ঢাবি প্রক্টরের ভূমিকা অনেকটা ছাত্রলীগের মতো

আদনান রহমান
আদনান রহমান আদনান রহমান , আল সাদী ভূঁইয়া আল সাদী ভূঁইয়া
প্রকাশিত: ০৫:০১ পিএম, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৯

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় তলার কেবিন ব্লকের ৩৬ নম্বর কেবিনের গেট খুলে ঢুকতেই দেখা যায় চারটি বেড। ডান পাশে দুটি, বামে দুটি। ডানদিকের প্রথম বেডে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন ঢাবি শিক্ষার্থী আমিনুল। তার পরের বেডে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুর

ভিপির চোখ খোলা, ওপরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সারা শরীর সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। তার বেডের সামনে বসেই প্রথম প্রশ্ন ছিল, ভাই শরীর কেমন? কথা বলতে পারবেন? ভিপি উত্তর দিলেন, ‘অবশ্যই। আমি কথা বলেই যাব।’

আপনার ওপর বারবার হামলা। কেন? ভিপি জোরাল কণ্ঠে উত্তর দিলেন, ‘আমাকে থামানোর জন্য। তবে আমি থেমে যাব না, আগের চেয়ে দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে চলব।’

এরপর আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে হলো না। নিজ থেকেই বলে গেলেন...

হামলার বর্ণনা দিয়ে নুর বলেন, ‘তাদের (মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ) টার্গেট ছিলাম আমি। তাই তারা একে একে তিনবার হামলা করেছে। সেদিন আমি ঢাকা মেডিকেলে ডাক্তার দেখাতে আসি। এরপর ডাকসুতে যাই। তখন ডাকসুতে ২০-২৫ জন ছিল। আমরা রুমে ঢুকছিলাম, তখনই পেছন থেকে তারা অতর্কিত হামলা করে। সামনে থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়ালে তারা দৌড়ে নিচে নেমে যায়, ডাকসুর দিকে বাইরে থেকে ইটপাটকেল ছুড়ে মারে।

তখন আমি ডাকসুর স্টাফদের বলি, কলাপসিবল গেট আটকে দিতে। তারা লাগিয়ে দেয়। আমি বলেছি, সিসিটিভির ফুটেজ যেন সংগ্রহ করা হয়। এরপর সাদ্দাম ও সঞ্জিত (ছাত্রলীগ নেতা) আমার রুমে ঢুকে আমার সঙ্গের নেতাকর্মীদের মারতে মারতে বাইরে বের করে আনে। তিনজনকে ডাকসুর ছাদ থেকে ফেলে দেয়। সঞ্জিত নিজে আমাকে ধাক্কা মারে। সঞ্জিত ছেলেদের বলে, ‘জামায়াত-শিবির এখানে আসছিল কেন?’

nuur-03.jpg

আমি বলি, ভিপির রুমে কে আসবে, না আসবে আপনি ঠিক করার কে? তখন সঞ্জিত বলে, ‘… আমি কে, কিছুক্ষণ পর টের পাবি।’

এটা বলার পর তারা বের হয়ে যায়। পাঁচ মিনিট পর তারা লাইট বন্ধ করে বাঁশ, রড দিয়ে আমাদের মারতে শুরু করে।

হামলার সময় ভিসি-প্রক্টরকে ফোন দিয়েছিলাম, ধরেননি

হামলায় ঢাবি প্রশাসনের অসহযোগিতার অভিযোগ করে নুর বলেন, ‘প্রথম হামলার সময় আমি ভিসি-প্রক্টরকে ফোন দিয়েছিলাম। তারা কেউ ফোন ধরেননি। প্রতিটা ঘটনার সময় প্রক্টরকে ফোন দেই। উনি সবই জানেন, কিন্তু ফোন ধরেন না। সব ঘটনা উনার কনসার্নে (অবগত) হয়, কিন্তু ব্যবস্থা নেন না। আমাকে অনেকে বলেছে যে, প্রক্টর অন্য ছাত্র সংগঠনকে বলেছে যে, ‘নুরদের কেন আমরা স্পেস দিচ্ছি। প্রক্টরের ভূমিকা ক্যাম্পাসে অনেকটা ছাত্রলীগের মতোই।’

নুর বলেন, ‘হামলার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। একাধিকবার ঘটেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমাকে নিষেধ করেছে, আমি যেন শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে কথা না বলি। কারণ তারা মালয়েশিয়ার মতো আরও ১০ বছর দেশ শাসন করবে। এজন্য যদি ২০ হাজার মানুষ মেরে ফেলতে হয় তারা মেরে ফেলবে। আর দু-একজন নুরকে মেরে ফেললে কী যাবে তাদের?’

‘আমি তাদের কথা শুনি না, সরকারের দুঃশাসন, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কার্যক্রম, ভারতের চুক্তি নিয়ে পোস্ট দেয়ার কারণে..., আবরারের মৃত্যু, নুসরাত হত্যা...। গতকাল (২২ ডিসেম্বর) এনআরসি নিয়ে প্রতিবাদ করায় হামলার শিকার হলাম।’

nuur-03.jpg

আমাদের মেরে ফেলতে দেশের বাইরে থেকে প্ল্যান দেয়া হচ্ছে

তিনি বলেন, ‘আমাদের ওপর হামলা শুধু সরকারের নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা নয়, তাদের বাইরে থেকে প্ল্যান দেয়া হচ্ছে আমাদের মেরে ফেলতে। আমাদের সর্বশেষ হামলাটা ছিল মেরে ফেলার উদ্দেশ্যে। যাতে সারাদেশের মানুষের মধ্যে একটা ভয় তৈরি হয়। ডাকসুর ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে, রুম থেকে টেনে টেনে নামিয়ে পিটিয়েছে। ওপরের ব্যাকআপ ছাড়া এটা কখনও সম্ভব না। ওপর থেকে তাদের বলছে, ‘তোমরা চালাও’। আওয়ামী লীগের এ স্বৈরাচারী প্ল্যানের বিরুদ্ধে সবাইকে রুখে দাঁড়াতে হবে।’

ছাত্রলীগ নেতারা বলছে, ‘এ ভিপিকে ডাকসু চায় না।’ এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ভিপি নুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা শুধু সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলি না। আমরা পেঁয়াজের মূল্য নিয়ে কথা বলি, কৃষক ধানের মূল্য না পেলে কৃষকের সন্তান হিসেবে কথা বলি, যখন দেশে আইনের শাসন থাকে না কথা বলি, রিফাত, নুসরাত হত্যার প্রতিবাদ করি। কিন্তু সরকার মনে করে, আমরা তাদের শুধু দুঃশাসনটা তুলে ধরি। তাই তারা আমাদের মেরে ফেলার চেষ্টা করছে। আমাদের সংগঠনের প্রত্যেকটি নেতা ও তার পরিবারকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো, আমাদের থামিয়ে দেয়া। এখনকার উদ্দেশ্য আমাকে মেরে ফেলা। আমার ওপর নয়বার হামলা হয়েছে। একটিরও বিচার হয়নি। কারণ প্রতিটা ঘটনা সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্ল্যান দেয়া হয়েছে। তা না হলে প্রকাশ্যে হামলার বিচার পেলাম না কেন?’

‘আমরা যতদিন বেঁচে আছি, দেশের আওয়ামী দুঃশাসন, বিচার বিভাগ ধ্বংস করে স্বৈরতন্ত্র কায়েমের বিরুদ্ধে কথা বলব। সাময়িকভাবে আমরা হয়তো বিপর্যস্ত হয়েছি, তবে আন্দোলন থামবে না। আমরা থামব না। আগের চেয়ে আরও দ্বিগুণ গতিতে এগিয়ে চলব। প্রতিবার হামলার পর আমরা আমাদের গতি দেখিয়েছি, ভবিষ্যতেও দেখাব।’

শারীরিক অবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে নুর বলেন, ‘ওরা আমার ডান হাতে রড দিয়ে পিটিয়েছে। এখানে খুবই ব্যথা, কালো হয়ে গেছে। আমার ছোট ভাইরা আমাকে সেভ না করলে আমি হয়তো মারা যেতাম।’

গত রোববার (২২ ডিসেম্বর) ডাকসু সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর ও তার অনুসারীদের ওপর হামলা চালায় মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের নেতাকর্মীরা। হামলায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও অংশ নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ওই হামলায় নুরসহ অন্তত ৩৪ জন আহত হন। আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

বর্তমানে সেখানে মোট পাঁচজন চিকিৎসাধীন। তারা হচ্ছেন- ভিপি নুর, সোহেল, আমিনুল, ফারুক ও ফারাবী। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ড. এ কে এম নাসির উদ্দিন মঙ্গলবার তাদের শারীরিক অবস্থা নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, তারা শঙ্কামুক্ত। সবার অবস্থারই উন্নতি হয়েছে।

ভিপি নুরুল হক নুরের অবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নুর সার্বিকভাবে ভালো আছে। তার দু-চারটি জায়গায় সমস্যা আছে। ঘাড়-হাতে পুরোনো ইনজুরিতে (আঘাতে) ব্যথা আছে। তার এক্সরেসহ আরও কিছু টেস্ট করানো হবে। সব মিলিয়ে আহতদের কেউ শঙ্কাটাপন্ন নয়। দু-একদিন পর মেডিকেল বোর্ড আবার বসবে। তখন তাদের বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা তুহিন ফারাবীর বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি আইসিইউতে ভর্তি। তাকে গতকাল কেবিনে শিফট (স্থানান্তর) করার চিন্তা করা হয়েছিল। তবে অতিরিক্ত দর্শনার্থীর কারণে তাকে আরও একদিন আইসিইউতেই রাখা হয়। এখন তিনি ভালো আছেন। তার ঘাড়ে এক্সরে করানো হবে। এছাড়া মেডিসিন চলছে। আজ কেবিনে নেয়া হবে। তিনি বাসায় যেতে চেয়েছিলেন। তবে আমরা তাকে আরও একদিন হাসপাতালে রেখে পর্যবেক্ষণ করব।

ভিপি নুরুল হক নুরসহ অন্য ছাত্রদের ওপর হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) শাহবাগ থানার নীলক্ষেত পুলিশফাঁড়ির ইনচার্জ উপ-পরিদর্শক মোহাম্মদ রইচ হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলা নং- ৩৪

পুলিশের দায়ের করা মামলায় আটজনের নাম উল্লেখসহ ৩০ থেকে ৩৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। মামলার আট আসামি হলেন- মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুল, সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, ঢাবি শাখার সভাপতি এ এস এম সনেট, সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্য, এ এফ রহমান হল শাখা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক ইমরান সরকার, কবি জসিম উদ্দিন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াদ আল রিয়াদ (হল থেকে অস্থায়ী বহিষ্কৃত), জিয়া হল শাখা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সভাপতি দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম মাহিম এবং মাহবুব হাসান নিলয়।

আসামিদের মধ্যে গতকাল সোমবার আটক হন দুজন। পরে আরও একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন- মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত তূর্য ও মেহেদি হাসান শান্ত। মঙ্গলবার আদালতের মাধ্যমে তাদের তিনদিনের রিমান্ডে নেয়া হয়

এআর/সাদী/এমএআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।