পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৪ শতাংশ শিক্ষকই অনুপস্থিত

মুরাদ হুসাইন
মুরাদ হুসাইন মুরাদ হুসাইন , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:২৩ এএম, ০৮ জানুয়ারি ২০২০

>> ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ১৪ হাজার ৩২২ জন
>> ২০১৮ সালে অনুপস্থিত ছিলেন দুই হাজার ১৩৩ শিক্ষক
>> ক্লাসের চাইতে বাড়তি অর্থ আয়ে আগ্রহ বেশি শিক্ষকদের
>> শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব শিক্ষাবিদদের

ছুটির জন্য নেয়া লাগে না কারও অনুমোদন, ইচ্ছামতো কর্মস্থলে উপস্থিত, কোনো রকম স্বাক্ষর করেই পার্টটাইম ক্লাসে ব্যস্ত হয়ে পড়া, সরকারি খরচে উচ্চডিগ্রি নিতে বিদেশ গেলেও ফিরে না আসার মতো ঘটনা অহরহ ঘটছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। ফলে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন ঘটেছে। এ কারণে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থান পাচ্ছে না

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রকাশিত ৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪ শতাংশ শিক্ষকই অনুপস্থিত থাকেন। জবাবদিহিতা না থাকায় অনুমোদিত ও অননুমোদিতভাবে এসব শিক্ষক কর্মস্থলে উপস্থিত হন না। অনেকে নির্ধারিত ছুটি শেষ হলেও দিনের পর দিন কর্মস্থলে উপস্থিত হচ্ছেন না।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এত বেশিসংখ্যক শিক্ষকের অনুপস্থিতি উচ্চশিক্ষার জন্য একটি বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন শিক্ষাবিদরা। এ বিষয়ে স্ব স্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নেবে- এমন সুপারিশও করেন তারা।

UGC

সম্প্রতি ইউজিসি প্রকাশিত ৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৮-তে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ হাজার ৩২২ শিক্ষকের মধ্যে দুই হাজার ১৩৩ জন অনুপস্থিত ছিলেন। অর্থাৎ ১০ হাজার ৯০৮ জনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অনুপস্থিত শিক্ষকদের মধ্যে প্রেষণে ছুটি ৭০ জন, বিনা বেতনে ৭০ জন, অননুমোদিত ছুটিতে ২৫ জন এবং খণ্ডকালীন ও চুক্তিভিত্তিক অন্যান্য পর্যায়ে এক হাজার ৯৭ শিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন। অর্থাৎ গত বছর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শতকরা ২৪ শতাংশ শিক্ষক কর্মস্থলে উপস্থিত ছিলেন না।

ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে চার হাজার ১৬০ জন, সহযোগী অধ্যাপক দুই হাজার ৩২০ জন, সহকারী অধ্যাপক চার হাজার ৯৪১ জন, প্রভাষক দুই হাজার ৮০৩ জন এবং অন্যান্য (খণ্ডকালীন) ২০৮ জনসহ মোট ১৪ হাজার ৫৫৬ জন কর্মরত।

শিক্ষকদের অনুপস্থিতির বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়ন অসম্ভব। শিক্ষার্থীদেরও সঠিকভাবে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা যায় না। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষকরা ইচ্ছামতো কর্মস্থলে উপস্থিত হচ্ছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষকদের ক্লাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবে সময় পার করে ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক সরকারি খরচে বিদেশে শিক্ষাসফরে পিএইচডি, এমফিলসহ বিভিন্ন কোর্স বা ডিগ্রি করতে যাচ্ছেন। এ কারণে এক থেকে চার বছর পর্যন্ত ছুটি দেয়া হয়। অনেকের ডিগ্রি সম্পন্ন হলেও দেশে ফেরেন না। দিনের পর দিন বিদেশে থেকে চাকরিসহ বিভিন্ন কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এসব শিক্ষককে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত।

UGC

শিক্ষকদের অনুপস্থিতির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তব্যরত দুই হাজার ১৮৮ শিক্ষকের মধ্যে শিক্ষা ছুটিতে ২৬৯ জন, প্রেষণ/লিয়েনে ১৭, বিনা বেতনে ১১, অননুমোদিত তিনজন, খণ্ডকালীন ও চুক্তিভিত্তিক ২৩১ শিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬১৩ শিক্ষকের মধ্যে ৯২ জন শিক্ষাছুটিতে, ১৫ জন প্রেষণে/লিয়েনে, সাতজন বিনা বেতনে, তিনজন অননুমোদিত এবং খণ্ডকালীন ৩১ জন অনুপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭১৮ শিক্ষকের মধ্যে ১৬৩ জন শিক্ষাছুটিতে, একজন বিনা বেতনে, অননুমোদিত একজন এবং খণ্ডকালীন ছুটিতে ছিলেন ৯২ জন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ৩১১ শিক্ষকের মধ্যে শিক্ষাছুটিতে ১৩২ জন, প্রেষণে আটজন, বিনা বেতনে ১৬ এবং খণ্ডকালীন ছুটিতে ছিলেন ৪৪০ জন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫৫২ শিক্ষকের মধ্যে ১১৭ জন শিক্ষাছুটিতে, পেষণ/লিয়েন আটজন, অননুমোদিত পাঁচজন, খণ্ডকালীন ছুটিতে ছিলেন দুজন।

এছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪৬ শিক্ষকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ৫৯৪ জন, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০৪ জনের মধ্যে উপস্থিত ১৩৮ জন, ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩৭ জনের মধ্যে ১৭১ জন, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৪৪ জনের মধ্যে ১৮৭ জন, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩১ জনের মধ্যে ২৬০ জন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৫৭ শিক্ষকের মধ্যে ৫০৯ জন উপস্থিত ছিলেন।

UGC

৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বছরের পর বছর কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি চারজন শিক্ষকের মধ্যে প্রতিদিন একজন অনুপস্থিত থাকছেন। বিষয়টি উচ্চশিক্ষার জন্য একধরনের হুমকি। অনেকে কর্মস্থলে কিছু সময় উপস্থিত থেকে চলে যান। কেউ আবার ক্লাস বাদ দিয়ে দিনের পর দিন ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাস নেন। এসব বিষয় কিন্তু উঠে আসছে না। শিক্ষকরা নৈতিক স্থান থেকে সরে গেলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কত সময় ক্লাসে থাকবেন, তার কর্মস্থলে কতক্ষণ থাকতে হবে, তা স্পষ্ট করা দরকার। বিষয়টি একটি নিয়মের মধ্যে আনা উচিত। কিন্তু এটি না থাকায় অনেকে শিক্ষকতা পেশাকে চাকরি বানিয়ে ফেলেছেন। অফিসে এসে স্বাক্ষর করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে। জুনিয়র শিক্ষকরা সিনিয়রদের নির্দেশনা মানছেন না। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে মানুষ গড়া অসম্ভব হয়ে পড়বে

এ বিষয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি- ২০১০ প্রণয়ন কো-কমিটির চেয়ারম্যান শিক্ষাবিদ অধ্যাপক একরামুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ছুটির জন্য কারও অনুমোদন প্রয়োজন হয় না। তারা নিজেরাই নিজেদের ছুটি দেন। এ কারণে ইচ্ছামতো তারা কর্মস্থলে উপস্থিত হন। জবাবদিহিতা না থাকায় অনেক শিক্ষক দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকেন। এমন পদ্ধতির পরিবর্তন প্রয়োজন।

UGC

তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের আচার-আচরণ, নৈতিকতা, মূল্যবোধসহ বিভিন্ন বিষয়ে শেখানো হয়। অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিয়মিত অনুপস্থিত থাকায় শিক্ষার্থীরা এসব বিষয় শিখতে পারছেন না। শিক্ষকরা সান্ধ্যকালীন কোর্স, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম ক্লাসসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। কাজ না করেও প্রতি মাসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিয়মিত বেতন তোলেন।

‘বর্তমানে শিক্ষকদের নৈতিক স্খলন ঘটেছে। এ কারণে বিশ্ব র‌্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্থান পাচ্ছে না।’

জানতে চাইলে ইউজিসি’র চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানা অনিয়ম থাকায় আমরা কাঙ্ক্ষিত ফল পাচ্ছি না। একশ্রেণির শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয় ঘটেছে। তারা অর্থ আয়ের পেছয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

তিনি আরও বলেন, প্রতি বছরের মতো এবারও ইউজিসি’র বার্ষিক প্রতিবেদনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নানা অনিয়মের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। এটি রাষ্ট্রপতির কাছে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপতি সেটি মূল্যায়ন করে যে ধরনের পরামর্শ দেবেন সেভাবে বাস্তবায়ন করা হবে।

এমএইচএম/এমএআর/জেআইএম

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীরা কোনোভাবে সময় পার করে ডিগ্রি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মানসম্মত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কত সময় ক্লাসে থাকবেন, তার কর্মস্থলে কতক্ষণ থাকতে হবে, তা স্পষ্ট করা দরকার। বিষয়টি একটি নিয়মের মধ্যে আনা উচিত

শিক্ষকরা সান্ধ্যকালীন কোর্স, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম ক্লাসসহ বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।

আরও পড়ুন