গাম্বিয়াতে আশা, ভারতের উত্তাপ বাংলাদেশেও
রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে বাংলাদেশের তৎপরতা ছিল বছরজুড়ে। দ্বিপাক্ষিক সফর, আন্তর্জাতিক সম্মেলন- সবখানেই এ ইস্যুতে সরব ছিল বাংলাদেশ। তবে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে গাম্বিয়ার করা মামলা ছিল আশাজাগানিয়া।
বছরশেষে ভারতের নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) ও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) উত্তাপও এসেছে বাংলাদেশে। সবমিলিয়ে ২০১৯ সালের কূটনৈতিক অঙ্গন ছিল বাংলাদেশের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানের পর কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। সবমিলিয়ে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। তবে দুই বছর চেষ্টার পরও মিয়ানমারের অসহযোগিতায় এখন পর্যন্ত একজনও ফেরত যায়নি।
চলতি বছরের ২২ আগস্ট দ্বিতীয়বারের মতো ব্যর্থ হয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। মিয়ানমারে নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি- এমন দাবি করে সেখানে ফিরে যেতে রোহিঙ্গারা অস্বীকৃতি জানায়। গত বছরের ১৫ নভেম্বরও ব্যর্থ হয় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া।
এরই মধ্যে গত নভেম্বরে জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। ১০ ডিসেম্বর থেকে নেদারল্যান্ডসের হেগ-এ তিনদিনব্যাপী মামলার গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সেসময় আদালতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও বিবাদীপক্ষের এজেন্ট অং সান সু চি উপস্থিত ছিলেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর এ প্রসঙ্গে জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হয়নি। কারণ রাখাইনে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়নি বলে রোহিঙ্গারা ফিরতে চাননি। সে কথা আন্তর্জাতিক মহল থেকে বলা হয়েছে।’
‘এক্ষেত্রে পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, অতি অল্প সময়ে তারিখ নির্ধারণ করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা ছিল। যেখানে প্রস্তুতি যথেষ্ট কম ছিল। প্রাক-প্রস্তুতি থাকলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এতে দেশের ভাবমূর্তিতে কিছুটা হলেও নেতিবাচক ধাক্কা এসেছে’ বলেন তিনি।
হুমায়ুন কবীর বলেন, তবে গাম্বিয়া আইসিজেতে মামলা করে বড় ধরনের কাজ করে দিয়েছে। তাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত। গাম্বিয়া বলেছে, রাখাইনে গণহত্যা চলমান এবং তারা একটি অন্তর্বর্তী আদেশ চান। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, শুনানিতে মিয়ানমারের বক্তব্য খুব বেশি শক্তিশালী ছিল না।
তিনি আরও বলেন, মিয়ানমার আদালত কর্তৃক দোষীসাব্যস্ত হলে তাদের এ সমস্যার সমাধানে নতুন করে ভাবতে হবে। রায় বিপক্ষে গেলে আন্তর্জাতিকভাবে তাদের বিভিন্ন স্বার্থ নেতিবাচকভাবে ক্ষুণ্ন হবে।’
হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘এ রায় যাতে প্রত্যাবাসনের জন্য কাজে লাগে সেজন্য বিশেষ কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে। দোষীসাব্যস্ত হলে মিয়ানমারের বন্ধুদের ভাবতে হবে যে, তারা দেশটির পাশে থাকবে কি, থাকবে না। মিয়ানমারের বন্ধুদের বোঝাতে হবে, রোহিঙ্গারা এখানে থাকলে এ সমস্যা শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে থাকবে না। এটা সবার জন্য ক্ষতির কারণ হবে।’
তবে মিয়ানমারে নির্বাচনের আগে এ সমস্যার কতটুকু সমাধান হবে- সে বিষয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
এদিকে রাখাইনে নিরাপদ পরিবশে তৈরিতে অনীহার পাশাপাশি মিয়ানমার মিথ্যাচার করে গেছে বছরজুড়ে। কিছুদিন পরপরই ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাসের ফেসবুক পেজে বেশকিছু রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ফেরত গেছে বলে জানানো হয়। সবমিলিয়ে ৩৯৭ রোহিঙ্গা স্বেচ্ছায় ফেরতের দাবি করে মিয়ানমার। তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তা প্রত্যাখ্যান করে বলে, একটি লোকও ফেরত যায়নি। মিয়ানমার মিথ্যাচার করছে।
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ফাঁকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ত্রিপক্ষীয় এক বৈঠকের আয়োজন করে চীন। তবে এ সংকট নিরসনে চীনের মধ্যস্থতার উদ্যোগও খুব একটা সফল হচ্ছে না।
এদিকে চলতি বছর দুবার ভারত সফর করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এ সফর থেকে দু’দেশের মধ্যকার অমীমাংসিত তিস্তা চুক্তির সমাধান আসেনি। উপরন্তু ভারতের এনআরসি ও সিএএ ইস্যুর উত্তাপ পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশেও। এ ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফরও বাতিল হয়।
গণমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, এনআরসি ইস্যুতে অনেক বাংলাদেশিকেই বাংলাদেশে পুশ ইন করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে না বলে দেশটি আমাদের আশ্বস্ত করেছে। আমরা ভারত সরকারের আশ্বাসে বিশ্বাস রাখতে চাই।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘ভারতে যে বৈষম্যমূলক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে তার একটি নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে। সেখানে যদি কোনো একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের ওপর চাপ আসে সেক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে একটা চাপ তো বাংলাদেশে আসতে পারে।’
‘বাংলাদেশ সকল সম্প্রদায়কে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে থাকতে চায়। ভারতের কারণে যদি সেই পরিবেশ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয় তাহলে আমাদের পক্ষ থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ভারত যেদিকে যাচ্ছে তাতে চিন্তার কারণ আছে। এজন্য আমাদের দুশ্চিতার কথা ভারতের কাছে পৌঁছাতে হবে।’
জেপি/এমএআর/পিআর