সড়ক-পরিবহন পরিকল্পনায় শুধু ভুল আর ভুল
অধ্যাপক ড. সামছুল হক। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক। যুক্তরাজ্যের সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবহন বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। বহুমুখী পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশেষ পরিচিত নাম, দেশ এবং দেশের বাইরেও।
পরিবহন সংকট ও সমাধান এবং নতুন আইন প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। সড়ক ও পরিবহন পরিকল্পনার গোড়াতেই ভুল রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। দীর্ঘ আলোচনায় সংকট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ মতামতও ব্যক্ত করেন এ বিশেষজ্ঞ। চার পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : সড়ক পরিবহনের জন্য নতুন আইন হলো। আইনের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হচ্ছে। আপনি কি মনে করেন, নতুন আইনে পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরবে?
সামছুল হক : জনজীবনে পরিবহন তথা যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পরিবহন খাত একটি সিস্টেমের মধ্য দিয়ে চলার কথা। এ সিস্টেমকে যদি টেকসই ও নিরাপদ করতে হয়, তাহলে পরিকল্পনা ও নকশা হতে হয় নিখুঁত।
এখানে সিস্টেমটা হতে হবে এমন যেন স্বনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। এমন একটি পরিবেশ দিতে হবে মানুষ যেন আপনা থেকেই প্রভাবিত হয়ে আইন মানে।
জাগো নিউজ : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্বনিয়ন্ত্রিত!
সামছুল হক : আমাদের কাছে উদাহরণ তো আছে। গুলশানে ‘ঢাকা চাকা’ এককভাবে চলছে। তার কোনো প্রতিযোগী নেই। যেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী তোলার কথা, সেখানে দাঁড়িয়েই যাত্রী তুলছে। পাল্টাপাল্টি কোনো অবস্থান নেই চালকদের। সেখানে কোনো পুলিশ লাগছে না। ফ্রেঞ্চাইজ বাস রুটের পরিকল্পনাটাই এমন যে, এক রুটে যত যাত্রীর চাহিদা আছে তা একটি মাত্র অপারেটর বহন করবে।
এখানে চালক নির্দিষ্ট বেতনভুক্ত। যাত্রীর পকেটের সঙ্গে চালকের কোনো সম্পর্ক থাকছে না। এখানে চালককে নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে রাস্তায় দাঁড়াতে হচ্ছে না।
তার মানে, ঢাকার মধ্যেই যদি এভাবে পরিবহন অপারেট করা সম্ভব হয়, তাহলে আমাদের বুঝতে হবে আইনটা আসলে মুখ্য নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে স্মার্ট পরিকল্পনা নিতে হবে এবং মানুষও তাতে স্বনিয়ন্ত্রিত হওয়ার সুযোগ পাবে।
প্রকৌশল, শিক্ষা ও আইন প্রয়োগে সমন্বয় করেই পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে হয়। কিন্তু আমাদের সড়ক-পরিবহন পরিকল্পনা ও নকশায় শুধু ভুল আর ভুল! কেমন ভুল? মারাত্মক ভুল! পরিবহন পরিকল্পনার জন্মটাই যেন অসুস্থ প্রতিযোগিতায়!
জাগো নিউজ : যদি ব্যাখ্যা করতেন…
সামছুল হক : একটি করিডোরে ১০-১২টি অপারেটরের অনুমোদন দেয়া হয়। আমি তো মনে করি, যারা এ রুট পরিকল্পনা করেন, তারা আয়োজক হিসেবে সার্থক। কারণ তারা প্রতিযোগিতার জন্যই এমনটি করছেন এবং তা-ই হচ্ছে। গাড়ির ছাল-বাকল উঠে যাচ্ছে, মানুষকে পিষে মেরে ফেললেও তাকে প্রতিযোগিতায় আগে থাকতেই হবে। তার মানে, পরিকল্পনাটা এমনভাবে করা হলো যে, অসুস্থ প্রতিযোগিতা হতে বাধ্য।
এমন অসুস্থ প্রতিযোগিতা রেখেই যদি আমি একটি আইন করি এবং সেই আইন মানুষশাসিত হবে, তাহলে ফের ভুল হবে। কারণ পরিবহন পরিকল্পনার জন্মটাই পঙ্গুত্বের মধ্য দিয়ে।
জাগো নিউজ : এখন কী উপায়?
সামছুল হক : আশির দশকে এরশাদ সাহেবের শাসনামলে প্রগতি সরণি ও বেড়িবাঁধ করা হলো। এরপর ভূমি উন্নয়ন বহুগুণ বেড়ে যায়। সড়কের আশপাশের উন্নয়নও বহুগুণ বাড়ে। কিন্তু সড়ক চওড়া হয়নি একটুও। বরং সড়ক দিন দিন সরু হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষ গাড়ি কিনছে। পরিবহনের চাহিদা বেড়ে গেছে। সেই চাহিদা চেপে রেখে আমি শুধু শাসন করব, তা-তো হতে পারে না।
জাগো নিউজ : পরিকল্পনার ভুলের কথা বলছেন। কিন্তু এরপরও বলতে হয়, আইন না থাকা বা না মানার কারণে পরিবহনে সংকট আরও বাড়ছে। আইনের সংস্কার তো অস্বীকার করা যায় না…
সামছুল হক : সব জায়গায়ই আইনের দরকার। আইন ছাড়া সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের মনে রাখতে হবে, মানুষ মাত্রই সুযোগসন্ধানী।
এ কারণেই উন্নত বিশ্বে অবকাঠামো নির্মাণে কোনো ত্রুটি থাকে না। মানুষের যা আয়োজন করা দরকার, তা সুন্দরভাবে করে রাখে। এরপরও পুলিশকে রাস্তায় থাকতে হয়। কঠোর আইনের মাধ্যমে শৃঙ্খলায় রাখতে হয়। কারণ মানুষ মাত্রই আইন ভাঙতে চাইবে। আইন ভাঙতে ভাঙতে বদঅভ্যাসে রূপ নেবে। এটা করতে দেয় না সেখানকার ব্যবস্থাপনা।
আইন কঠোর করলাম আর ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রাখলাম, তাহলে কোনো দিনই সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। এই সোজা হিসাবটা আমাদের বুঝতে হবে।
জাগো নিউজ : এরপরও আইনের সংস্কার দাবি রাখে কি-না?
সামছুল হক : অবশ্যই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাস্তবায়নের প্রয়োগ নিয়ে। সরকার যদি নিজের ঘর থেকে আইন প্রয়োগ শুরু করে, তাহলে মানুষ কিছুটা আশ্বস্ত হবে। বিআরটিসি থেকেই শুরু করুক।
বিআরটিসি বাসের ফিটনেস আছে কি-না, সেটা আগে দেখুক। চালকরা লিজ সিস্টেমে চালায় কি-না? গাড়িগুলো কোথায় রাখে?
সচিবালয়ের সামনের গুরুত্বপূর্ণ সড়কে বিআরটিসি বাসগুলো সারাদিন পার্কিং করে রাখে। অবৈধ পার্কিংয়ের অপরাধে গাড়িপ্রতি ১০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করুক। পারবে না। তার মানে, ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো অবৈধ পার্কিং করে রাখছে। পাইলট প্রকল্প মনে করেও সরকার নিজের ঘরের বিআরটিসি থেকেই শুরু করুক। দেখতে পাবে ঘাটতি কোথায়?
জাগো নিউজ : আপনার বিশ্লেষণ কী? আসলে ঘাটতি কোথায়?
সামছুল হক : ঢাকা একটি মেগাসিটি। অথচ, বাস দাঁড়ানো বা রাখার কোনো জায়গা রাখা হয়নি। এটি একটি তুঘলকি কারবার। পাশের দেশ ভারতের কলকাতা শহরের মধ্যখানে বাস রাখার জন্য ২৯টি জায়গা আছে।
কারণ যারা শহর নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন, সকাল বেলা বাসগুলো যাত্রী নিয়ে ঢুকবে। তার সবগুলোই ফেরত যাবে না। কারণ সারাদিন সমান হারে যাত্রী পাওয়া যাবে না। যারা টাউন প্ল্যান করেন, তারাই কৌশলের কথা জানেন। সিটি বাস টার্মিনালগুলো যদি থাকত, তাহলে বিআরটিসি বাসগুলো সড়ক দখল করে দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়।
আমি মনে করি, পরিবহনের নতুন আইন খুবই ভালো হয়েছে। ধাপে ধাপে প্রয়োগ করুক। সরকার তা শুরু করুক বিআরটিসি দিয়েই। তখন কিন্তু সত্যের কাছাকাছি আসা যাবে। বিআরটিসিচালক তখন জানতে চাইবে, আমি গাড়িগুলো কোথায় পার্কিং করব, দয়া করে জানিয়ে দিন। রাস্তা দিয়েছেন চলার জন্য। কিন্তু রাখার জায়গা কই? মূল সমস্যা হচ্ছে, ঢাকায় কোনো বৈধ বাস টার্মিনাল নাই।
জাগো নিউজ : এ ভুল কার?
সামছুল হক : এ ভুলের জন্য প্রথমেই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নাম আসবে। তারা মানুষকে থাকার জায়গা দিয়েছে। চলাচলের জায়গা দিয়েছে। অথচ, পরিবহন রাখার জায়গা দেয়নি। তার মানে, সঠিক পরিকল্পনা নেয়া হয়নি। এ ভুল যদি শুধরাতে না পারি, তাহলে সামনে আরও বিপদ। পূর্বাচল হচ্ছে। উত্তরায় প্রকল্প হচ্ছে। অন্য শহরেও উন্নয়ন হচ্ছে। তার মানে, কোথায় বাস টার্মিনাল থাকবে না।
প্রয়াত মেয়র আনিসুল হককে বলেছিলাম, ‘আপনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে তেজগাঁও থেকে ট্রাক স্ট্যান্ড সরিয়েছেন। ভালো কথা। আপনি বারবার বলেছেন, এ টার্মিনাল অবৈধ। তাহলে আমাকে উত্তর দিন, বৈধ টার্মিনাল কোথায়?’
ঢাকা মেগাসিটির প্রাণকেন্দ্র কারওয়ানবাজার। প্রতিদিন শতশত ট্রাক পণ্য ওঠা-নামা করছে। সেই পণ্যে আড়াই কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচছে। অথচ, আপনি ট্রাকগুলো রাখার কোনো ব্যবস্থা রাখলেন না। আপনি যদি টেকসই সমাধান চান, তাহলে কে এই পরিস্থিতি তৈরি করল, তাকে খুঁজে বের করেন।
জাগো নিউজ : তার মানে, পেশাদারিত্বের ঘাটতির কারণেই ...
সামছুল হক : অবশ্যই। সংশ্লিষ্ট পেশাদারদের দায়িত্বই দেয়া হয়েছে পরিকল্পনা নিয়ে নগর উন্নয়ন করবে। একজন পেশাদারকে বসানোই হয়েছে, জনকল্যাণে কী করণীয়, তার ব্যবস্থা করে রাখা।
ভুল ধরার পর আন্দোলনের মাধ্যমে শুধরানো নয়, আগে থেকেই তুমি ব্যবস্থা করে রাখো।
এএসএস/এমএআর/পিআর