজ বেষ্টনী স্থাপন এবং দিক-নির্দেশনামূলক সাইনেজও স্থাপন করা হবে।
এএস/এইচএ/এমএআর/জেআইএম