প্রশাসনে ‘কেলেঙ্কারি’ বছরভরে ‘অস্বস্তি’
নানা ঘটনা প্রবাহে মহাকালের গর্ভে ঠাঁই করে নিচ্ছে আরও একটি বছর। যাই যাই করছে ‘২০১৯’। বছরটিতে নানা কেলেঙ্কারি জড়িয়ে ছিল প্রশাসনে। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নারী কেলেঙ্কারিসহ কয়েকটি নেতিবাচক ঘটনায় বছরভর প্রশাসনে ছিল অস্বস্তি।
তবে বহুল প্রতীক্ষিত সরকারি কর্মচারী আইনও এ বছর থেকে কার্যকর হয়েছে। চলতি বছর দুই দফা বড় ধরনের পদোন্নতিও দেয়া হয় প্রশাসনে। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের পর এ বছরই দু’দফা পুনর্বিন্যাসও করা হয়।
দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সরকার এ বছর শুদ্ধি অভিযান শুরু করলেও প্রশাসনে সেভাবে তা দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়নি।
সাবেক ডিসি আহমেদ কবীরের নারী কেলেঙ্কারি
গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে জামালপুরের তখনকার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আহমেদ কবীরের একটি আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে ডিসি আহমেদ কবীরের সঙ্গে তার অফিসের এক নারীকর্মীকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখা যায়।
এতে তুমুল সমালোচনার মুখে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে প্রশাসন। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে ২৫ আগস্ট আহমেদ কবীরকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ওইদিনই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখা) মুশফিকুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি ২২ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়।
জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর
২৫ সেপ্টেম্বর আহমেদ কবীরকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
ইউএনওর কেলেঙ্কারি
ডিসি আহমেদ কবীরের আগে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসিফ ইমতিয়াজের নারী কেলেঙ্কারির বিষয়টি সামনে আসে। বছরের মাঝামাঝি সুনামগঞ্জের হাওর উপজেলা তাহিরপুরে যোগদান করা বিতর্কিত ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজকে নিয়ে বিব্রত হয় প্রশাসন।
চট্টগ্রামে কাজ করার সময় জেলা প্রশাসকের কাছে আসিফ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে বিচার চান তার বান্ধবী দাবি করা এক তরুণী। পরে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে উপজেলা ইউএনও হিসেবে তাকে বদলি করা হয়। বদলির পরই তার জীবনের কলঙ্কিত ঘটনাটি আরও ব্যাপকভাবে প্রচার পায়।
ওই তরুণীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন আসিফ ইমতিয়াজ। একপর্যায়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন আসিফ। এরপর ওই তরুণী জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে বিচার চান। এরপরই তাকে চট্টগ্রাম থেকে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে বদলি করা হয়। গত ৫ সেপ্টেম্বর তাকে ইউএনও পদ থেকেও সরিয়ে দেয়া হয়।
প্রসঙ্গ: দিনাজপুরের ডিসি
গত অক্টোবর মাসে এক নারীর সঙ্গে দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মাহমুদুল আলমের অনৈতিক সম্পর্কে জড়ানোর অভিযোগ উঠে।
ওই সময় এক ভিডিওবার্তায় ডিসির সঙ্গে নিজের অনৈতিক সম্পর্কের তথ্য ফাঁস করেন এক নারী। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় ভিডিওটি।
ইউএনও আসিফ ইমতিয়াজ
ভিডিওবার্তায় ওই নারী জানান, নানা প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন ডিসি মাহমুদুল আলম। এতে তার সংসারও ভেঙে যায়।
ওই নারী আরও দাবি করেন, জামালপুরের ডিসির নারী কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর আমার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন দিনাজপুরের ডিসি মাহমুদুল আলম। ঘটনা জানাজানি হলে আমাকে হত্যার হুমকিও দেয়া হয়।
ইউএনও বীণার ওএসডি নিয়ে বিতর্ক
চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হোসনে আরা বেগম বীনাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করে আদেশ জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এরপর গত ৯ ফেব্রুয়ারি ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন হোসনে আরা। স্ট্যাটাসে তিনি সন্তানসম্ভবা হওয়ার পর একজন বিশেষ কর্মকর্তা তাকে অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন করে নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা থেকে বদলির পাঁয়তারা করে চলেছিল বলে দাবি করেন।
তার সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখ ছিল ২০ এপ্রিল। কিন্তু ওএসডি হওয়ার খবর শুনে প্রচণ্ড মানসিক চাপে ফুসফুসে ব্লাড সার্কুলেশন অস্বাভাবিকভাবে কমে যায়, ফলে পেটের সন্তানের অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় এবং হঠাৎ করেই গর্ভের সন্তান নড়াচড়া পুরোপুরি বন্ধ করে দেয় বলে জানান স্ট্যাটাসে।
দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম
গত ৫ ফেব্রুয়ারি তার ৩১ সপ্তাহ বয়সী প্রি-ম্যাচিউর বেবি সিজার করে বের করা হয়। এখন সে স্কয়ার হাসপাতালের এনআইসিওতে বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করে যাচ্ছে বলে স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন উপজেলা এ নির্বাহী কর্মকর্তা।
‘এই নিষ্ঠুর অমানবিকতার পৃথিবীতে কোনো কর্তাব্যক্তির কাছে আমি এ অন্যায়ের বিচার চাই না, শুধু আমার সৃষ্টিকর্তাকে বলব, তুমি এর বিচার কর!!!’- স্ট্যাটাসে লেখেন সিনিয়র সহকারী সচিব হোসনে আরা।
তার ওই স্ট্যাটাস প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। পরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, কাজের চাপে নারায়ণগঞ্জের সন্তানসম্ভবা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসনে আরা বেগম বীনার অসুস্থতা আরও বাড়তে পারে, সেজন্য তাকে ওএসডি করা হয়।
কার্যকর সরকারি চাকরি আইন
অবশেষে বহুল প্রতীক্ষিত ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ গত ১ অক্টোবর থেকে কার্যকর হয়। ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বর সরকারি চাকরি আইনের গেজেট জারি হয়। সংবিধানে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা থাকলেও ইতোপূর্বে কোনো সরকারই এ আইন প্রণয়ন করেনি। সরকারগুলো বিধি, নীতিমালা ও প্রয়োজন মতো নির্দেশনাপত্র জারি করে সরকারি কর্মচারীদের পরিচালনা করছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন গত দুটি সরকারের সময় আইনটি করার জন্য কয়েক দফা খসড়া প্রণয়ন করা হলেও খসড়ার বিভিন্ন বিধান নিয়ে বিতর্ক ওঠায় কয়েক দফায় উদ্যোগ ভেস্তে যায়।
যদিও আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে বিভিন্ন মহলের আপত্তি রয়েছে।
ইউএনও হোসনে আরা বেগম বীনার আবেগঘন স্ট্যাটাস
নতুন মন্ত্রিসভা, দু’দফা পুনর্বিন্যাস
গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী ও তিনজন উপমন্ত্রী নিয়ে গঠন করা হয় নতুন মন্ত্রিসভা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে রাখা হয় ছয় মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রিসভা গঠনের প্রায় সাড়ে ৪ মাসের মাথায় ১৯ মে তা পুনর্বিন্যাস করা হয়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারকে একই মন্ত্রণালয়ের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের মন্ত্রী করা হয়। আগে তিনি এ মন্ত্রণালয়ের দুটি বিভাগের মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু পুনর্বিন্যাস করায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের ওপর মোস্তাফা জব্বার নিয়ন্ত্রণ হারান।
এছাড়া স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন স্থানীয় সরকার বিভাগের মন্ত্রী করা হয় তাজুল ইসলামকে। তাজুল ইসলাম আগে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং স্বপন ভট্টাচার্যকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। একই মন্ত্রণালয়ের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান স্বপন ভট্টাচার্য। এখানে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের ওপর কর্তৃত্ব হারান তাজুল ইসলাম।
পরে ১৩ জুলাই মন্ত্রী হিসেবে ইমরান আহমদকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি আগে এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ওইদিন ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরাকে দেয়া হয় মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব।
মন্ত্রিসভায় এখন ২৫ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী ও তিনজন উপমন্ত্রী রয়েছেন।
মন্ত্রিসভা গঠনের প্রায় সাড়ে চার মাসের মাথায় তা পুনর্বিন্যাস করা হয়
দু’দফা বড় পদোন্নতি
নতুন সরকার গঠনের পর এই বছরের ১৬ জুন প্রথমবারের মতো বড় ধরণের পদোন্নতি হয় প্রশাসনে। ওইদিন জনপ্রশাসনে ১৩৬ জন উপসচিবকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। গত ১১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রশাসনে এটাই প্রথম বড় ধরনের পদোন্নতি।
যুগ্ম সচিবের পর গত ২৩ অক্টোবর প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয় সরকার। ওইদিন ১৫৬ জন যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে আদেশ জারি করা হয়।
সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে পদোন্নতি
২০১৯ সালে প্রশাসনে মোট ৩৪ জন কর্মকর্তাকে সচিব করা হয়। ২১ জানুয়ারি একজন, ২৬ ফেব্রুয়ারি দুজন, ২৬ মে ১১ জন, ২১ জুলাই পাঁচজন, ২৪ জুলাই একজন, ১ আগস্ট নয়জন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হয়।
এছাড়া ২২ অক্টোবর দুজন, ৫ নভেম্বর একজন, ৫ ডিসেম্বর একজন এবং ১৮ ডিসেম্বর একজন সচিব হিসেবে পদোন্নতি পান।
চলতি বছর ২২ কর্মকর্তাকে সিনিয়র সচিবের মর্যাদা দেয়া হয়। এর মধ্যে ৩১ জানুয়ারি পাঁচজন, ১২ ফেব্রুয়ারি একজন, ২৭ ফেব্রুয়ারি একজন, ৪ এপ্রিল দুজন, ১৪ জুলাই একজন, ২৯ আগস্ট একজন এবং ১৬ সেপ্টেম্বর আটজনকে সিনিয়র সচিব করা হয়।
সর্বশেষ ২৩ ডিসেম্বর আরও সাত সচিবকে সিনিয়র সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।
আরএমএম/এমএআর/জেআইএম